ছয় মাসেই উল্টো কথা
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর এই বিষয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা দরকার। এর মধ্যে সরকারের আইনি ভাষ্য দেওয়ার দায়িত্ব আইনমন্ত্রীর, বিশেষ করে যেহেতু এই বিষয়ে সরকার আপিল আবেদন করেছিল, যা খারিজ হয়ে গেছে এবং যার ফলে সংসদে পাস করা একটি সংশোধনী বাতিল হয়েছে, সেহেতু সরকারের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য আইনমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবারই কথা। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের নয় দিন পরে, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সংবাদ সম্মেলনের আগেই আমরা সরকারের ক্ষুব্ধ অবস্থানের কিছু উদাহরণ পেয়েছি।
রায় প্রকাশের পর ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারের যে সাময়িক অস্বস্তি ও নীরবতা ছিল, তা অর্থমন্ত্রীর কথার মধ্য দিয়ে অবসিত হয়; মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উষ্মাও আর অবিদিত নয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এই নিয়ে ‘জনমত গড়ে তোলার’ কথা বলার পর মন্ত্রীদের জন্য এই নিয়ে মন্তব্যের আর কোনো বাধা থাকেনি এবং তাঁরা তার সদ্ব্যবহারে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। ইতিমধ্যেই একজন মন্ত্রী প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ না করলে আন্দোলনের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন।
এতৎসত্ত্বেও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কেননা প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য বিচারপতি হক সংবাদ সম্মেলন করতে দেরি করেননি, এমনকি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের আগেই তাঁর এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইন কমিশনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এই রায় এবং প্রধান বিচারপতি বিষয়ে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, সেগুলোর ভিত্তি এবং নৈতিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ এই কারণে যে তিনি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে আছেন এবং তা লাভজনক পদ বলেই বিবেচিত (কামাল আহমেদ, ‘যেন আরও একটি অবসর-উত্তর রায়!’ প্রথম আলো ১০ আগস্ট ২০১৭)। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যকে কেবল আইনি ব্যাখ্যা বলে বিবেচনা না করে রাজনৈতিক অবস্থান বলেই বিবেচনা করব, কেননা তাঁর এসব বক্তব্য রায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা রাজনীতির বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, বিশেষ করে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ চরিত্রের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছে।
তদুপরি তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্য, যা জুন মাসে সংসদে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় এবং ১ আগস্টের পরে জনসমক্ষে দেওয়া মন্তব্যের মাধ্যমে আমরা অবগত হয়েছি, তার প্রতিধ্বনি শুনতে কষ্ট হয় না। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার যেসব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ রয়েছে, তার একটি হচ্ছে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও দেশে কোনো জনপ্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। এই কথাগুলো নতুন নয়, কেননা গবেষকেরা ও সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই তা বলে আসছেন, জীবনযাপনেও তা বোধগম্য; এই রায় এই বক্তব্যের নৈতিক অবস্থানকে জোরদার করেছে। বিচারপতি খায়রুল হকের আইন কমিশনের প্ল্যাটফর্মে সংবাদ সম্মেলন সেই কথা আবার প্রমাণ করেছে এবং ৯ আগস্ট আমরা আরেকটি প্রতিষ্ঠানের ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছি বললে অতিরঞ্জন হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে বিচারপতি হকের অতীতে দেওয়া রায়, অবস্থান এবং বক্তব্যের যে বিরোধ রয়েছে, সেটা কোনো অবস্থাতেই আমরা অবহেলা করতে পারি না। বিশেষ করে আদালতের ক্ষমতা, দায়িত্ব এবং ক্ষমতার বিভাজন সম্পর্কে তিনি এই বছরের গোড়াতেও যে কথা বলেছেন, তার একটি বড় রকমের পার্থক্য আমরা দেখতে পাই। কিন্তু আমাদের বিস্মৃত হবার উপায় নেই যে সুপ্রিম কোর্টের যে বিভক্ত রায় দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যের অবসান ঘটিয়েছিল এবং একই সঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার কাজ করেছিল, সেই আদালতের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এ বি এম খায়রুল হক; সেই রায়ের পর্যবেক্ষণে সুনির্দিষ্টভাবেই বলা হয়েছিল যে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই ব্যবস্থা বাতিলের যে রায়, সেখানে তিনজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির লেখা রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষেই মত দিয়েছিলেন (প্রথম আলো, ১১ মে ২০১১)। এই রায়ের এক সপ্তাহের মধ্যে বিচারপতি হক অবসরে যান।
