লক্ষ্য ছিল হত্যা করার, এ বিষয়ে কোনো রকম বিভ্রান্তির কারণ নেই। এটা কোনো আবিষ্কার নয় যে জাগৃতি ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও হত্যার চেষ্টা ‘পরিকল্পিত’ এবং তা শোনার জন্য আমাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্যের অপেক্ষা করার দরকার হয় না। শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে আহমেদুর রশীদ চৌধুরী (টুটুল) ও জাগৃতি কার্যালয়ে ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালানো হয়। আহমেদুর রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে সেই সময়ে থাকা দুজন লেখক তারেক রহিম ও রণদীপম বসুর জীবন বিপন্ন হয়, কিন্তু তাঁদের উপস্থিতির কারণে আহমেদুর রশীদ চৌধুরীর জীবন রক্ষা হয়েছে। হামলা হয়েছে দিনদুপুরে, হামলার ধরন একই, হামলার পর কার্যালয়ের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার ঘটনাও একই রকম। অতীতে হামলার ঘটনা ঘটেছে একেক দিন একেক জায়গায়। এবার তার মাত্রা দ্বিগুণ হয়েছে। শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে পুলিশ যথাসময়ে না পৌঁছালে হারাতে হতো তিনজনকে, মৃত্যুর সঙ্গে তাঁরা লড়ছেন এখন; দীপনকে সেই লড়াই করতে হয়েছে একাই।
আততায়ীরা যে সাফল্য ছাড়া ঘরে ফিরতে চায়নি, সেটা প্রায় একই সময়ে পরিচালিত হামলা থেকেই স্পষ্ট। তারা যেন নিশ্চিত করতে চেয়েছে যে ৩১ অক্টোবরে তাদের চাই একটি হলেও নিস্পন্দ মানুষ, যে মানুষটি অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক, তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যাকে সহজেই একটি ধারার সঙ্গে যুক্ত বলে চেনা যায়। কিন্তু অন্য অনেকের মতো আমার মনে এই প্রশ্ন—এই সাহসের উৎস কোথায়? কীভাবে এই আততায়ীরা ভাবতে পারে যে দিনদুপুরে এই ধরনের উদ্ধত অভিযান চালিয়ে তারা নিরাপদে সরে যেতে পারবে? বিশেষ করে সেই সময়ে, যখন বিদেশি নাগরিকদের হত্যা এবং তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার’ পুনঃপুন আশ্বাসের কথা সবাই জানেন। নাশকতার সব ঘটনা বন্ধ করা যাবে না, সব চোরাগোপ্তা আক্রমণ প্রতিহত করা যাবে না—এই বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক নেই। তারপরও একটার পর একটা ঘটনার মধ্যে যেখানে ‘এসকেলেশনের’ বা তীব্রতা ও মাত্রা বৃদ্ধির লক্ষণ সুস্পষ্ট, সেখানে এই যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য? কীভাবে তা ব্যাখ্যা করা যাবে? নাগরিকদের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক, সেই প্রশ্ন না হয় না-ই তুললাম।
দুই.
বাংলাদেশ সময় রোববার সকাল পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই হত্যা ও হত্যাচেষ্টার জন্য কাউকে দায়ী করা হয়নি, যদিও আওয়ামী লীগের নেতা মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘জামায়াত-শিবির ও বিএনপির খণ্ডিত অংশ জড়িত।’ তিনি বলেছেন, ‘কেউ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, কেউ জেএমবি, কেউ হরকাতুল জিহাদ, কেউ হুজি—বিভিন্ন নাম দিয়ে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করছে।’ অতীতের ঘটনার পরে সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য নেই। ইতিমধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে আল-কায়েদা বা একিউআইএসের ‘বাংলাদেশ শাখা’ বলে দাবিদার আনসার আল ইসলাম এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে। এই সংগঠনের অস্তিত্ব ও তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের যোগাযোগ বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত। কিন্তু বাংলাদেশে যেসব জঙ্গি সংগঠনের উপস্থিতি রয়েছে বলে বলা হয়, তাদের অন্যতম হচ্ছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। সম্প্রতি আওয়ামী ওলামা লীগ বলে দাবিদার সংগঠনের এক পক্ষ সংবাদ সম্মেলনে অপর পক্ষের বিরুদ্ধে এই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ করেছিল, তা কি খতিয়ে দেখা হয়েছে? জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন যেখানে জড়িত, যেখানে নিয়মিতভাবে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কর্মী বলে পরিচিত ব্যক্তিরা অস্ত্র ও বোমাসহ আটক হচ্ছেন, সেখানে এই ধরনের অভিযোগকে হালকাভাবে নেওয়ার অবকাশ থাকে কি? কিন্তু এই বিষয়ে সরকার তাগিদ অনুভব করছে বলে মনে হয় না।
তিন.
