বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা হয়েছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! বছরের শুরুতে ব্যাংকিং খাত পড়েছে তারল্যসংকট ও সুদের হারের বৃদ্ধির দশায়। ইতিমধ্যে এ খাত খেলাপি ঋণের ভারে নুয়ে পড়া এবং অনিয়ম ও বিচারহীনতায় নিমজ্জিত, লাগামহীন লোপাটে তলায়মান। এ অবস্থায় যেখানে ব্যাংকগুলোকে শৃঙ্খলায় আনা দরকার ছিল, সেখানে ব্যাংকের মালিকদের চাপের মুখে আরও ছাড় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ছাড়ের তালিকায় রয়েছে: ১. ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ বা ক্যাশ রিজার্ভ রেসিও (সিআরআর) সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা, ২. সরকারি আমানতের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বেসরকারি খাতের ব্যাংকে প্রদান, ৩. ঋণ আমানত অনুপাতের সীমা (এডিআর) সমন্বয়ের সময় ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো এবং ৪. বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে প্রদত্ত সুদহার ৬ দশমিক ৭৫ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করা। উল্লেখ্য, ব্যাংকগুলোর আমানতের সাড়ে ৬ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা রাখার বিধান বলবৎ ছিল। সরকারি আমানতের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার প্রবিধান ছিল। সরকারি আমানতের সংরক্ষণ ছাড়া অন্য সব সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নেওয়ার কথা। এসব সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ তাই যথেষ্ট যুক্তিসংগত।
ব্যাংকব্যবস্থা নিয়ে ইদানীং যে আলোচনা হচ্ছে, তা বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে যেমন যুক্ত, একই সঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও জবাবদিহির সঙ্গেও জড়িত। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেকসই ও মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকেও টেকসই ও শক্তিশালী করা জরুরি। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর পদক্ষেপ আসলে কতটুকু ব্যাংকব্যবস্থার সত্যিকার পরিবর্তনের জন্য এবং কতটুকু নিছকই গোষ্ঠীস্বার্থের জন্য, সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর মিললে সংকট নিরসনের পন্থাও বাতলানো সহজতর হতে পারে।
খেলাপি ঋণের বাড়বাড়ন্ত
খেলাপি ঋণসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা বা বিতরণকৃত ঋণের ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। এরপর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে মোট ঋণের পরিমাণ ৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা বা মোট ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ। অর্থাৎ বাড়ার অনুপাত ৬ থেকে ১১ শতাংশে। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা (জুন, ২০১৭ পর্যন্ত)। বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে, অবলোপন করা ঋণের পরিমাণও ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অঙ্ক আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বেশি। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ। নিয়ম যে ছিল না তা নয়। ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ৫০ হাজার টাকার ওপরে ঋণ অবলোপনের আগে আদালতে মামলা করাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু কাজির গরু কেতাবেই রয়ে যাচ্ছে!
মোট ঋণের তুলনায় খেলাপি ঋণের পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। পার্শ্ববর্তী ভারতের জিডিপির পরিমাণ ২ দশমিক শূন্য ৭৪ ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার)। আর তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫৪ বিলিয়ন ডলার (১৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার)। অর্থাৎ ভারতের জিডিপির ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ খেলাপি ঋণ।
মূলধন জোগানোর ধাক্কা
খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন-ঘাটতিতে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি মোট নয়টি ব্যাংকের মূলধন-ঘাটতির পরিমাণ ১৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। তাই পুনঃ মূলধনের নামে এ ব্যাংকগুলোকে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ১৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা জোগান দিতে হয়েছে, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ করা এডিপির ১৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেটেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ করের টাকা দিয়ে বিসমিল্লাহ, হল-মার্ক, এননটেক্সসহ অন্যান্য ব্যাংক লুটকারীর ভরণপোষণ করা হচ্ছে। বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছেন। লুটকারীদের যাঁদের জেলে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের আয়েশি জীবনের চিত্র পত্রিকান্তরে দেখা যাচ্ছে। বিচারহীনতা এর চেয়ে বড় কী দৃষ্টান্ত হতে পারে। সেলুকাস আর কী করবে!
কুখ্যাত সেই ১০০ জনের কী হলো?
কয়েক মাস আগে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দেশের ১০০টি খেলাপি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করেন, কিন্তু তাতে সর্বজনবিদিত তারকা খেলাপিদের নাম নেই। যাঁদের নাম থাকা উচিত ছিল, তাঁদের প্রায় সবাই পুনঃ তফসিলীকরণের আড়ালে কিংবা উচ্চ আদালতের আশ্রয়ে থাকায় আইনি বাধ্যবাধকতায় তালিকার বাইরে রয়ে গেছেন। আগে সাধারণত খেলাপি হলে শুধু ঋণ পুনঃ তফসিল করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বর্তমানে ‘ঋণ পুনর্গঠন’ নামে অনেক বেশি সুবিধা ও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে বড় ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বড় অঙ্কের ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে। এ পক্ষপাতমূলক সুবিধার আওতায় ৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি অঙ্কের ঋণেরই শুধু পুনর্গঠন করা যাবে। অর্থাৎ নিয়ম পালনকারী বৈষম্যের স্বীকার হবেন। অন্যদিকে, খেলাপির অনন্ত সুযোগ-সুবিধা! নীতিমালা অনুসারে মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠন সর্বোচ্চ ১২ বছরের জন্য। আর তলবি ও চলমান ঋণ পুনর্গঠন হবে ছয় বছরের জন্য। ঋণের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার কম হলে ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা দিতে হবে ২ শতাংশ হারে। আর এক হাজার কোটি টাকা ও তার বেশি পরিমাণ ঋণের জন্য এককালীন জমা দিতে হবে ১ শতাংশ হারে। পরিসংখ্যান বলছে, পুনর্গঠন-সুবিধা নিয়ে ব্যবসায়ীদের বড় অংশই কিস্তি পরিশোধ করছেন না। ইতিমধ্যেই পুনর্গঠন-সুবিধা পাওয়া অর্ধেকই নতুন করে খেলাপি হয়েছে। ফলে এ সুযোগের কারণে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক থেকে দেওয়া ঋণের বিপুলাংশ খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে।
নতুন প্রজন্মের ব্যক্তি মালিকানাধীন ফারমার্স ব্যাংক ঋণ বিতরণে অনিয়ম, জালিয়াতি ও লুটপাটে অতীতের যেকোনো ব্যাংক কেলেঙ্কারি-অনিয়মকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৩ সালের জুনে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে এরই মধ্যে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৭৭ কোটি টাকা। রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত নতুন ব্যাংকগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। ওগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে। পত্রিকান্তরে পরিচালনা পর্ষদের নয়-ছয়ের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
ঋণ আমানত অনুপাতের গ্রহণযোগ্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে ১০ ব্যাংকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে বেপরোয়া ব্যাংকিংর ফলে আমানতের ৮৫ ভাগেরও বেশি ঋণ দিয়েছে। এতে গোটা ব্যাংক খাতে হঠাৎ করেই বেড়েছে তারল্য চাহিদা। বাড়তে শুরু করেছে ঋণের সুদ হার। এমন বেপরোয়া ব্যাংকিং ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও আগেই সচেতন হওয়া উচিত ছিল।
প্রথম আলো; ০৩ মে ২০১৮, ০৯:০৬