[ঢাকা মহানগরীর ভূগর্ভস্থ জলাধারের পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ঝুকিতে থাকা বাংলাদেশের জন্য এই জলাধার একটি কৌশলগত জলাধারের ভূমিকা রাখতে পারে। এই বিষয়টি নিয়ে আমার চলমান গবেষণার অংশ হিসাবে ২০২০ সালের ১ জুলাই অধ্যাপক সলিমুল হকের একটা সাক্ষাৎকার নেই। আজকে খুব ভোরে এই মহারথির মৃত্যু সংবাদের উনার প্রতি শ্রদ্ধা জানানার উদ্দেশ্য এই সাক্ষাৎকারটি কোন রকম সম্পাদনা ছাড়াই আমার ব্যাক্তিগত ব্লগে প্রকাশ করছি। ]
সালিমুল হক, পরিচালক, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ এন্ড ডেভেলপমেন্ট (ICCCAD)
রিয়াজ উদ্দীন: পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে যখন আমরা ভাবব, তখন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে আমরা কীভাবে আমলে নেব?
সালিমুল হক: আমার মতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানির সম্পর্কে সচেতনতা, ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পনা একই সাথে বিবেচনা করা জরুরি। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের একটা বিরাট প্রভাব পরবে হাইড্রলজিকাল সিস্টেমের উপর। বিশেষ করে বাংলাদেশের এবং দক্ষিন এশিয়া অঞ্চলে দক্ষিন এশিয় মৌসুমি বায়ুর উপর একটা প্রভাব পরবে। ঠিক কী হবে সেটা প্রেডিক্ট করা যায় না, কিন্তু আনুমানিক ক্লাইমেট মডেল থেকে যেটা বলা হচ্ছে আমাদের আবহাওয়ার প্যাটার্ন, হাইড্রলজিকাল প্যটার্ন চেঞ্জ হয়ে যাবে। মৌসুমী বায়ুর প্যাটার্ন চেঞ্জ হয়ে যাবে। হয়ত, সারাবছরের মোট বৃষ্টিপাত খুব একটা বাড়বে বা কমবে না। কিন্তু প্যাটার্ন পালটে যাবে। হয়ত আমাদের বর্ষাকালে মৌসুমি বৃষ্টিপাত বাড়তে পারে এবং শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টি কমতে পারে। ফলে আমাদের বন্যা এবং খড়া দুইটিই বাড়তে পারে, যদিও হয়ত মোট বৃষ্টিপাতে খুব একটা পরিবর্তন নাও হয়। আর দ্বিতীয়ত আমাদের এখানে গ্লেসিয়ার আইসমেল্টে কিছুটা প্রভাব পরতে পারে। কারণ গ্লেসিয়ার আইসমেল্ট অত্যন্ত কমে যাবে। আমাদের এখানকার নদীতে গ্লেসিয়ার আইসমেল্টের পরিমান খুব একটা বেশি থাকেনা। কিন্তু যেই সময়ে আমাদের নদীতে গ্লেসিয়ার আইসমেল্টের পরিমান কিছুটা বেশি থাকে, সেটা খুব কমে যাবে। আর তৃতীয় হচ্ছে আমাদের এখানে ঘুর্নীঝড়ের তীব্রতা। তবে ঘুর্ণিঝড়ের সংখ্যা নাও বাড়তে পারে, এই ক্ষেত্রে সাইন্টিফিক মডেলিং এ এখনো কোন বিশেষ পূর্বাভাষ নেই যে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়বে। তবে বিশ্বে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা যদি বেড়ে যায় তাহলে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বাড়বে। সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়লে যে কোন একটা বিশেষ সাইক্লোনের তীব্রতা বাড়বে। আমরা সম্প্রতি আম্ফানের ব্যপারে দেখেছি সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেশি থাকাতে কিছুক্ষণের জন্য এটা সুপার সাইক্লোনের পরিনত হয়ে গিয়েছিল। তবে গ্রাউন্ড ওয়াটারের ক্ষেত্রে কী হবে আমি বলতে পারব না। গ্রাউন্ডোয়াটারের কি প্রভাব পরবে জানা কঠিন। তবে উপকূলিয় নিচু এলাকায় আমরা যেখানে লবনাক্ততার প্রকোপ দেখছি। যেমন লবনাক্ততা প্রবেশ করছে ফলে এটা আশংকা তৈরি করেছে। ঢাকা শহরে নগরায়নের ক্ষেত্রে একদিকে আমরা গভীর নলকুপ দিয়ে পানি উত্তোলন করছি আবার কংক্রিট দিয়ে পুরো ভূ-পৃষ্ঠকে ঢেকে দিচ্ছি। ফলে জলবাইয়ুর পরিবর্তন যাই হোক না কেন, ঢাকার ভূ-গর্ভস্থ পানির সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
রিয়াজ উদ্দীন: জলবায়ু পরিবর্তনে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভেতর দেখা যায় অনেক ধরনের ধারনাকেই জলবায়ু পরিবর্তন বলে ভাবা হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞানের দিক থেকে এবং পরিষ্কার বোঝাপরার স্বার্থে এই বিষয়ে অস্পষ্টতা দূর হওয়া দরকার। আমরা যখন স্থানীয় আবহাওয়ার কথা বলি, আমরা দেখি ইতিহাসবিদরা জানাচ্ছেন আজ থেকে একশ বা দু’শ বছর আগে গ্রীষ্মকালে গরম অনেক বেশি হলেও, দেখা যেত আবহাওয়া সহনশীল মাত্রার ভেতর থাকত। তখন ঢাকায় প্রচুর জলাভূমি,খালবিল, নদী-নালা ছিল বলে এমনটা হয়েছে বলে জানা যায়। এখনত গ্রীষ্মকালের দাবদাহ অনেকটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আমরা এখন আরবান হিট আইল্যান্ডের কথাও শুনি – যেটা ঢাকার ক্ষেত্রেও সত্যি। কিন্তু আমরা যদি ঢাকার পানি ব্যবস্থাপনা এবং নগর পরিকল্পনা দেখি আমরা দেখব জলাভূমি অনেক কমে গেছে, অনেক জায়গায় নদী দখল হয়ে গেছে। খোলা জায়গার পরিমানও কমে যাচ্ছে। এখন জলবায়ু পরিবর্তন এবং আবহাওয়ার বিষয়টিকে আমরা যদি স্থানীয় পর্যায়ে বিবেচনা করি তাহলে আমরা এখন কোনদিকে যাচ্ছি? আমাদের করণীয়ইবা কী?
