সম্প্রতি রোহিঙ্গা সমস্যাটি দানা বাঁধতে শুরু করার পর গত ৫ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদকে উদ্দেশ্য করে মোহাম্মদ ইউনুস একটি খোলা চিঠি লেখেন। এরপর এই প্রক্রিয়াতে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে বিশিষ্টজনেরা যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে মানবিক সমস্যা সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদকে হস্তক্ষেপ করার অনুরোধ করে। এই যুক্ত বিবৃতিতে সর্বশেষ স্বাক্ষর করেন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন 1। তবে এতে স্বাক্ষর করা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ ইউনুসকে প্রেরিত চিঠিতে অমর্ত্য সেন লেখেন তিনি সাধারণত যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন না, কিন্তু এই ক্ষেত্রে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনা করে তিনি এতে ব্যতিক্রম ঘটালেন। যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর না করার বিষয়ে অমর্ত্য সেনের চিন্তাটা যৌক্তিক। সত্যিই তো একটি বিষয়ে দুইজন মানুষের মতামত পুরোপুরি মিলে যাওয়া সম্ভব নয়। আর সেই সংখ্যা যদি হয় ৩৬ সে সম্ভাবনাতো আরো কমে যায়। এই মতভিন্নতার সম্ভাবনা সত্ত্বেও সংকটের সময় একত্রিত হবার পেছনে যে মানবিক দায় সেটা প্রসংসার যোগ্য। তবে এই যে সংকট ময় সময় যখন “আর্গুমেন্টেটিভ ব্যক্তিত্বরা” ভিন্নতা ভুলে একটি যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করলেন সেটা তাৎপর্যপূর্ণ । এর থেকে কয়েকটি পর্যবেক্ষণ টুকে রাখা দরকার ।
প্রথমত, রোহিঙ্গা সংকটটি কেবল রোহিঙ্গা বা মায়ানমারের সংকট নয়। এটা বর্তমান সময়ের এবং বিশ্বের একটি সংকট। বর্তমান সময়ে জাতি রাষ্ট্র ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং পুঁজির ব্যবস্থাপনা যে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে তাতে একটি জাতিকে নির্দয় এবং নিষ্ঠুর ভাবে নির্মুলের দারপ্রান্তে পৌছে দেয়া হলেও পৃথিবী তাতে নির্বিকার থাকতে পারছে। নির্বিকার থাকার এই বাস্তবতাটা মানব জাতির জন্য একটা বিপদ সংকেত। এমন বাস্তবতা না থাকলে ঠিক বর্তমান সময়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি নির্যাতন এমন রূপ নিতে পারত না। এ ধরনের নিপীড়ন চালাতে অনেক বার ভাবতে হত মায়ানমারের সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের। ফলে বলাবাহুল্য রোহিঙ্গা ইস্যুটি একটা ঘটনামাত্র নয়। এটা একটা নজির, নিষ্ঠুর সময়ের সাক্ষী। সেটা একটা বার্তা নিয়ে এসেছে। এরকম নজির ভবিষ্যতে নানা জাতির প্রতি ঘটার সম্ভাবনা যে উড়িয়ে দেয়া যায় না তাতে গুরুত্বের সাথে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। জাতিগত নিপীড়ন অথবা সম্পদের উপর দখল প্রতিষ্ঠার জন্য একই রকম কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে এরকম চিন্তা বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃতি ঘটাতে উৎসাহ দেবে।
দ্বতীয়ত, মানুষের প্রতি মানুষের মমতা প্রদর্শনের যে উদাহরণ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ দেখিয়েছে সেটা সত্যিই গর্ব করার মত। ক্রিকেটে বা ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হবার থেকে এই এগিয়ে যাওয়াটা যে অনেক বড় আনন্দের সেটা বলাই বাহুল্য। এই যে চালের দাম বেড়ে গেল। অনেকে চাল কিনছেন রোহিঙ্গাদের জন্য! অর্থনীতি বলছে একটা বড় মাপের অভিঘাত এসেছে। আমরা এর মধ্যেই দেখেছি রাষ্ট্র অবস্থান বদলেছে। কূটনৈতক ভাবে সমস্যা সমাধানে কিছু লক্ষ্যনীয় চেষ্টাও দেখা গেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বেশ কিছু বক্তব্য এবং পদক্ষেপ সম্পর্কে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে 2। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের এই প্রক্রিয়ায় সমন্বিত করতে অধ্যাপক ইউনুস যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন 3 আবার মনে করিয়ে দিল সংকটের সময় মানুষের আসল রূপটা বোঝা যায়। অনলাইনেও দেখা গেছে মানুষের ভেতর মতাদর্শ (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্যত মতামত) নিয়ে যে বিভেদ সেটা থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে এসে একে অন্যের সাথে কাধ মেলাচ্ছেন। এটা অনেক বড় স্বস্তির বিষয়।