ফয়সল আরেফিন দীপনের বাবা আবুল কাসেম ফজলুল হক আমার শিক্ষক। ক্লাসরুমে বসে তাঁর কাছ থেকে পাঠগ্রহণের সুযোগ আমার হয়নি, কেননা আমি ভিন্ন বিভাগের ছাত্র ছিলাম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁকে কাছ থেকে দেখার, সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। পরে সহকর্মী হওয়ার সূত্রে তাঁর কাছ থেকে আরও বেশি জানার-শেখার সুযোগ হয়েছে। শিক্ষক হিসেবে, মানুষ হিসেবে তিনি নির্বিরোধী; চিন্তার স্বচ্ছতায়, বিবেকতাড়িত একজন লেখক হিসেবে তিনি আদর্শস্থানীয়। সেই মানুষ, সেই শিক্ষক আজ তাঁর সন্তানের হত্যাকাণ্ডের পর যা বলেছেন, সেই কথাকে আমাদের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই—‘হত্যাকারীদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই না। কেননা, বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক।’ বাংলাদেশে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেখানে দীপন হত্যার বিচার হবে, সেই আশা নাগরিক হিসেবে সম্ভবত ফজলুল হক স্যার করেন না, অন্যরাও করেন না। ফলে আমরা যদিও দাবি করব এই হত্যার বিচার হোক, দেশে যত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, তার বিচার হোক; আমরা সম্ভবত আশাবাদী হতে পারি না, তা হবে।
ফজলুল হক স্যার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে এই হত্যাকাণ্ড, এই হত্যাচেষ্টা, দেশে সংঘটিত অন্য হত্যা—কোনোটাই রাজনীতির বাইরে নয়। ফলে তার মোকাবিলা শক্তি দিয়ে হবে না, রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে, অসহিষ্ণুতা—তা ধর্মের নামেই হোক বা জাতীয়তাবাদের নামেই হোক—তাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে হবে না। যে রাজনীতি এই ধরনের সহিংস চরমপন্থার চর্চা করে, তার পথ উন্মুক্ত করে তার বিপরীতে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণের রাজনীতি হচ্ছে তার সমাধান। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক শুভবুদ্ধির প্রত্যাশা করে বলেছেন, ‘যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন, যাঁরা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন, উভয় পক্ষ দেশের সর্বনাশ করছেন। উভয় পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। এটুকুই আমার কামনা।’ আমরা যখন আমাদের শোক, আমাদের ক্ষোভ কাটিয়ে উঠব, তখনো আমরা কি তাঁর এই কথাগুলো মনে করতে পারব? আমরা কি প্রস্তুত হয়েছি এই বিষয়ে সবার অংশগ্রহণে আলোচনা করতে? আমরা কি আমার মতকেই শেষ কথা বলে, ঐশ্বরিক বা ঐতিহাসিক বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে প্রস্তুত হয়েছি?
চার.
আজ থেকে তিন দশকেরও বেশি সময় আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক কর্মীদের হামলায় আহত ও রক্তাক্ত হয়ে ছুটে পথ পেরিয়ে যে গৃহকে নিরাপদ আশ্রয় জেনে উঠেছিলাম, সেটি আমার শিক্ষক আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যারের বাসা। স্নেহে ও মমতায় জড়িয়ে ধরে স্যার ও ভাবি আমার মাথা থেকে বেরোনো রক্তের ধারা তোয়ালে দিয়ে বেঁধে দিয়েছিলেন, নিশ্চিত করেছিলেন যেন আমি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছাতে পারি। আজ সেই নিরাপদ গৃহের সন্তান, ফয়সল আরেফিন দীপন যখন কর্মস্থলে রক্তের স্রোতে ভেসে গিয়েছিলেন, তাঁকে কেউ জড়িয়ে ধরেনি, কেউ তাঁর রক্তের ধারা তোয়ালে দিয়ে বেঁধে দেয়নি। হাজার মাইল দূরে বসে আমি কেবল সংবাদ শুনেছি, আমার এই অসহায়ত্বের ভার আমার একার। কিন্তু আমরা যে সেই দেশ তৈরি করতে পারলাম না, যেখানে দীপনেরা, অভিজিতেরা, সাধারণ মানুষেরা নিরাপদ জীবন যাপন করেন, যেন মানুষ নির্ভয়ে মত প্রকাশ করতে পারেন, ভিন্নমত প্রকাশ যেন নিজের মৃত্যুপরোয়ানার স্বাক্ষরচিহ্ন না হয়, যেন মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পায়, তা আমরা কবে বুঝতে পারব? আমার শিক্ষক, একজন শোকাহত বাবা, আজ তাঁর সন্তান হত্যার বিচার চাননি; শুভবুদ্ধির উদয়ের প্রত্যাশা করেছেন মাত্র। আমরা কি তা শুনতে পাচ্ছি?
প্রথম আলোয় প্রকাশিত
থাম্বনেইলের সূত্র: লিঙ্ক