সালিমুল হক: আমার মনে হয় এই ক্ষেত্রে আমাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে যে জলবায়ুর সাথে আবহাওয়ার অবস্থাকে যেন গুলিয়ে না ফেলি। আবহাওয়া একটা স্বল্পকালীন পরিবর্তনের বিষয়, আর জলবায়ু হছে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের বিষয়। আরেকটা হচ্ছে আবহাওয়ার সাথে বৃহত্তর পরিবেশের বিষয়কে গুলিয়ে না ফেলা। আমার মনে হয় ঢাকাতে আমরা যে সমস্যা দেখছি সেটা একটা বৃহত্তর পরিবেশগত বিষয়। আমরা ভূ-পৃষ্ঠকে কনক্রিট দিয়ে ঢেকে ফেলছি, আমরা ভূগর্ভস্থ পানিকে উঠিয়ে নিচ্ছি। এগুলো জলবায়ুর বিষয় নয়। এগুলো পরিবেশের বিষয়। ঢাকাকে আমরা একটি দুষিত শহরের পরিনত করছি। প্রায়ই ঢাকা সবচাইতে দুষিত শহরদের মধ্যে এক নম্বরে উঠে আসে। এগুলো হচ্ছে পরিবেশগত বিষয়। আমরা গাছ কেটে ফেলছি। জলাভূমিগুলো সব ভরাট করে ফেলছি। এখানে আমরা পরিবেশগত নিয়ামকের একটা দীর্ঘ তালিকা পাই। এগুলো হচ্ছে খারাপ পরিবেশগত চর্চার উদাহরণ। আমার মতে এর মাধ্যমে আমরা শহরটাকে ধ্বংস করে ফেলছি। আমি মনে করি এগুলোর দিকে আমাদের আরো বেশি নজর দিতে হবে, সুরক্ষা দিতে হবে, সচেতনতা বাড়াতে হবে। আরেকটি হচ্ছে দুষণ। আমরা দুষিত করে দেশের নদী-নালাগুলোকে একাকার করে ফেলছি। বিশেষ করে আমি বলব যে ঢাকা শহরের ব্যপারে আমাদের এখন সতর্ক থাকতে হবে। এখন ঢাকা শহরকে পূর্ব দিকে বর্ধিত করার যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেখানে আমাদের একটা সুযোগ রয়েছে আমাদের পূর্ববর্তি ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেয়ার এবং সেগুলোর পুনরাবৃত্তি না করা। কিন্তু আমার আশংকা হচ্ছে আমরা আমাদের ভুলগুলোরই পুনরাবৃত্তি করব। যদিও খুটিয়ে খুটিয়ে এটাকে দেখিনি, কিন্তু মাস্টারপ্ল্যান যেটা করা হয়েছে, আমার মনে হয়েছে সেটাও এই বিষয়টিকে আমলে নেয় নি। এমনকি একটা মাস্টারপ্ল্যান থাকলেও বর্তমানের ঢাকায় সেটা আসলে কোন অর্থ বহন করে না। এসব পরিকল্পনার নির্দেশনা মেনে চলা হয় না। ফলে কেবল পরিকল্পনার চেয়ের বেশি কিছু আমাদের প্রয়োজন। কীভাবে আমরা পূর্ব ঢাকাকে বা ঢাকার নতুন অংশকে পরিবেশ বান্ধব উপায়ে নির্মান করতে পারব সেটা একটা চ্যালেঞ্জ। আমি বলব আপনি এটা নিয়ে ভাবুন। আপনার জন্য অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং গবেষণার বিষয় হতে পারে কীভাবে আমরা আমাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিব। শুধুমাত্র পুরোনো সম্যসাগুলোকে বিশ্লেষণ করাটাই যথেষ্ট নয়। ঢাকা শহরকে পূর্বদিকে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে পুরোনো ভুল থেকে শিক্ষা নেয়া এবং সেই ভুলগুলো না করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা শহর এখন দ্রুত বাড়ছে। ঢাকা শহরের পূর্ব দিকে প্রসার ঘটবে এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জলাভূমিগুলোও দখল হয়ে যাবে। পুরো শহর পূর্বদিকে বাড়বে এবং সরতে থাকবে। কিন্তু এটা হয়ত হবে খুবই এলোমেলো এবং পরিবেশ বৈরি উপায়ে। এর মধ্যেই আমরা এর কিছু লক্ষণ দেখতে শুরু করেছি। এই ব্যপারে আমাদের কি কিছু করার আছে? নাকি অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে? আমরা কি এখানে কোন পরিবর্তন আনতে পারি। আমরা কি সেখানে পরিবেশের সুরক্ষার জন্য কোন পরামর্শ দিতে পারি? দশ বছর পর আপনাকে যেন আরেকটি গবেষণা করতে না হয়, কেন পূর্ব ঢাকায় সব কিছু ভুল ভাবে হচ্ছে। আমরাত জানি কী ভুল হচ্ছে। ফলে সমস্যাগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ না করে আমাদের দেখা দরকার আমরা কীভাবে