“সে আর লালন একখানে রয়, লক্ষ যোজন ফাঁক রে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”
বাংলা ভাষায় ‘সে’ বলে যে তৃতীয় পক্ষের সর্বনামের ব্যবহার চালু আছে তা কেবল মানুষ বোঝায় তা কিন্তু নয়। যেমন, ‘সে’ -এর সঙ্গে ‘টা’ জুড়ে দিলে হয় ‘সেটা’। ইংরেজি এবং অন্যান্য যেসব ভাষায় তৃতীয়পক্ষের দুটি ভাগ আছে, যেমন he/she এবং it, বাংলা তাদের মতো নয়। এখানে ‘সে’ এককভাবে না ব্যক্তি, না বস্তু, না বিষয়; কেননা, ‘সে’ সেসবের সবই। যেমন, “সে যে সেটা আনবে না, সে আমি জানি” বাক্যে প্রথম ‘সে’ ব্যক্তি, দ্বিতীয় ‘সে’ বস্তু, তৃতীয় ‘সে’ বিষয়।
এখানে ‘সে’-এর স্থলে ‘ও’ বসালে ফল একই। এমনকি, ‘তে যে তা আনবে না, তা আমি জানি’ বাক্য থেকে বোঝা যায় যে, ‘সে’, ‘তা’ এবং ‘ও’ আসলে তৃতীয় পক্ষেরই বিবিধ রূপ, যা ব্যক্তি বস্তু এবং বিষয় নির্বিশেষ এক সর্বনাম। এখন লালন যখন ‘সে আর লালন একখানে রয়’ বলেন, তখন সেই ‘সে’ আসলে কে? ‘সে’ কি ব্যক্তি, বস্তু না বিষয়? আর ‘সে’ যদি হয় ব্যক্তি বস্তু এবং বিষয় নির্বিশেষ এক সর্বনাম, তাহলে ‘তা’র নাম কী?
লালন বলছেন, ‘সে’ বা ‘তা’র কোন নাম নেই সে ‘অনামক’; শঙ্কর বলছেন, ব্রহ্ম; সূফীরা বলছেন, খোদা; ফ্রয়েড-লাকা বলছেন, সলিমুল্লাহ খানের ভাষা-ভাষ্য অনুসারে, অজ্ঞান। এ লেখায় সেই ‘সে’ তথা ‘তা’র সুলুক পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ কথা বলে নেয়া ভালো, উপরে উক্ত খোদা কিংবা ব্রহ্ম- এর কোনটা দিয়েই সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর বোঝায় না। কিন্তু ব্রহ্ম এবং খোদা সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর অর্থে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়। তাই খোদা বা ব্রহ্ম শব্দগুলো এখানে ব্যবহার এখানে করব না। তবে এটুকু বলব, অনামক অজ্ঞান সদাই সৃষ্টিশীল। তবে ধর্মগ্রন্থের সৃষ্টিকর্তার মত সে সার্বজনীন তথা সামান্য নয় বরং ব্যক্তিক তথা বিশেষ। লালন তাই সন্দিহান, ‘সামান্যে কি তার দেখা পাবা!’
তো, ‘সে আর লালন একখানে রয়’- বাক্যে ‘সে’ হলো ‘অনামক’ তথা ‘অজ্ঞান’। সে বাবদে বাক্যটির ভাষান্তর হলো, লালন আর লালনের অজ্ঞান একখানে রয়। তথা আমি আর আমার অজ্ঞান এক সঙ্গে রই। এই সঙ্গ ছাড়া- না আমাকে বোঝা যাবে, না অজ্ঞানকে। এই সঙ্গের কথা মাথায় রেখে দেকার্তের I think, therefore I am বাক্যটিকে বদলে লেখা যায়, I(t) think(s), therefore I am। কেননা এখানে লালন-লাকার অভিজ্ঞান যোগ করলে, ‘আমি’ এর সঙ্গে তৃতীয় পক্ষ ‘সে’ কিংবা ‘তা’ রয় তা বেরোয়। ওই প্রথম আর তৃতীয় পক্ষের সঙ্গ বোঝানোর জন্য I(t) লেখা। এ বিষয়ে পুনরায় ফিরে আসা যাবে।
