প্রত্যেকটি আন্দোলন, প্রত্যেকটি বিপ্লবই তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্টে মণ্ডিত। কোন দুটো রাজনৈতিক বা সামজিক আন্দোলনই এক রকম নয়। এই পার্থক্য যে কেবল মাত্র দেশ, কাল, প্রেক্ষাপট বা দাবি দাওয়ার কারনেই হয় তা নয়; পার্থক্যের সবচেয়ে বড় কারণ হল যে কোন আন্দোলন বা বিপ্লব হল একটা সৃষ্টিশীল কাজ। সেই সৃষ্টিশীল কাজই সবচেয়ে বেশি আবেদন রাখতে সক্ষম হয় যা অতীতের এমনকি শ্রেষ্ঠ কাজটি থেকেও ভিন্ন। ফলে যে আন্দোলন তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্টে উদ্ভাসিত হতে পারেনা, যে আন্দোলন কেবল মাত্র অতীতের আন্দোলনের দুর্বল অনুকরণ তা সাময়িকভাবে কিছু লক্ষ অর্জনে সফলতা দেখালেও তাঁর আবেদন থেকে সীমিত – একটি বিশেষ সমর্থক, দল, গোষ্ঠি, পেশার মানুষের মধ্যেই তা ঘুরপাক খেতে থাকে।
প্রত্যেকটি আন্দোলনের নিজস্বতার কথা জানা সত্ত্বেও সমাজ ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা যে কোনো আন্দোলনকে অতীতের কোনো না কোনো আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করতে চেষ্টা করেন। গণমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তারের পর এই প্রবণতা গণমাধ্যমের মধ্যেও প্রসারিত হয়েছে। তবে কৃতিমান সমাজ ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা আন্দোলনের বা বিপ্লবের মধ্যে তুলনায় দেখতে চান তাঁদের ভেতরকার মিল ও অমিল দুটোই; দেখতে চান মর্মবস্ত ও ফর্ম (বা রূপগত) দুই বিবেচনা থেকেই। কিন্ত তাঁরা যদি এটা বলেন যে নতুন আন্দোলনটি অতীতের কোনো আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি মাত্র তা হলে বুঝতে হবে যে এই নতুন আন্দোলন তাঁর সবচেয়ে বড় গুনটিই অর্জন করতে পারেনি।
শাহবাগে গত কয়েক দিন ধরে যে সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে, তরুণদের ডাকে যে জাতীয় আন্দোলনের সূচনা হয়েছে – যার আগুন ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে সে বিষয়ে আলোচনায় যারা বারংবার আরব বসন্তের প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন তাঁরা এই আন্দোলনের সৃষ্টিশীল দিকটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই আন্দোলনকে আরব বসন্তের অনুকরণ বা অনুসরণ বলার মধ্যে এই আন্দোলনকে কেবল ছোটই করা হয়না – আমার ধারণা আন্দোলনের সৃষ্টিশীলতাকে অপমান করা হয়। যারা একে আরব বসন্ত বলতে চান বা বলেন এটা তাদের আরব বসন্ত বিষয়ে অজ্ঞতার যেমন পরিচায়ক তেমনি এই আন্দোলনের মর্মবস্ত না বোঝারও একটা বড় প্রমাণ।
আরব বসন্তের প্রসঙ্গটি আসছে অনেকাংশেই এই কারণে যে এই আন্দোলন তাহরির স্কোয়ারের মতো একটা জায়গায় অবস্থান নিয়ে তাকে কেন্দ্র করে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরছে। কিন্ত মনে রাখা দরকার যে আন্দোলনের কর্মীদের, তাঁদের বক্তব্যকে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য দিনের দিনের দিন অবস্থান নেয়ার ঘটনা, আমরা মিসরের বাইরেও দেখেছি – ১৯৮৬ সালে ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনে মার্কোস সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের এক পর্যায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে সমবেত হয়ে অবস্থান নেবার পরই সরকারের পতন ঘটে, ২০০৯-২০১০ সালে থাইল্যান্ডে লাল শার্টের কর্মীরা একাধিক বার সরকার বিরোধী আন্দোলনে সে চেষ্টা করেছেন। তাহরির স্কোয়ারের আন্দোলন এক অর্থে এই ধরণের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা। কেননা এই আন্দোলনগুলোর লক্ষ হচ্ছে ক্ষমতার কাঠামোতে পরিবর্তন।