ভুলগুলো বারবার করা থেকে বিরত থাকব। পরিকল্পনা করাই এই জন্যে যথেষ্ট নয়। পরিকল্পপনা এক টুকরো কাগজ মাত্র। আমরা দেখেছি এটা কাজ করে নি। এটাত একটি ধাপমাত্র। আমাদেরকে পরিকল্পনার পরের ধাপগুলোকে নিয়েও ভাবতে হবে। পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, আর্থিক প্রণোদনা দেয়া বা নিরুৎসাহিত করা, নজরদারি, সচেতনতা সৃষ্টি করা এরকম সকল উপাদান নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। পূর্ব ঢাকা নির্মান হবার সময়ে আমরা এই পরিস্থিতির উন্নয়ন কীভাবে করব? এখানে কি পশ্চিম ঢাকার ভুলগুলোই আবার করা হবে? এই ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পক্রিয়াতে ভূমিকা রাখতে হবে, প্রভাব বিস্তার করতে হবে।
আমাদের চিন্তা করতে হবে, গবেষণা করতে হবে তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একজন পরিকল্পনাবিদ কাগজে একে দিল যে এটা করতে হবে, সেটা অপ্রাসঙ্গিক। পরামর্শ দিয়ে দিলাম এভাবে করেন তাহলে সব ঠিক হবে-এভাবে এগুলো হয় না। এই প্রক্রিয়া খুব অগোছালো, এর মধ্যেই প্রভাব বিস্তার করতে হবে। এটাতে অগোছালো পক্রিয়াতে গবেষণা, জ্ঞান এবং প্রামান্য বিষয়ের প্রভাব কীভাবে পরবে সেটাও দেখতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াতেও অংশ নিতে হবে। শুধু গবেষণা করে বলে দিলাম সেটা খুবই অকার্যকর, প্রাচীন এবং গবেষণার উদ্দেশ্যেরও বিপরীত। আমি গবেষণা করে বলতে দিয়েছি কী করতে হবে, এখন অন্য কেউ সেটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিবে এটা বাস্তব জগতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাস্তব জগতে আপনাকে গিয়ে ওদের সাথে কথা বলতে হবে, ওদের কাজে সংশ্লিষ্ট হতে হবে। তারা শুনছেনা কেন এটা জানতে হবে। আমরা যদি এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত না হই, আমরা শুধু আমাদের গবেষণা করলাম। তাহলে আপনি যেটা এখন করছেন, ঢাকা শহরের সমস্যাটাকে আপনি বিশ্লেষণ করছেন। আপনি তথ্য উপাত্ত জোগাড় করে একটা নিবন্ধ লিখলেন সেটা প্রকাশ করলেন এটার প্রভাব কিন্তু কিছু থাকবে না। শুধু গবেষণার করার খাতিরে গবেষণা করা, শুধুমাত্র একটা নিবন্ধ প্রকাশ করা- এটা কিন্তু সনাতন পদ্ধতি এবং আমার মতে অকার্যকর কৌশল। আপনি যদি ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য না করেন তাহলে সেটা অর্থপূর্ণ নয়। এর জন্য যে ভাল মানের গবেষণা করতে হবে না তা কিন্তু আমি বলছি না। এই গবেষণার ফলাফল হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে। এই গবেষণার সুফল এবং অর্জিত জ্ঞান এই নীতিপ্রক্রিয়াতে কাজে লাগাতে হবে। সেই প্রক্রিয়াটি সম্পর্কেও আপনাকে জানতে হবে। আর সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াতে আপনাকে অংশ নিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণাও কিন্তু এই রকম। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বিরাট বৈশ্বিক সমস্যা। আমাদের মধ্যে যারা গবেষণা করছেন তারা তথ্য উপাত্ত এবং প্রমানাদি সংগ্রহ করছেন এই বিরাট বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে সিদ্ধান্তগ্রহণকে প্রভাবিত করার জন্য। আমরা নিবন্ধ প্রকাশ করার জন্য এই গবেষণাগুলো করছি না। স্থানীয়, জাতিয় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে আমরা এটা করছি।