তৃতীয়ত, রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে আঞ্চলিক একটা মাত্রাতেও গুরুত্বের সাথে দেখা দরকার। বৈশ্বিক আর স্থানীয় এই দুই স্কেলের মধ্যে যে মাত্রা সেই অর্থে দক্ষিন এশিয়ার জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশ রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে মানবিক দিক থেকে দেখছে না, বা দেখতে চাচ্ছেনা। তুরস্ক ধর্মিয় বিবেচনা থেকে বিষয়টিকে দেখতে চাইছিল বলে মনে হয়েছে। কিন্তু সু কি বা মায়ানমারের সেনাবাহিনীর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য করার যে পদ্ধতি নেয়া হচ্ছিল তাতে রোহিঙ্গা সংকট সম্পর্কে তুরস্ক কীভাবে দেখছে তা কিছুটা অস্পষ্ট ছিল। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে ভারত, চীন, রাশিয়ার অবস্থান বাংলাদেশের জন্য খুব আশাপ্রদ নয়। এ অবস্থায় বিষয়টিকে কৌশলগত ভাবে মোকাবেলা করার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রম নেয়ার উপায় অনুসন্ধান জরুরি। সংকট যত বড় তার মোকাবেলার উদ্যোগেও সে মাত্রার হওয়া উচিত। ভুলে গেলে চলবে না রোহিঙ্গারা কেবল মাত্র খাদ্য আর সাস্থ্যসেবা জনিত ইন্সট্রুমেন্টের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। যে কোন মূল্যে বেচে থাকার জন্য আকুল যেসব মানুষ, তারা যে কোন সময় ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। তাদেরকে দিয়ে যে কোন ক্ষতিকর কাজ করিয়ে নিতে পারবে সুবিধাবাদি গোষ্ঠী। পরে “আগেইতো বলেছিলাম রোহিঙ্গারা খারাপ (জঙ্গি, ইয়াবা ব্যবসায়ি ইত্যাদি)” — এই ধরনের যুক্তি দিয়ে সমস্যার মোকাবেলা করা যাবে না।
চতুর্থত, মোহাম্মদ ইউনুস মায়ানমার সম্পর্কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। অনুমান করা যায় মায়ানমারে ঘটমান বিষয়ের উপর সু কির নিয়ন্ত্রণ খুব একটা নেই। সেনাবাহিনীই এই ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নিচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে সু কি কতটা স্বাধীন ভাবে নিজের মতামত দিতে পারছেন সেটা বিবেচ্য অবশ্যই। এই সমস্যাটিকে বিবেচনায় রেখে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে ভাবা গেলে অনেক কিছুই সহজ হয়। অন্তত সেনাবাহিনীর কাছে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রান প্রেরণের বোকামি থেকে যদি বিশ্ব বাঁচতে চায় সেটা অন্তত সম্ভব। আর এ থেকে এই বিষয়ের দিকেও লক্ষ্য করা দরকার যে রোহিঙ্গাদের প্রতি নিপীড়নের সিদ্ধান্তটি মূলত মায়ানমার সেনা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রের। এতে ধর্মীয় গোষ্ঠীদের ভূমিকা ততটা নয়, যতটা আমাদের দেশের ধর্মের নামে ফয়দা তোলা ব্যাক্তিরা ভাবছেন। তেল গ্যাস আর ব্যবসা বানিজ্যের হিসাব যে এতে বড় ভূমিকা রাখছে সেটাও বেশ যৌক্তিক ভাবে তুলে ধরেছেন অনেকে 4 পুঁজি ও খনিজ সম্পদ ব্যবস্থাপনার রাজনৈতিক অর্থনীতি বিবেচনায় নিলে এটা বুঝতেও সমস্যা হবে না যে আমাদের এখানে যারা মায়ানমারের ঘটনার অজুহাতে বাংলাদেশের নানান সংখ্যালঘুদের দিকে আঙ্গুল তুলতে চাইছেন তারাও মুলত মায়ানমারের সামরিক জান্তাদের ভঙ্গিতেই চিন্তা করছেন। বিষয়টিকে নিছক সাম্প্রদায়িকতার লেন্সে দেখাটা ভুল হবে।
মায়ানমার ইস্যুটির সমাধানের জন্য এটার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা, পুঁজি ব্যবস্থাপনার সমস্যা বোঝা প্রয়োজন। রাষ্ট্রগুলোর নিস্পৃহ অবস্থানের প্রেক্ষিতে বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যাক্তি এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করাটাও বেশ দরকারি। আর এটাকে নিছক সাম্প্রদায়িক হামলা হিসাবে দেখার অতিসরল ভাবনাকেও অতিক্রম করা প্রয়োজন। আর এই সংকটের মুখে মানবিকতার পরিচয় দিয়ে যে উদ্যোগগুলো নেয়া হচ্ছে সেগুলোকেও বার বার তুলে ধরা দরকার যেন সেই ধরনের আচরণই বেশি উঠে আসে মানুষের দৈনন্দিন চর্চায়।
থাম্বনেইলের ছবির সূত্র: সিবিসি নিউজ