কিন্ত আগের এই সব প্রচেষ্টা থেকে মিসরের আন্দোলনের পার্থক্য হল সেখানে কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক দল ছিলনা; কোনো দলের ডাকে সাধারণ মানুষ সমবেত হন নি। মিসরের আন্দোলনের প্রাণ শক্তি ছিলো তরুণরা, যারা নিজেদের শক্তির ওপর নির্ভর করেই এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। কিন্ত এই আন্দোলনের আগেও হোসনি মোবারক সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে। ২০১০ সালের আন্দোলনের যে বৈশিষ্ট আমরা দেখতে পাই তাহলো অব্যাহত অবস্থান ধর্মঘট, একটি এলাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত করা। একটি জায়গাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের ধারনাটি আমরা দেখতে পাই আর্জেন্টিনায় ১৯৭৭ সালে। মাদারস অব প্লাজা দি মায়ো’র কথা অনেকেরই জানা। আর্জেন্টিনার সেনা শাসকদের হাতে গুম হয়ে যাওয়া সন্তানদের খুঁজে বের করার দাবি নিয়ে ১৪ জন সন্তানহারা মায়ের বুয়েনেস আয়ার্সের নগর-কেন্দ্রের চত্বরে যে নিয়মিত প্রতিবাদ তা একটানা অবস্থান আন্দোলনে রূপ না নিলেও তৃণমূল থেকে নিজস্ব শক্তিতে গড়ে ওঠা অহিংস নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের একটা নতুন ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এই আন্দোলনের মর্মবস্ত হল সরকারের জবাবদিহির দাবি তোলা। গুম হয়ে যাওয়া সন্তানদের ফিরে পাওয়ার দাবি ছিল আশু কারণ। কিন্ত কার্যত তা হয়ে ওঠে দেশের সেনাশাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটি উৎস এবং রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তনের একটা তাগিদ।
কাঠামোগত পরিবর্তনের তাগিদ থেকে দলীয় নিয়ন্ত্রনের বাইরে আন্দোলনের সাম্প্রতিক দুটো উদাহরণ আমরা দেখতে পাই; একটি হল এন্টি-গ্লোবালাইজেশন আন্দোলন যা সবার মনোযোগ আকর্ষন করে ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার বার্ষিক বৈঠকের সময়। এর আগেও প্রতিবাদ হয়েছে; কিন্ত সিয়াটলে অবস্থান ধর্মঘটের চেষ্টা থেকেই এই প্রচেষ্টার প্রতি সকলের নজর পড়ে। দ্বিতীয় উদাহরণ হল; ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট’ আন্দোলন। সূত্রপাত যদিও নিউ ইয়র্কে। ক্রমেই তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের কোনো সুনির্দিষ্ট দাবিনামা যেমন ছিলনা তেমনি তাঁর বৈশিষ্ট ছিল অব্যাহত অবস্থান। এই আন্দোলনের অন্যতম সৃষ্টিশীল দিক হল সম্মিলিত নেতৃত্বের ধারণাকে কার্যকর রূপ দেয়া।
অতীতের এই সব আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুললাম এই কারণে যারাই এখন শাহবাগের এই জমায়েত, এই আন্দোলনকে একটি বিশেষ আন্দোলনের আদলে দেখতে চাইছেন তাঁরা আসলে বুঝতে পারছেন না যে এই আন্দোলনের মর্মবস্ত কি। একই বিবেচনায় এই আন্দোলনকে যারা ১৯৫২, ১৯৬৬ বা ১৯৬৯-এর সঙ্গে তুলনা করছেন তারাও একই রকম বিভ্রান্তিতে আছেন। এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় দিকই হল এটা এ সব থেকেই আলাদা। এটা অস্বীকার করার অর্থ হল যে এই আন্দোলনের বৈশিষ্টকে, তাঁর সৃষ্টিশীল দিককে অস্বীকার করা।