রিয়াজ উদ্দীন: এটা একটা অনুতাপের বিষয় যে আমরা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে গবেষণাগুলো করছি সেগুলো সেই পরিশ্রমগুলো জনমত সৃষ্টিতে তেমন একটা ভূমিকা রাখে না। পন্ডিতজনরা নিজেদের মধ্যে একটা আলোচনা করেন, পরস্পরের কাজের খোজ রাখেন। এরকম একটা ব্যবস্থায় গবেষনা কী কী কাজে লাগবে সেই প্রশ্নের কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না। এর আগে আপনার তত্ত্বাবধানে গবেষণা সিক্স কনফারেন্স হয়েছিল। সেখানে আপনি জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় উদ্যোগমুখি গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়েছেন বলে জেনেছি। আপনার এখনকার বক্তব্যেও সেটার প্রতিফলন পেলাম। এই ক্ষেত্রে মিথষ্ক্রিয়াটা আমার মনে হয় দ্বিমুখী। গবেষণার প্রকল্প নির্বাচনেও আমাদের বাস্তব সমস্যাকে বিবেচনায় রাখতে হবে, অন্যদিকে গবেষণার ফলাফল যেন নীতিনির্ধারনের রসদ হয় সেটাও দেখতে হবে। আমার গবেষণার যে মূল প্রশ্ন, নগরায়ন কীভাবে ভূগর্ভস্থ পানিকে প্রভাবিত করে এই বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
সালিমুল হক: এই বিষয়ে আমার দিক থেকে নগরায়ন এবং ভূগর্ভস্থ পানির মধ্যে বিশদ সম্পর্ক নিয়ে বলা কঠিন। কিন্তু একজন লেম্যানের জায়গা থেকে যদি বলি, তাহলে আমি বলব ভূপৃষ্ঠকে কংক্রিট দিয়ে ঢেকে ফেলা একটা বড় ব্যপার। ভূপৃষ্ঠকে আমরা এমন ভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি যে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করতে পারছে না। আবার ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলনও হচ্ছে অনেক দ্রুত গতিতে। একদিকে আমরা ভূগর্ভস্থ পানিকে নিঃশেষ করে দিচ্ছি অন্যদিকে আমরা কমে যাওয়া ঘাটতিটা পুরণ হতে দিচ্ছি না। এর চাইতে বেশি আর কী কী হচ্ছে সেটার জন্য আরো স্পেসিফিক হতে হবে যেটা এক্সপার্টরা বলতে পারবে।
রিয়াজ উদ্দীন: আপনি যা বললেন সেটাই মূল বিষয়। এছাড়া স্পেসিফিক ভাবে দেখলে নগরায়নের ফলে শহরাঞ্চলে মানুষের ঘনত্ত্ব যেমন বাড়ে তেমনি শিল্পকারখানার ঘনত্বও বাড়ে। বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকায় তৈরি পোশাক শিল্পের ঘনত্ব বেশি। শিল্পোৎপাদনে পানির ব্যবহার সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেলো, ঢাকাবাসিদের পানির চাহিদা পুরন করতে যে পরিমান ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করতে হয়, বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পের জন্যেও প্রায় সমপরিমান পানি উত্তোলন করতে হয়।
সালিমুল হক: আপনি যে বিষয়টা উল্লেখ করলেন সেটা আমাকে চিন্তার খোরাক দিল। আমি এটা আগে চিন্তা করিনি। তৈরি পোশাক শিল্পের অনেক পানি লাগছে এটা একটা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার পিছনে একটা বড় কারণ হতে পারে। এটা ঠিক হতে পারে, আমার কাছে এটাকে যৌক্তিক মনে হচ্ছে, যদিও আমি নিশ্চিত জানিনা, যেহেতু আমার কারিগরি জ্ঞানের ক্ষেত্রটি ভিন্ন।
রিয়াজ উদ্দীন: পৃথিবীর বানিজ্য ব্যবস্থায় বাংলাদেশের এখন যে অবস্থান সেখানে সস্তা শ্রম একটা বড় নিয়ামক হিসাবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এখানে পানির বিবেচনাটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন পানির ডিসকোর্সে আমরা “ভার্চুয়াল ওয়াটার”-এর ধারনাটি আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভেতর বানিজ্য সম্পর্কের সুবাদে এক জায়গায় উৎপাদিত পণ্য অন্য জায়গায় কাজে লাগছে। ফলে যারা পানি সংকটে আছে তারা কম পানি লাগে এমন উৎপাদন ব্যবস্থায় যায় আর যাদের পানি বেশি তারা পানি বেশি লাগে এমন উৎপাদন ব্যবস্থাকে কাজে লাগায়। এভাবে বৈশ্বিক পর্যায়ে পানির ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করে। কিন্তু