December 21, 2024

ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে অবৈধভাবে বাংলাদেশে মানুষের প্রবেশের ঘটনা সবার, বিশেষ করে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ দাবি করে। গত কয়েক সপ্তাহে যাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের ভাষ্য হচ্ছে যে ভারতে জাতীয় নাগরিক তালিকার (এনআরসি) আতঙ্ক ও নানা চাপের কারণে তাঁরা ভারত ছেড়ে চলে এসেছেন। এ নতুন ঘটনাপ্রবাহের তাৎপর্য দুটি প্রেক্ষাপটে বোঝা দরকার। এর একটি ভারতীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং অন্যটি হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক।

গত ৩১ আগস্ট আসামে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরপরই যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, এখন তা–ই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। সেই সময়েই এটা বোঝা যাচ্ছিল যে এনআরসি থেকে বাদ পড়েছে এমন লোকদের ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জোর করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর পদক্ষেপ না নিলেও পরিস্থিতি এমন দাঁড়াবে যে অনেকেই, বিশেষ করে যারা মুসলিম জনগোষ্ঠীর সদস্য, ভীতি এবং চাপের মুখে বাংলাদেশেই আশ্রয় নিতে চাইবে (‘আসামের নাগরিকত্ব সংকট: বাংলাদেশের যা করণীয়’, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ৩১ আগস্ট ২০১৯)। ভারত সরকারের যুক্তি হবে যে তারা জোর করে কাউকে পাঠাচ্ছে না। এখন ভারত সরকার অন্য পদক্ষেপের মাধ্যমে সেদিকেই অগ্রসর হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়েছে যে কর্ণাটক রাজ্য থেকে গত কয়েক দিনে দফায় দফায় ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বলে আটক করে কলকাতায় পাঠানো হচ্ছে এবং তাঁদের শিগগিরই বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করা হবে (দ্য টেলিগ্রাফ অনলাইন, ২৪ নভেম্বর ২০১৯)। কর্ণাটকে আটক ব্যক্তিরা ‘বাংলাদেশি’, তা ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কী করে নিশ্চিত হলো এবং তাঁদের আইনি সুবিধা দেওয়া হয়েছিল কি না, সেই প্রশ্ন ভারতের মানবাধিকারকর্মীরা তুলেছেন। ‘অবৈধ বাংলাদেশি বিতাড়নের’ নামে যা করা হচ্ছে, তাতে মনে হয় ভারত রাখঢাক না করেই একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে। এসব পদক্ষেপ যে এনআরসির সঙ্গে যুক্ত, তা ভারতের অভিবাসনবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। অধ্যাপক সব্যসাচী রায় চৌধুরী বলেছেন, একটি থানায় ২০ দিনে ১৮০ জনকে আটকের ঘটনা স্বাভাবিক নয়। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী ‘এনআরসির ভীতি’ ইতিমধ্যেই ‘কাজ করতে শুরু করেছে’ (হিন্দুস্তান টাইমস, ২৪ নভেম্বর ২০১৯)।

আসামে ১৯৭৯-৮৫ সালের ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক তালিকা বিষয়ে যে চুক্তি হয়েছিল, ২০১৩ সালে আদালত যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেগুলোকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে বা বাধ্য বিষয় বলে বিবেচনা করে ২০১৯ সালে আসামে যে এনআরসির তালিকা তৈরি হয়েছে, তার কোনোটাই সারা ভারতের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু বিজেপির নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহর কিংবা সুস্পষ্টভাবে বললে ‘সংঘ পরিবারের’ অ্যাজেন্ডা হচ্ছে এনআরসির নামে ভারতকে এক হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা, যেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠী দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবে। পাঁচ বছর ধরে বিজেপির বিভিন্ন কার্যকলাপেই তা সুস্পষ্ট। এখন একদিকে বিজেপি আসামের এনআরসি বাতিলের দাবি করছে, অন্যদিকে ভারতের সব রাজ্যে এনআরসি করার হুজুগ তুলেছে। কারণ, বিজেপির আশা ছিল এবং এভাবেই প্রচার চালিয়েছিল যে আসামের এনআরসি যাদের নাগরিক নয় বলে শনাক্ত করবে তাদের অধিকাংশ হবে মুসলিম—তাদের সহজেই বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করা যাবে।

এখন সারা ভারতে এনআরসির জুজু দেখানো হচ্ছে সবাইকে। গত বুধবার পার্লামেন্টে অমিত শাহ বলেছেন, সারা দেশেই এনআরসি হবে। ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামনে প্রশ্ন, তারা কী করবে। ইতিমধ্যেই মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে এনআরসি বয়কট করার প্রস্তাব উঠেছে (স্ক্রল ডট ইন ২৪ নভেম্বর ২০১৯)। হিন্দুত্ববাদ এবং বিদেশিভীতির (জেনেফোবিয়া) মিশ্রণে যে অ্যাজেন্ডা, তার পরবর্তী ধাপ হচ্ছে নাগরিক আইন সংশোধন। এই সংশোধনী আগে চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু এখন বিজেপি এ বিষয়ে আপসহীন। অমিত শাহ বলেছেন নাগরিকত্ব আইন বদলের আগেই সারা ভারতে এনআরসি হবে। তার ফলে এনআরসির কারণে যারা নাগরিকত্ব হারাবে, নতুন নাগরিকত্ব আইনের আওতায় তারা নাগরিক হতে পারবে, কেবল বাদ যাবে মুসলিমরা। কাশ্মীর বিষয়ে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল এবং আদালতে বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে তাদের অ্যাজেন্ডার অনুকূলে রায়ের পরে দলের আশু লক্ষ্য দুটি—নাগরিকত্ব আইন সংশোধন এবং ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু।

