ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে মামলা রুজু করার ঘটনাবলিকে যারা এতদিন অত্যুৎসাহী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বতঃপ্রণোদিত কার্যক্রম কিংবা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আনুকূল্য প্রত্যাশীদের বাড়াবাড়ি বলে বর্ণনা করেছিলেন আশা করি এখন তাঁদের ভিন্ন উপলব্ধি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার মামলার বিষয়ে তার অবস্থান সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি ইঙ্গিত দেন যে জনাব আনাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে স্থায়ী করার ষড়যন্ত্রের যুক্ত ছিলেন; বলেন যে, “আর যদি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন তাহলে ষড়যন্ত্রকারীদের যারা জড়িত, গণতন্ত্র হত্যা করে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টা করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের যেমন বিচার হচ্ছে ঠিক সেইভাবে এদের একদিন সংবিধান ধ্বংস করার দায়ে বিচার করা হবে।” তিনি তার দলের নেতাদের ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মুখ খোলার জন্যেও উৎসাহিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ এবং সুস্পষ্ট বক্তব্যের প্রেক্ষিতে যাদের ভিন্ন উপলব্ধি হচ্ছে তাঁরা তা স্বীকার করতে আগ্রহী হবেন আমি তা মনে করিনা। বাংলাদেশে সম্ভবত আগামি কয়েক দশকে আত্মোপলব্ধি এবং ভুল স্বীকারের কোনো রকম ঘটনা আর ঘটবেনা। কেননা ৪ ফেব্রুয়ারি টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে মাহফুজ আনাম যদি এ কথা স্বীকার না করতেন যে ২০০৭-০৮ সালে সেনা-সমর্থিত সরকারের আমলে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই –এর সরবরাহ করা সংবাদ প্রকাশ করে ভুল করেছেন তবে তাঁকে আপাতত এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হতো না। এই পরিস্থিতি বলতে আমি কি বোঝাচ্ছি তা পাঠকদের জানা আছে। তার বিরুদ্ধে মামলা এখন প্রায় একশোর কাছাকাছি, যেগুলোর আইনি ভিত্তি নিয়ে আইনজীবীরা প্রশ্ন তুলেছেন।
মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে এই দফা আক্রমণের সূচনা স্থানীয় পর্যায়ে হয়নি, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও তার উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়ের আহবানে সাড়া দিয়েই দলের কর্মিরা এই মামলাগুলোর সূচনা করেছে, ফলে এর প্রতি প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন সকলের বোধগম্য ছিলো, যদিও অনেকেই এই বিষয়টি উল্লেখ করেন নি। মাহফুজ আনাম এই প্রথম ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্ততে পরিণত হয়েছেন তা নয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি ছবিকে কেন্দ্র করে সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রধান বার্তা সম্পাদক এবং প্রধান চিত্রগ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল এবং সংসদে তীব্র ভাষায় জনাব আনামের সমালোচনা করা হয়েছিলো। এই দফায় আক্রমণের শুরুতে দলের আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ইউনুসের উপস্থিতিকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ফলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় যখন অধ্যাপক ইউনুসের প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয় তখন আর এটা নিয়ে জল্পনা কল্পনার দরকার হয় না এটি ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান।
গত কয়েক সপ্তাহে সরকারী দলের সমর্থকরা যখন ২০০৭-৮ সালের সরকারের গৃহিত পদক্ষেপসমূহের দায় মাহফুজ আনামের ওপরে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন তখন তা তাঁদের নিজস্ব ব্যাখ্যা বলে মনে করার কারন ছিলো, কিন্ত এখন প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই দায় চাপিয়েছেন; ফলে আমরা প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছি। শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে যাবার আগে বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব কাজের বৈধতা দেবে। ঐ সময়ে ফখরুদ্দিন আহমদের সরকারের ৯০ দিন পার হয়েছে এবং এই প্রশ্ন উঠছিলো যে ঐ সরকার সংবিধানের বিধানের অতিরিক্ত সময় ক্ষমতায় থাকছে কিনা; শুধু তাই নয় আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ২০০৮ সালের ১৯ অক্টোবরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে একই কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ১১ মাসের নির্জন কারাবাসের কথা বলেছেন; যে কোনো নাগরিকের প্রতি এই আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত, বিশেষ করে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তো বটেই। কিন্ত সেই সময়ে তার দলের সাধারন সম্পাদক ঐ সরকারের এই রকম অমানবিক আচরণের বিষয়ে প্রতিবাদ করার তাগিদ অনুভব করেন নি কেন সেটা আমাদের বিস্মিত করে।
