বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির নির্ধারক চরিত্র হচ্ছে ভয়। সহজ ভাষায় বললে, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে এখন ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজমান। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আমার মনে এই আশংকা তৈরি হয়েছিল যে দেশে এই রকম একটি পরিস্থিতির সূচনা হতে পারে। কেননা সে সময় তার লক্ষনসমূহ প্রকাশিত হতে শুরু করে। সেই প্রেক্ষাপটে আমি এই সংস্কৃতির স্মারক ও বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করার তাগিদ অনুভব করি। সেই প্রচেষ্টার ফসল হল আমার বই ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ (আলী রীয়াজ, ভয়ের সংস্কৃতিঃ বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের প্রকৃতি ও পরিসর, ঢাকাঃ সাহিত্য প্রকাশ, ডিসেম্বর ১৯৯৪)।
গ্রন্থটির শুরুতেই আমি লিখেছিলামঃ ‘বাংলাদেশে যে সংস্কৃতি নির্মীয়মান, ইতোমধ্যে নির্মিত ও প্রবলভাবে বিরাজমান আমরা তাকে বলতে পারি ভয়ের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির প্রধান উপাদান হল সন্ত্রাস এবং আতঙ্ক। ভীতি উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের মধ্যেই এই সংস্কৃতির সূচনা, বিকাশ ও স্থায়িত্ব। ভয়ের সংস্কৃতি হল এমন এক আবহাওয়া ও পরিবেশ যেখানে আতঙ্ক, সন্ত্রাস ও বল প্রয়োগ একাধারে ক্ষমতার/শাসনের একটি ধরন এবং পারস্পরিক সম্পর্কের নির্ণায়ক। অর্থাৎ সমাজে উপস্থিত শ্রেণী, গোষ্ঠী, ব্যক্তি সমূহের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে জবরদস্তি, স্বেচ্ছাচারিতা’।
ভয়ের সংস্কৃতি কি এবং কিভাবে তা প্রযুক্ত হয় তা বোঝার জন্য এটা মনে রাখাই যথেষ্ট যে, আতঙ্ক সৃষ্টি, সন্ত্রাসী তৎপরতা পরিচালনা বা বল প্রযুক্ত হওয়ার ঘটনা প্রতি ক্ষেত্রেই ঘটতে হবে এমনটি জরুরি নয়। আতঙ্ক, সন্ত্রাস, বল প্রয়োগের যে কোনো একটা ঘটতে পারে এই বোধই যথেষ্ট। ভয়ের সংস্কৃতি এই অর্থে একটি নির্মিত বা তৈরি করা মানসিক অবস্থা। এই অবস্থা ও পরিবেশ যখন প্রবল হয়ে ওঠে এবং সমাজের ভেতরে এর ভিত্তিতে সব ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়; সম্পর্কের ধরন নির্ধারিত হয় – অর্থাৎ কে প্রবল কে অধস্তন, কে সম্মানযোগ্য কে সম্মানযোগ্য নয় ইত্যাদি – তখনি আমরা বলতে পারি যে ভয়ের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে ঐ সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট।
ভয়ের সংস্কৃতির প্রাবাল্য, প্রকৃতপক্ষে আধিপত্য, বোঝার জন্য চারপাশে তাকানোই যথেষ্ট। গত প্রায় এক দশকে যে হারে আইন-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যে হারে গুম/রহস্যজনক অন্তর্ধান হয়েছে, স্বাভাবিক মৃত্যু যে অস্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে, পিটিয়ে মারা যে আশঙ্কাজনক হারে সমাজে বেড়েছে এবং তা নিয়ে সমাজে যে কোনো উদ্বেগ লক্ষ করা যাচ্ছে না, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীতার নামে যে ভাবে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেই চলেছে তা থেকেই এটা প্রমাণিত হয়।