আমাদের এখানে তৈরি পোশাক শিল্প যেহেতু পানির উপর অনেকটা নির্ভর করে এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা দরকার। এখন নাম্বারসগুলো আমাদের সামনে আসছে যেগুলো আমাদেরকে ভাবাচ্ছে। ফলে এই উৎপাদন পক্রিয়াকে আমরা কীভাবে টেকসই রাখব? আমাদের অর্থনীতির ভিত এখন তৈরি পোশাক শিল্পের উপর অনেকটাই দাঁড়িয়ে। এখন পরের প্রশ্নে যাই। আমাদের এখানে শহরের পানি ব্যবস্থাপনায় একটা দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে বৃষ্টির পানিকে একটা পাইপ নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে সরাসরি নদীতে নিয়ে ফেলাকে ব্যবস্থাপনার সাফল্য হিসাবে দেখা হয়। এর ফলে নগর এলাকায় পানির বিভিন্ন রকমের ব্যবহার যেমন জলাভুমি, পার্ক, গাছপালা এগুলোর জন্য পানিকে কাজে লাগানোর সুযোগ কম। কিন্তু আমরা যদি বেস্ট প্র্যাকটিসগুলোকে দেখি আমরা দেখব আরবান ডিজাইনে বৃষ্টির পানিকে বিভিন্নভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়। আপনি যেহেতু পৃথিবীর অনেক শহর দেখেছেন, তাদের পানি ব্যবস্থাপনার সাথেও হয়ত পরিচিত আছেন, বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনাকে আপনি তার সাথে কীভাবে তুলনা করবেন?
সালিমুল হক: এটা নিয়ে কমেন্ট করার মত বিশেষজ্ঞ জ্ঞান আমার আছে বলে মনে করি না। তবে পৃথিবীর যে কোন দেশের সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশে যে কোন দেশের মতই ভাল বা খারাপ। আমাদের এখানে যে চিন্তা করা হয় না তা না। আমাদের এখানেও চিন্তা করা হয়। সবকিছু আমরা সঠিক ভাবে করি না। আমি মনে করি আমরা পরিকল্পনার দিক থেকে খারাপ না। আমাদের শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন আছে, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করি, আমরা বদ্বীপ পরিকল্পনা করেছি। প্ল্যানিং করতে আমরা ওস্তাদ। আমরা খুব ভাল প্ল্যানিং করি, কিন্তু পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নে আমরা খুব দুর্বল। সেটা আমরা ঠিক মত করিনা। যেটা আগে বললাম কাগজে কলমে সবকিছু ঠিক আছে, কিন্তু বাস্তবে ওগুলো ঠিক নেই। কাজেই ভাল পরিকল্পনা করায় আমাদের চ্যালেঞ্জ যতটা না, তার চাইতে যা পরিকল্পনাই আছে সেটা বাস্তবায়ন করাটাই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। বাস্তবায়নে আমাদের অনেকরকম দুর্বলতা রয়েছে। যার অনেকটা পলিটিকাল, অনেকটা সামাজিক। এগুলো নিইয়ে আমাদের চিন্তা করা প্রয়োজন। আমার কাছে সেটাই গবেষণার প্রশ্ন। কীভাবে আমরা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে পারব। ধরে নিচ্ছি আমাদের পরিকল্পনার মান ভাল। কিন্তু কীভাবে আমরা নিশিচত করব আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে এবং এগুলোকে কেউ লঙ্ঘন করবে না। আমরা সব খানে এগুলো লঙ্ঘনের উদাহরণ দেখি। পরিবেশ বিপর্যয়ও মূলত পরিকল্পনার লংঘনের উদাহরণ।
রিয়াজ উদ্দীন: নগরের দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা (urban resilience) নিয়ে বাংলাদেশে বা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনেক আলোচনা হয়েছে। এখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমনের যে রূপ আমরা দেখলাম তাতে করে, আমাদের ব্যবস্থাপনাতো সেরকম সন্তোষজনক হচ্ছে না। তাহলে আমরা কি বলব যে আমাদের দুর্যোগ সহ্য করার সক্ষমতা নেই? তাহলে রেসিলিয়েন্সের ধারনাতে আমাদের ভুল কোথায় ছিল? তাহলে নগরের দুর্যোগ সহনশীলতার ধারনা টিকে কি আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে? আমাদের ভুলটা কোথায় হয়েছে?