গত কয়েক দিনে এটা স্পষ্ট যে এই আন্দোলনের লক্ষ ক্ষমতার বদল নয়। আন্দোলনের তাগিদটা বরং কাঠামোগত এই অর্থে যে এই আন্দোলন জবাবদিহি দাবি করছে রাষ্ট্র, সরকার এবং আদালতের কাছ থেকে। একই সঙ্গে এই আন্দোলন প্রচলিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকেও জবাবদিহি দাবি করছে। আদালতের রায়ের ভেতরে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার আভাস দেখতে পেয়েছে বলেই সাধারণ মানুষের এক বড় অংশ এই আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে গণহত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির আদালতে দেয়া শাস্তি বহাল রাখার নিশ্চয়তা দিতে পারেনা এবং বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্যেই সেই রায় কার্যত বাতিলের ব্যবস্থা আছে সেটা নাগরিকদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। এই নিয়ে আন্দোলন তৈরি করতে পারাটা আগের যে কোনো আন্দোলন থেকে একে আলাদা করে রাখছে।
এই আন্দোলনের একটা সুর অবশ্যই জাতীয়তাবাদী। জাতি হিসেবে বাংলাদেশে গত বিয়াল্লিশ বছরে যা অর্জন করা সম্ভব হয়নি, যে কাঠামোগত বাধার কারণে মানবতাবিরোধীদের, গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচারের সম্মুখীন করা সম্ভব হয়নি তাঁর বিরুদ্ধেই তরুণ সংগঠকরা অবস্থান নিয়েছেন। ফলে এই আন্দোলনকে যারা কেবলমাত্র একজন যুদ্ধাপরাধীর যথাযথ শাস্তি দেয়া না দেয়ার বিষয় হিসেবে দেখছেন তাঁরা এই আন্দোলনকে সীমিত করে দিচ্ছেন এবং এই আন্দোলনের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছেন না। যে কারণে আমরা তাঁদের কাছে এই প্রশ্ন শুনতে পাচ্ছি এই আন্দোলনের রোডম্যাপ কি? আন্দোলনের ক্যালেন্ডার কোথায়?
একই ভাবে আমরা আন্দোলনকারীদের প্রতি পরামর্শ দিতেও শুনছি যে তাঁদের উচিৎ হবে পরিচিত শিক্ষক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা এবং তাঁদের পরামর্শের ভিত্তিতে আন্দোলনকে তাঁর পরিণতি বা সাফল্যের দিকে নিয়ে যাওয়া। যারা এসব পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা বিস্মৃত হচ্ছেন যে, যে তরুণরা আজকে এই আন্দোলনের সুচণা করেছেন তাঁরা কারো পরামর্শের জন্য অপেক্ষা করেন নি। যে কোন তৃণমূল আন্দোলনের প্রথম চ্যালেঞ্জ হল তাকে জাতীয় রূপ দেয়া। শাহবাগের আন্দোলন সে সাফল্যের জন্য কারো মুখাপেক্ষি হয় নি, কেননা দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষত তরুণরা, প্রচলিত রাজনৈতিক মত এবং পথের বাইরে, প্রচলিত প্রতিবাদের কৌশলের বাইরে নতুন পথ তৈরি করতে পেরেছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা মনে করতে পারি যে দীর্ঘ দিন ধরে দেশের সাধারণ মানুষ, গণমাধ্যম, ও জনসমাজের সদস্যরা প্রতিবাদের কৌশল হিসাবে হরতাল, সহিংসতার বিকল্প খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাতে উৎসাহ না দেখালেও এখন সারা দেশেই আমরা একটা বিকল্প তৈরি হতে দেখেছি।
শাহবাগ আন্দোলনের পরিণতি কি হবে সে বিষয়ে আলোচনার সময় এখনও আসেনি, তাঁর সাফল্য কি মাপকাঠিতে বিচার করা যথাযথ হবে সে কথা বলার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে। তবে এখনই যেটা দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায় যে, এই আন্দোলন একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করেছে; সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করা কেবল সংগঠকদের কাজ নয় – সে দায়িত্ব গোটা জাতির।
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