কোনো সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি প্রাবাল্য লাভ করলে তা কেবল রাজনীতির পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বাংলাদেশের নারীদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার ঘটনা প্রমাণ করে যে এই সংস্কৃতির একটা পুরুষতান্ত্রিক রূপ রয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যে বারবার আক্রান্ত – জাতিগত সংখ্যালঘুরা যেমন, ঠিক একইভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও – তাতে প্রমাণিত হয় সংখ্যাগুরুরা কেবল সংখ্যার জোরে অন্যান্যদের বশীভূত করতে চায় এবং তা করতে পারে। এ সব থেকে এটাই প্রমাণিত যে ভয়ই হচ্ছে এখন বশ্যতা তৈরির পথ। ভয়ের সংস্কৃতি যে কতটা গ্রহণযোগ্য কৌশল হিসেবে স্বীকৃত সেটা বাংলাদেশের যে কোনো হরতালের আগের দিনের সন্ধ্যায় যারা পথে থাকেন তাঁরা ভালো করেই উপলব্ধি করেন, যারা তাঁদের অপেক্ষায় থাকেন তাঁদের চোখের দিকে তাকালে যে ছবি দেখা যাবে আমি তাকেই ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ বলে বর্ননা করেছি। বাংলাদেশে বিশেষ ধরণের, বিশেষ পরিবারের ব্যক্তিরা যে আইনের উর্ধবে থাকেন সেটাও এই সংস্কৃতিরই একটি প্রকাশ। নাগরিকরা এদের ব্যাপারে এতটাই ভীত যে এ নিয়ে কথা বলার আগে তাঁরা চারপাশে তাকান।
বাংলাদেশে শাসনের ধরণ যে কর্তৃত্ববাদী (অথরিটারিয়ান) সেটা নতুন নয়। ১৯৯১ সালের পর আশা করা হয়েছিল যে তার অবসান হবে। কিন্ত তা অবসান তো হয়ই নি বরং তারপরে যে দল বা ব্যক্তি ক্ষমতায় গেছেন সে বা তাঁরা আরো বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে। প্রত্যেক শাসক দল যে নতুন নতুন মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী আইন ও বাহিনী তৈরি করেছে সেটা থেকেই এটা স্পষ্ট। এর কারণ হল শাসনের জন্যে যে নৈতিক ও আদর্শিক আধিপত্য থাকা দরকার বাংলাদেশের দল নির্বিশেষে কোনো দলেরই তা নেই – আপস করার নামে, নির্বাচনে বিজয়ের আশায় তাঁরা স্বৈরশাসক এবং বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিরোধীদের সঙ্গে এক বিছানায় উঠতে মোটেই দ্বিধা করেনি। বাংলাদেশে নির্বাচনে যেই দলই বিজয়ী হোন না কেন সেই দলই একই ভাবে আচরণ করে। এই নৈতিক নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থতার কারণে বল প্রয়োগ ছাড়া শাসকদের হাতে আর কোনো বিকল্প থাকেনা।
একটি সমাজের সর্বস্তরে ভীতি, সন্ত্রাস ও আতঙ্কের উপস্থিতি ঐ সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র। ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে পপুলিস্ট রাজনীতির মধ্য থেকেই। ফ্যাসিবাদের একটা বড় লক্ষণ হলো রাষ্ট্রের সর্বব্যাপ্ত উপস্থিতি, অসহিষ্ণুতা ও সমর্থকদের প্রতি পক্ষপাত; আইনের মাধ্যমে সহিংসতাকে স্বীকৃতি প্রদান এবং ভিন্নমতকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে জবাবদিহিতা অনুপস্থিত, রাষ্ট্র কারো কাছেই দায়বদ্ধ নয়। তদুপরি আতঙ্ক ও সন্ত্রাস মানুষের প্রতিরোধের শক্তিকে চূর্ণ করে ফেলতে উৎসাহী। ফলে আইনানুগ বল প্রয়োগ ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠা করে বল প্রয়োগের আইনের আধিপত্য।