সালিমুল হক: খুব ভাল প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি নিয়ে আমরাও হিমশিম খাচ্ছি। কাজেই আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাব আমাদের গ্রুপের সাথে এটা নিয়ে আরো অনুসন্ধান করতে। রেজিলিয়েন্স খুব জটিল একটি ধারনা। এর একটি নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের রেজিলিয়েন্স হতে পারে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে রেসিলিয়েন্স বলতে কী বুঝি সেটা আমরা নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করছি। সেই প্রেক্ষিতে কোভিড ১৯ রেজিলিয়েন্সের চ্যালেঞ্জের আরেকটি উদাহরণ হয়ে দাড়াচ্ছে, যাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। রেজিলিয়েন্স গড়ে তোলা এবং সেটাকে আরো উন্নত করার মূল উপায় হল ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, একই ভুল বার বার না করা। আপনি ভুল করবেন না এমনটা নয়, সবাই ভুল করে। কিন্তু আপনি যদি ভুল থেকে শিক্ষা নেন এবং একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে পারেন তাহলে বুঝতে হবে আপনি রেজিলিয়েন্সের পথে আগাচ্ছেন। আর যদি আপনি একই ভুল বারবার করেন তাহলে আপনি রেজিলিয়েন্সের উল্টো দিকে যাচ্ছেন। সেটাই গবেষণার বিষয়। আমরা কী ভুল থেকে শিখতে সক্ষম? এমন নয় যে আমরা ভুল করবনা। একেবারে ভুল না করা অসম্ভব। আপনি কিছু একটা করার চেষ্টা করছেন। এর কিছু কাজ করবে আর কিছু কাজ করবে না। যেটা কাজ করবে সেটাকে বারবার বার করা এবং তার পরিধি বাড়ানো আর যেটা কাজ করবে না সেটা আবার না করা, ভুল থেকে শিক্ষা নেয়া বলতে আমরা এটাই বুঝি। কিন্তু এটা আমরা করছি না।
রিয়াজ উদ্দীন: এখানে ভাবার বিষয় হল নগরের দুর্যোগ সহনশীলতার উপর পরবর্তি বড় আঘাতটা কী আসবে? রোগতত্ত্ব নিয়ে যারা কাজ করছিলেন তারা বলছিলেন যে নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে। কিন্তু এই বিষয়ে আমাদের প্রস্তুতি ছিল না। এখন কোভিড ১৯ আমাদের মনে করিয়ে দিল যে আমরা হয়ত আমাদের শহরের উপর পরবর্তি যে আঘাতটি আসছে সেটা সম্পর্কে জানিনা। সেক্ষেত্রে পানি ব্যবস্থাপনার দিক থেকে আমরা দেখি যে একটি দুর্যোগ কিন্তু পানি বিষয়ক হতে পারে। শিল্প বিপ্লবের পর যে অভুত পূর্ব দ্রুতগতিতে নগরায়ন হচ্ছে, তার অর্থ হল শহরে বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে মানুষের জনঘনত্ব বাড়তেই থাকবে। একটা পর্যায়ে এরকম হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে পানির সংকট তীব্র আকার ধারন করবে। এর মধ্যেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পানি ব্যবস্থাপনা বেশ চ্যালেঞ্জিং, দূর থেকে পানি এনে সেখানে পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে ঢাকা কতটা ঝুকিতে আছে বলে আপনি মনে করেন?
সালিমুল হক: এটা অবশ্য আমার জ্ঞানের ক্ষেত্র নয়। কিন্তু ঢাকার এর মধ্যেই ঝুকিতে আছে। পানি আমাদেরকে মেঘনা থেকে টেনে আনার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির উপর কতদিন নির্ভর করত পারব জানা নেই। ঢাকা শহর বড় সংকটের মুখে। অন্য শহরগুলোর জন্যে পানি সরবরাহ একটা বড় সমস্যা। ছোট-বড় নির্বিশেষে সব ধরনের শহরের জন্যেই এটা এখন একটা বড় বিষয় হয়ে দাড়াচ্ছে। শুধুই যে বাংলাদেশে তা নয়, সব জায়গাতেই। কাজেই পানি, নগরের দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা,নগর উন্নয়ন এবং নগর পরিকল্পনা বরাবরই হাত ধরাধরি করে চলে। বাংলাদেশের জন্যে এটা একটা চ্যালেঞ্জ হবে, যদিও আমরা একটি পানি কেন্দ্রিক দেশ। এখানে কখনো কখনো পর্যাপ্ত পানি থাকে আবার কখনো পানি কম থাকে। কাজেই এই দুইয়ের মধ্যে আমাদের ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়।
রিয়াজ উদ্দীন: আমরা যদি প্রশ্ন করি আমাদের পানির প্রধান উৎস্যগুলো কি তাহলা আমরা তিনটি উৎস্য পাই। ভূগর্ভস্থ পানির উপরতো এখন আমরা অনেকটাই নির্ভর করছি। আরেকটা সারফেস ওয়াটার যেটা আপনি বললেন একটু দূর থেকে আনা হচ্ছে। আর তৃতীয়টি হচ্ছে বৃষ্টির পানি। কিন্তু এই পানিকে আমরা মূলত একটি পাইপড নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মূলত নদী বা সাগরে ফেলে দিচ্ছি। তবে ওয়াসার পরিকল্পনা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির পাশাপাশি একটু করে নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানো। কিন্তু বৃষ্টির পানির ব্যবহার নিয়ে আমরা তেমন চেষ্টা দেখি না। এ নিয়ে প্রকৌশলিদের সাথে কথা বলে যেটা বুঝলাম, বৃষ্টির পানি ব্যবহারে সাধারণ মানুষ তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না, সে কারণে এটাকে নিয়ে তাদের উৎসাহ সীমিত। এই যে পানির তৃতীয় আরেকটি তৃতীয় উৎস্য আছে এটাকে ব্যবহারের ব্যপারে আমরা কী করতে পারি। আপনি যেমন বলছিলেন পানির সাথে রাজনৈতিক এবং সামাজিক দিক রয়েছে। এই দিকগুলোকে একত্রে নিয়ে তিনটি উৎস্যকে সমন্বয় করে আমরা কীভাবে আগাতে পারি?