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এসব কূটচালের ফল হচ্ছে বাংলাদেশে অবৈধ প্রবেশ। এখন তা সীমিত আকারের হলেও ভবিষ্যতে তা যে বড় আকার নেবে না, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হলে যে অবস্থা হবে, তা কেবল ভারতের ভেতরেই সীমিত থাকবে না। ভারত সরকার এবং ক্ষমতাসীন বিজেপি জানে যে তারা যা করছে, তার ফলে এ অনুপ্রবেশের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হবে। তারা নির্দ্বিধায় এ কাজে এগিয়ে যাচ্ছে, কারণ তারা সম্ভবত ধরেই নিয়েছে যে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোর আপত্তি উঠবে না। এটাই হচ্ছে এখনকার পরিস্থিতির জন্য বিবেচ্য দ্বিতীয় প্রেক্ষাপট—বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক।

ভারতের এনআরসির কারণে বাংলাদেশের উদ্বেগের কিছু নেই—ভারতীয় নেতৃত্বের এমন আশ্বাসে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আস্থা সম্ভবত বেশ জোরালো। কিন্ত এ নিয়ে বাংলাদেশ আগে উদ্বিগ্ন না হলেও এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হতে শুরু করেছে, সে বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে কঠোর বক্তব্য ও অবস্থানই প্রত্যাশিত। এমন একটি পরিস্থিতিতেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ভারত কাউকে পুশব্যাক করবে না বলেছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে বিজেপি নেতা অমিত শাহ ভারতের কথিত অবৈধ অভিবাসীদের ‘বাংলাদেশি’ বলেই বর্ণনা করেছেন, ‘উইপোকা’ বলেছেন, তাদের সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন—কিন্তু এসব নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এমনকি ভারতের সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত যখন বাংলাদেশে থেকে ‘ব্যাপক অনুপ্রবেশ’কে ‘চীনের সাহায্যে পাকিস্তানের প্রক্সি যুদ্ধ’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন, তখনো সরকার এ বিষয়ে নীরবতা পালন শ্রেয় বলে মনে করেছে।

বাংলাদেশ-ভারত সরকারের মধ্যে সম্পর্ক যে গত এক দশকে ঘনিষ্ঠতর হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এ সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার মাত্রা বোঝাতে একে ‘স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক বলেছিলেন। এত কিছু সত্ত্বেও গত এক দশকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী, যখনই সেই হিসাব উঠেছে, দেখা গেছে যে প্রাপ্তি একপক্ষীয়—ভারতের অনুকূলে; অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভূকৌশলগত—যে দিক থেকেই বিবেচনা করা হোক না কেন।

বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের এত ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও এ সম্পর্কের অনেক খবরের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কলকাতা সফরের সময়ে যা ঘটেছে, সে বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন, ‘মিত্র হাসিনার শীতল অভ্যর্থনা, কাঠগড়ায় দিল্লি’। প্রধানমন্ত্রীর কলকাতা সফরের সময় ভারতীয় সরকার যে ধরনের অভ্যর্থনা জানিয়েছে, তা যে কূটনৈতিক বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমেই আমরা তা পাইনি। এ ঘটনা যে এই প্রথমবার ঘটেছে তা নয়, অক্টোবরে শেখ হাসিনা দিল্লি সফরের সময়েও প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ অভ্যর্থনা হয়নি। সেই নিয়েও বাংলাদেশে কোনো গণমাধ্যমে আলোচনা হয়নি। গণমাধ্যমের এ আচরণ থেকেই বোঝা যায় যে সরকার এবং গণমাধ্যম ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় হলেই একধরনের ‘অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতায়’ ভোগে। এ ধরনের আরও উদাহরণ দেওয়া যায়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতা চুক্তি বিষয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর উদ্ধৃত করেই বাংলাদেশে এ নিয়ে আলোচনার সূচনা হয়েছিল। এগুলো কেবল গণমাধ্যমগুলোর অদক্ষতার বিষয় নয়।

ভারত বিষয়ে এ ধরনের স্পর্শকাতরতার কারণেই দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ধরনের অসমতা রয়েছে, সেই নিয়ে আলোচনার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। গণমাধ্যমগুলো রাজনৈতিক বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় বা সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুসরণ করার অর্থ এই নয় যে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা নেই। এখন অনুপ্রবেশের ঘটনায় এ সম্পর্কের প্রশ্নটিই সামনে আসবে। কেবল অনুপ্রবেশের ঘটনাই বিবেচিত হবে তা নয়, সম্পর্কের অন্যান্য দিকও বিবেচিত হবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো এবং নাগরিক সমাজ তা বুঝতে সক্ষম হচ্ছে কি না এবং তাদের যে ভূমিকা, তা পালন করতে তারা প্রস্তুত আছে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

প্রথম আলো’তে প্রকাশিত , ৩০ নভেম্বর ২০১৯

Leave a Reply