আবার ‘লক্ষ যোজন ফাঁক রে’ বলে লালন যা বলে তা লাকা বলেন ‘subject is split’ বলে। লাকানীয় দর্শনে এই ফাঁক বা স্প্লিট উপশম হবার নয়। দেহাত্মবাদে গুরুর মধ্যস্থতায় এর উপশমের সাধনা করা হয় বৈকি, কিন্তু লালনও ‘তা’রে একদিনও না দেখার কথাই বলেন। এবাবদে আমাদের বাক্যটিকে বাংলায় আমরা লিখতে চাই, আমি-ও চিন্তা করি, অতএব আমি আছি। এখানে ‘আমি-ও’কে আমিও পড়া যেতে পারে, কেননা এতে আর কেউ যে চিন্তা করছে তার ইঙ্গিত থাকে। কিন্তু আমি-ও লেখার কারণ, আমি এবং ‘ও’র সঙ্গও বোঝানো হয় এবং তাদের মাঝের ফাঁকটাও ধরা হয়। এই ‘ও’ হচ্ছে সেই ‘সে’ কিংবা ‘তা’।
লালন যখন বলেন, ‘কে কথা কয় রে দেখা দেয় না’, অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন বলেন ‘কোন সুদূর হতে আমার মনোমাঝে বাণীর ধারা বহে– আমার প্রাণে প্রাণে। আমি কখন শুনি কখন শুনি না যে’ তখন সেই কথা বা সেই বাণীর কথাকার বা বাণীকার হলো সেই ‘সে’, যে আমার মাঝেই আমার অপর হিসেবে বিদ্যমান। লাকার ভাষায়, “ca parle” বা “it speaks”। জীবনানন্দের কথা উল্টে বলতে হয়, আমি কেবল ‘তা’র ‘বাণী হয়ে আনি’, ‘সে’ চলে সাথে সাথে ‘আমি চলি’, ‘আমি থামি’ কিন্তু ‘সে’ থামে না। সৃষ্টিশীলতার গোমর মনে করা হয় ‘তা’কে। ‘সে’ সদা সৃষ্টি করে যাচ্ছে, আমি কখন শুনি কখন শুনি না, কখন সেই বাণী বয়ে আনতে পারি কখন পারি না।
সবার মধ্যেই সবার ‘সে’ আলেক বা অদৃশ্য আছে। সলিমুল্লাহ খানের ভাষ্যে পাই, ফ্রয়েড বলেন, আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি ‘সে’-ই স্বপ্ন দেখায়, ‘সে’-ই আমার চেপে রাখা কথা আমার মাধ্যমেই ফাঁস করে দেয়, আমার মুদ্রাদোষ ‘ও’র উপস্থিতি জানান দেয়। সেকারণে লাকা, দেকার্তের I think, therefore I am প্রস্তাবকে পরিমার্জনা করে বলেন, I think where I am not, therefore I am where I do not think। হেঁয়ালি মনে হবে, তবে যদি এই I (আমি) কে ‘সে/তা/ও’র সঙ্গে যুক্ত করে পাঠ করি তাহলে অর্থ উদ্ধার হয়। ইংরেজিতে তাই লিখেছি I(t) think(s), therefore I am যেখানে, I (আমি) আছি আবার t মিলে it (সে/তা/ও) আছে। বাংলায় লিখেছি, আমি-ও চিন্তা করি, অতএব আমি আছি। এই হলো, ফাঁক নিয়েই আমি আর ও’র একখানে থাকা।
আমি যেখানে নাই, মানে ঘুমের মধ্যে, সেখানে আমি চিন্তা করছি, এর প্রমাণ হলো আমি স্বপ্ন দেখছি। আবার আমি আছি সেখানে আমি চিন্তা করছি না, যেমন ফ্রয়েডিয়ান স্লিপ বলি আর মুদ্রাদোষ বলি– দুই ক্ষেত্রেই বলি ‘আমি এটা চিন্তা করে বলি নাই বা করি নাই।’ আবার আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এক জিনিশ নিয়ে আমরা মনের অজান্তেই চিন্তা করতে থাকি, প্রায়শই চিন্তার লেজের দিকে আমাদের হুশ বা জ্ঞান হয় যে চিন্তা করছিলাম। তাহলে প্রশ্ন চিন্তার মাথার দিকটা তাহলে কে চিন্তা করছিল? ফ্রয়েড অনুসারে তখন চিন্তা করছিল ও তথা আমার অজ্ঞান। শঙ্কর অনুসারে ওঁ। আর সূফী কিংবা ফকিরি অনুসারে, ‘সে’, আমি আহমেদের মধ্যে অপর এক আমি, এমন এক সর্বনাম যার নাম নাই। যেমনটা লালনে পাই, ‘স্বরূপে রূপ আছে গিল্টি করা’।