প্রধানমন্ত্রী মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে যাই বলুন না কেন, তাঁদের বক্তব্যে একটি বিষয়ে ঐকমত্য সহজে দৃষ্ট — সেই সময়ে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা সাংবাদিকতায় এবং রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। প্রধানমন্ত্রী ব্লেছেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা এমন আচরণ করেছে যেন তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে, তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষনের কোনো কারন নেই। কিন্ত ওই সংস্থার আচরণের জন্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ওই সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে গণমাধ্যমে কোনো খবর পাওয়া যায়নি। একই বিবেচনায় ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোতে সংবাদ প্রকাশ যদি সেই সময়কার পরিস্থিতির কারণ হয়ে থাকে অন্য সংবাদ মাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে কি এই বক্তব্য একইভাবে কার্যকর? গত কয়েক সপ্তাহে যারা এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন তাঁরা এও উল্লেখ করেছেন যে যাদের জবানবন্দি এই সব তথ্যের উৎস, যারা সেই সময়ে কথিত মাইনাস-টু’র অংশ হিসেবে দলের ভেতরেই সক্রিয় ছিলেন তাঁদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বা ক্ষমতাসীন দলের কোন বক্তব্য নেই।
এই সব প্রশ্নের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দল অবগত নয় এমন ভাববার কোনো কারন নেই। এও মনে করার কারন নেই যে এগুলোর যুক্তিগ্রাহ্য কোনো উত্তর পাওয়া যাবে। তা হলে প্রশ্ন হল ক্ষমতাসীন দল কেন মনে করছে যে এই দুই সংবাদপত্র এবং সম্পাদকের বিরুদ্ধে তাঁদের এখন আক্রমণোদ্যত হওয়া দরকার? এই প্রশ্নের উত্তর কেবল ২০০৭-৮ সালে কে কি ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করলে পাওয়া যাবে না। খুঁজতে হবে বিরাজমান রাজনৈতিক অবস্থার ওপরে। ২০০৭-৮ কারন না উপলক্ষ কেউ সেই প্রশ্ন তুললে অবাক হবার কিছু নেই। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পরে ক্ষমতাসীন দল যতটা দুর্বল অবস্থানে ছিল, ২০১৫ সালের গোড়াতে যতটা বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল এখন তারা সেই অবস্থানে নেই। এখন দেশের সব প্রতিষ্ঠানের ওপরে তাঁদের সর্বব্যাপ্ত নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের লক্ষণগুলো কেবল স্পষ্টই নয় ক্ষমতাসীনরা তা আড়াল করার প্রয়োজনও বোধ করছেন না। কেননা ক্ষমতাসীনরা এখন বুঝতে পাচ্ছেন যে ক্ষমতার ব্যবহার ও শক্তি প্রয়োগের ভীতি তৈরি করেই তাঁরা যে কোনো ধরণের বিরোধিতার সম্ভাবনাকে তাঁদের অধীনস্ত রাখতে পারবেন। অন্যদিকে সাংগঠনিকভাবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যে বিপর্যয়ে পতিত হয়েছে সেখান থেকে বেরুতে দলটির সময় লাগবে। প্রতিকূল পরিবেশে সাংগঠনিকভাবে নিজেকে সংগঠিত করার জন্যে যে ধরণের কৌশলের দরকার, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দরকার বিএনপির নেতারা তা এখনও আয়ত্ত করতে পারেননি। এই বিষয়ে তাঁদের কমিটমেন্ট প্রশ্নসাপেক্ষ। খুব শিগগিরই বিএনপির নেতার সেই কৌশল আয়ত্ত করবেন এমন মনে করারও কারন নেই। তাঁদের এই বিপর্যয়ের পেছনে যে সব কারন, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দলের সখ্য, সেগুলো তাঁরা এখনও মোকাবেলা করতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দল সরকারের সমালোচনার, জবাবদিহির যে সামান্য প্রাতিষ্ঠানিক জায়গাগুলো আছে সেগুলোকে দুর্বল বা নিয়ন্ত্রন করাকেই যথাযথ মনে করছে। সেই চেষ্টার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস প্রাপ্ত হলেও তাঁদের আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। অন্যদের জন্যেও সেখানে শিক্ষনীয় বিষয় থাকবে।
ফলে বাংলাদেশে যারা একে এখনও গণমাধ্যমের প্রতি হুমকি বলে মনে করছেন না তাঁরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জটা বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন না বলেই আমার ধারণা। বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমই ত্রুটিমুক্ত নয়। ২০০৭-৮ সালেই শুধু নয়, বর্তমানেও তাঁদের ভুমিকা অনেকাংশেই প্রশ্নবিদ্ধ। ২০০৭-৮ সালে ‘অজ্ঞাত সুত্র’ থেকে পাওয়া টেপের ভিত্তিতে সংবাদ লেখা ও প্রকাশের সঙ্গে ২০১৩ বা ২০১৫ সালে অজ্ঞাত সূত্রে পাওয়া টেপের ভিত্তিতে লেখা সংবাদের মধ্যে পদ্ধতিগত বা নীতিগত পার্থক্য কোথায় সেই প্রশ্ন কি কেউ তুলছেন? এই প্রসঙ্গে অতীতে গণমাধ্যমের ওপরে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্র বা টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া এবং একজন সম্পাদককে আটকের ঘটনার প্রশ্নও উঠবে। প্রশ্ন উঠবে রহস্যময়ভাবে প্রাপ্ত টেপ প্রচারের পটভূমিকায় আটক একজন রাজনৈতিক নেতাকে বিনাবিচারে প্রায় এক বছর ধরে কারাগারে রাখার দায়িত্বের কতটা গনমাধ্যমগুলো নেবে। দ্বিধা-বিভক্ত সাংবাদিকরা এই বিষয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে অবস্থান নেবেন এমন আশা করার কারন নেই। কিন্ত এই বিভক্তির উর্ধে ওঠার মতো সাংবাদিক-সম্পাদক নেই একথা কী সাংবাদিকদের জন্যে সম্পাদকদের জন্যে গৌরবের? রাজনীতিতে যে শক্তিগুলো এখনও বিরোধী দলের ভূমিকায় আছেন তাঁরা কি এই ঘটনাপ্রবাহের রাজনৈতিক তাৎপর্য উপলব্ধি করতে অপারগ না অনীহ?