সালিমুল হক: আমি মনে করি এই ক্ষেত্রে আমাদের একটু এগিয়ে যাওয়া উচিত, অনুসন্ধান করা উচিত। এটা পাইলট প্রজেক্ট আকারে নিয়ে এরপর মানুষ সেটাকে পছন্দ করলে তার পরিধি বাড়িয়ে নেয়া যেতে পারে। এটা কার্যকারিতা, উপযোগিতা এবং উপকারি দিকগুলো মানুষের সামনে ডেমন্সট্রেট করতে হবে। এগুলো আমরা করতে পারি তাহলে লোকে করবে, করবে না কেন? এখন হয়ত প্রবনতা নাই কারণ জানেনে কী হবে না হবে। যেকোন নতুন জিনিসের কথা বললেই একধরনের বাধা আসে। কিন্তু যদি ডেমন্সট্রেট করে দেখাতে পারি তাহলে হবে না কেন? আদতে বাংলদেশে কিন্তু বৃষ্টির পানির ব্যবহার এর মধ্যেই প্রচুর হচ্ছে। আপনি যদি উপকূলীয় এলাকায় যান, যেখানে লবনাক্ত পানি ছাড়া উপায় নেই, সেখানে কেউ আপনাকে বৃষ্টির পানি ব্যবহার সম্পর্কে নেতিবাচক মতামত দেবে না। ওখানে প্রায় প্রতিটি ছাদেই তারা রেইনওয়াটার হার্ভেস্ট করে দুইতিন মাসের খাবার পানি ট্যাঙ্কে ভরে রেখে দেয়। নাহতে তারা খাবার পানি পাবে কোথায়? গরজ সৃষ্টি হলে তারা সবাই করবে, ঢাকা শহরে হয়ত তারা করতে চাচ্ছে না।
রিয়াজ উদ্দীন: আমরা যদি ঢাকায় বিদ্যমান পানি নিয়ে আলোচনার ধরনটাকে বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা দেখবে পানি নিরাপত্তাকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে যেখানে আমরা কল ছাড়লে পানি পাচ্ছি কিনা সেটুকুর মধ্যেই আমাদের পানি সংক্রান্ত চিন্তাভবনা আবর্তিত হয়। কিন্তু অনেক জায়গাতেই আরো বৃহত্তর পরিসরে পানি নিরাপত্তাকে চিন্তা করা হয়। পানির যে মৌলিক প্রয়োজনের বাইরেওত পানির অনেক ধরনের ব্যবহার আছে। এইযে একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি (holistic approach) আমরা এখানে দেখিনা। আর আপনি যেমন বললেন সংকটে পরলে মানুষ বাধ্য হচ্ছে অন্যান্য অপশন খুজে নিতে, যেমন আপনি উপকুলীয় অঞ্চলে বৃষ্টির পানি ব্যবহারের উদাহরণ দিলেন। অন্যদিকে কিছু সংকটকে আমরা চোখের বাইরে রাখছি। ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে আমরা চোখে দেখছি না ফলে শতকরা নব্বই জনের বেশী হয়ত জানেই না এরকম একটা সংকট আছে। এই যে আমরা আমাদের নিরাপত্তা বা ভবিষ্যতকে দেখি একটা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে অথবা সংকটে না পরলে আমরা নড়েচড়ে বসি না এটার সমাধান কীভাবে হবে?