ভয়ের সংস্কৃতির আরেক পরিণতি হতে পারে ধর্মরাষ্ট্র বা ‘থিওক্রেটিক স্টেট’–এর প্রতিষ্ঠা। ধর্মরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনরা হয় ধর্মীয় মৌলবাদী। ধর্মরাষ্ট্র তার নাগরিকদের অধীনস্থ রাখে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ভয় উভয়কে জারি রাখার মধ্য দিয়ে। তারা ইহলৌকিক ভয় জারি রাখে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে আর পারলৌকিক ভয় জারি রাখা হয় ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে। ভয়ের সংস্কৃতি ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে সহায়ক হয় আরো একটি কারণে, তা হলো অসহায়ত্ব মানুষকে ধর্মাশ্রয়ী করে, তার ইহলৌকিকতাকে লুপ্ত করে। বাংলাদেশে অসহায়ত্ব এখন সর্বব্যাপ্ত। এ রকম পরিবেশেই ভয়ের সংস্কৃতি পুনরুৎপাদিত হয়। হতাশা এবং অসহায়ত্ব মানুষকে যখন ধর্মীয় ভাবাদর্শের অধীনস্থ করে ফেলে তখনই সমাজে মৌলবাদ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের সমাজের চারপাশে তাকালে বোঝা যায় যে মানুষের মধ্যে ইহলৌকিকতার চেয়ে অজ্ঞাত পারলৌকিকতা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
এ সব সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হবে কিনা সেটা নির্ভর করছে ব্যক্তি (এজেন্সি) হিসেবে মানুষের যে নিজস্ব পরিচয় তা সম্পূর্নভাবে পরাস্ত হয়েছে কিনা। আমাদের মনে রাখা দরকার যে কাঠামোর মধ্যে নিপীড়ন, নির্যাতন, সন্ত্রাস ও আতঙ্কের যত উপাদানই থাকুক না কেন, সেটা চূড়ান্ত কথা নয়। ব্যক্তিকে নিষ্ক্রিয়, জড়, কেবল গ্রহিতা হিসেবে বিবেচনা করলেই আমরা ভয়ের সংস্কৃতির স্থায়িত্বের আশঙ্কা করতে পারি। ভাবাদর্শ মানুষকে অধীনস্ত বিষয়ে পরিণত করে বটে, কিন্ত এ সত্ত্বেও ব্যক্তি চিন্তাশীল, অনুভূতিপ্রবণ, সামাজিক এজেন্ট – তার মধ্যে রয়েছে প্রতিরোধের শক্তি। সে সন্ধান করতে পারে নতুন পথ। যে কোনো সমাজে অধীনস্থ মানুষ প্রতিরোধ তৈরির নিজস্ব ফর্ম বা আকার তৈরি করে।
বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতির প্রকৃতি ও পরিসরকে উন্মোচিত করার মধ্য দিয়েই এই অস্বীকৃতির সূচনা করতে হবে। সাংগঠনিকতা তার একটি দিক কিন্ত ব্যক্তিক প্রতিরোধ প্রতিরোধ তার চেয়ে জরুরি। বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতি এখন প্রবল, কিন্ত সেটা চূড়ান্ত নয়। ব্যক্তির সক্রিয়তাই নির্ধারন করবে ভয়ের সংস্কৃতির পরিণতি এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
(এই লেখার মর্মবস্ত এবং অধিকাংশ বাক্য নেয়া হয়েছে আমার পূর্বোক্ত বই, ভয়ের সংস্কৃতিঃ বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের প্রকৃতি ও পরিসর, থেকে। প্রকাশের প্রায় দু’দশক পরে এই গ্রন্থে প্রকাশিত বক্তব্য যে এখনও একইভাবে প্রাসঙ্গিক সেটা উদ্বেগজনক। চলমান সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, এ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাতের জন্যেই এই লেখা।)