সালিমুল হক: এট করা সম্ভব। এটার জন্য শিক্ষা লাগে, জানতে হয়, সচেতনতা সৃষ্টি করতে হয়। সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হয়, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন করতে হয়। বাংলাদেশকে নিয়ে আমি আশাবাদি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টাই যদি আমরা দেখি, এটা পৃথিবীর সব দেশের সমস্যা। এটা একটা বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশে আমি মনে করি এটার নিয়ে সচেতনতা অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে এটাকে কেউ অস্বিকার করে না। সবাই স্বিকার করে। সবাই বলে যে এটা নিয়ে কিছু করা উচিত। এমনকি আপনি যেটা একটু আগে বললেন যে আমাদের একটু ভুল ধারনা হয়ে গেছে যে সব কিছুই ক্লাইমেট চেঞ্জ। একটু বৃষ্টি পরলে আমরা ক্লাইমেট চেঞ্জকে দোষ দেই। আমি বলি যে আমাদের সচেতনতার পর্যায়টা একটু বেশি হয়ে গেছে। তবে সেটা বড় কথা নয়। আমাদের সচেতনতার পর্যায় অনেক বেশি। সে কারণে আমরা দেখি বাংলাদেশের সরকার এটাকে অনেক গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। আমাদের এখানে ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি এন্ড একশান প্ল্যান নেয়া হয়েছে। আমাদের জাতিয় পরিকল্পনায় তারা জলবায়ু পরিবর্তনকে সমন্বিত করার চেষ্টা করছে। কাজেই আমি বলব যে সচেতনতা সৃষ্টি করা খুবই সম্ভব যদি আমরা সিস্টেমেটিক ভাবে চেষ্টা করি। তারপর সচেতনতা থেকে আমাদের কাজে যেতে হবে। সমস্যা সমাধানে সবচাইতে নির্ভরযোগ্য রাস্তা হচ্ছে করে দেখানো বা ডেমনস্ট্রেশান। আমরা যদি দেখাতে পারি যে এটার সমাধান আছে “এখানে করলাম, সমাধান হয়ে গেলো”। “তৈরি পোশাক শিল্প কম পানি দিয়ে চালাতেও পারে, মুনাফা করতে পারে”। তাহলে অন্যরা করবে না কেনো? তখন আমরা ঐটাকে রেপ্লিকেট করতে পারি, স্কেল আপ করতে পারি। শুধু উপদেশ দিলে হবে না। উপদেশ এবং করে দেখানো। এটা যদি করা যায় তাহলে অভ্যাস পরিবর্তন হবে। অভ্যাসতো অপরিবর্তনীয় নয়। এটাতে সময় লাগে চেষ্টা করতে হয়।
রিয়াজ উদ্দীন: যদিও এটা আমার প্রশ্নের তালিকায় ছিল না। কিন্তু প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ বলে করছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের পানির স্তর উপরে উঠতে থাকবে। আবার অন্যদিকে বাংলাদেশে পলি জমার কারণে নতুন স্থলভাগ বাড়ছে। গত ত্রিশ বছরে কি হয়েছে আমরা যদি দেখি তাহলে জানা যায় নতুন ভূমি আমরা পাচ্ছি। এখন এই দুই প্রক্রিয়ার মধ্যে যে ভারসাম্য সেটাকে আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কীভাবে আমলে নিতে পারি?
সালিমুল হক: এটা একটা খুব জটিল ব্যপার। এটা ভূমিরূপ পরিবর্তনের (geomorphological) সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়। আর বাড়তি পলি জমা এবং সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ব্যপারটি জায়গাভেদে পরিবর্তিত হয়। আমাদের উপকূল কিন্তু সব জায়গায় এক রকম নয়। পলি জমা হওয়া এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির যে সম্পর্ক সেটা স্থানভেবে অনেকটা আলাদা। এই উপকূলটি কিন্তু স্থানভেদে অভিন্ন নয়। আমরা যদি গঙ্গা অববাহিকা (ganges basin) দেখি, যেদিকটাই সুন্দরবন, তাহলে লক্ষ্য করব ঐদিকটাতে কিন্তু পলি আসছে না। পলি আসছে মেঘনা এবং ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা, যেটা অন্য একটা এলাকাতে। কাজেই যদি ভারসাম্যটা বুঝেতে হয় তাহলে জায়গাভেদে আলাদা করে কিন্তু আপয়নাকে বিশদ গবেষণা করতে হবে। আমরা যদি হাইড্রলজিকাল সিস্টেমের নেট ব্যালেন্সের দিকে দেখি তাহলে কী হবে? ধরা যাক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মোট বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমান অপরিবর্তিত থাকবে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই বৃষ্টিপাতের প্যাটার্নটা পালটে যাবে। বর্ষাকালের বৃষ্টিপাত বেড়ে যাবে আর শুষ্ক মৌসুমের বৃষ্টিপাত কমে যাবে। ফলে যেটা হবে আমাদের বন্যাও হবে আগের চাইতে তীব্র, খরাও হবে তীব্র, যদিও মোট পরিমানের কিন্তু পরিবর্তন হয়নি। কাজেই কখন হচ্ছে কোথায় হচ্ছে, প্যাটার্নটা দেখতে হবে যেটার জন্য অনেক বিশদ গবেষণা দরকার হবে। মূলত আমেরিকার ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটিতে একটি বড় টিম আছে যারা গঙ্গা অববাহিকার জিও মরফলজিকাল পরিবর্তন নিয়ে অনেকদিন ধরে কাজ করছে। তারা খুব ইন্টারেস্টিং একটা গবেষণা করেছে যেটা আপনার দেখা উচিত। এগুলো খুবই ভাল এবং বিজ্ঞানমুখী প্রশ্ন যেগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার এবং উপাত্ত সংগ্রহিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আগে যেমন বলেছি, শুধু উপাত্ত সংগ্রহ করাটাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। এগুলোকে আমাদের কর্মকান্ড, পরিকল্পনা, অবকাঠামোর নকশা, বিনিয়োগ ইত্যাদির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। কাজেই গবেষনা যেন সিদ্ধান্ত গ্রহণে যেন কাজে লাগে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আর এই ক্ষেত্রে যারা মূল নীতি নির্ধারনে যারা আছেন তাদের মনযোগ আকর্ষণ করতে হবে।