এই রায়ের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি যে অনুধাবন করতে পারেননি তা নয়, তাঁকে এই বিষয়ে অ্যামিকাস কিউরিরা শুনানির সময় স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, যা রায়ের পূর্ণাঙ্গ ভাষ্যেই আছে, অর্থাৎ বিচারপতি হক সেটা জানতেন এবং এই বিষয় রায়ে উল্লেখের মতো গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচনা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রায়ের সম্পূর্ণ ভাষ্যের জন্য ১৬ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে—সেপ্টেম্বর ২০১২ সাল পর্যন্ত। আর ইতিমধ্যে ৩০ জুন ২০১১ বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে দেশের সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছে, যা সুস্পষ্টভাবে দেশের উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশনার অসংগতিপূর্ণ এবং তার পরিপন্থী। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হক রায়ের পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার ফাঁকে এ কথা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি যে পঞ্চদশ সংশোধনীটি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের মর্মবস্তু বা স্পিরিটের বিরুদ্ধে। যদিও ক্ষমতাসীন দল বারবার ওই রায়কেই ব্যবহার করেছে এই সংশোধনীর বৈধতার জন্য। ক্ষমতাসীন দল যখন এই রায়ের স্পিরিট উপেক্ষা করেছে, সেই সময়ে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিছুই বলেননি। উপরন্তু ২০১২ সালে দৈনিক মানবজমিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তাঁর লেখা রায়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে অমীমাংসিত মতবিরোধ রয়েছে, তার সমাধান নিহিত আছে এবং এতে সংকটও কেটে যাবে (দৈনিক মানবজমিন, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২)। অবশ্যই সংকট কাটেনি, আর সেই সমাধান কী, তার কোনো ব্যাখ্যা পাঁচ বছর পরেও আমরা পাইনি, কিন্তু একটি সর্বসম্মত রায়কে ‘অগণতান্ত্রিক’ ও ‘অপরিপক্ব’ বলে বর্ণনা করার জন্য তিনি দেরি করেননি।
বিচারপতি হকের বক্তব্য যে বাংলাদেশ এখন আর জনগণের প্রজাতন্ত্র নয়, বরং এটা বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে এই ধারণাই দেয় যে সংসদের করা আইন বা বিধান বাতিল করার ক্ষেত্রে আদালতকে নির্দিষ্ট সীমানা মেনে চলতে হবে যে বিচারকেরা কতটুকু পারবেন। অথচ বিচারপতি হক এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করবে, কিন্তু সেই আইন arbitrary হলো কি না, despotic হলো কি না, তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু বিচারকগণের ওপর ন্যস্ত, যাঁরা জনপ্রতিনিধি নন। এ কারণে আমরা (ইংল্যান্ডে) Dr. Bonham (১৬১০) এর মামলায় দেখতে পাই যে প্রধান বিচারপতি Sir Edward Coke বলেছেন যে Rule against bias দ্বারা কলুষিত কোনো আইনের বৈধতা থাকতে পারে না। অবশ্য তখনো Bill of Rights (১৬৮৯) আসেনি, যা King in Parliament–কে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করে। এখানেই আইনের শাসনকে অর্থবহ করে মহিমান্বিত করার দায় ও দায়িত্ব বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত’ (বিডিনিউজ২৪, ‘কখনও এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ঠিক নয়, তা যত মহান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হোন না কেন’, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭; http://opinion. bdnews24.com/bangla/archives/45207)। শুধু তা-ই নয়, তিনি এ-ও বলেছিলেন যে
‘যদি নির্বাহী বিভাগ অবৈধ আদেশ দেয়, আদালত তা সংশোধন করতে পারে। জাতীয় সংসদ যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইন প্রণয়ন করে, তাও সুপ্রিম কোর্ট বেআইনি ঘোষণা করতে পারে।’
আমরা নিশ্চয়ই তাঁর এই সাক্ষাৎকারের এ বক্তব্য অনুধাবন করতে পারি যে ‘কখনও এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ঠিক নয়, তা যত মহান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হোন না কেন’। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের মর্মবস্তু কি তাই নয়? আগের সংশোধনী বাতিলের ক্ষেত্রেও কি একই ধারণাই কাজ করেনি? আজকে বিচারপতি হক কেন তবে রাজনীতিবিদদের ভাষায় এই সমালোচনায় প্রবৃত্ত হলেন, সেটা যে কাউকেই কেবল বিস্মিত করবে না, অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দেবে।
এটা আমরা লক্ষ করি, বিচারপতি হকের তুলনায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি অনেক বেশি দায়িত্বশীল এবং অনেক অরাজনীতিবিদসুলভ। তিনি যে একথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে ‘দ্বিমত থাকলেও রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা আছে’, সেটা নিশ্চয়ই তাঁর দলের অন্যদের জন্যও শিক্ষণীয়। আশা করি তাঁরা সেটি লক্ষ করবেন। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সবকিছুর সঙ্গেই আমি একমত। ৯৬ অনুচ্ছেদ বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা সরকার আদালতে উপস্থাপন করেছিল কিন্তু তা যে আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, সেটা এই রায়েই স্পষ্ট। এখন তার পুনরুক্তি এতে নতুন কিছু যোগ করেনি। আইনমন্ত্রী যে ‘আপত্তিকর পর্যবেক্ষণ’ একপাঞ্জ করার আবেদন করবে বলে মন্তব্য করেছেন, তা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ বলেই বিবেচিত হতে পারে। কেননা তা একদিকে এক নতুন ধারা তৈরি করবে কি না, এবং প্রশ্ন উঠবে প্রধান বিচারপতির রায়ের সঙ্গে যাঁরা একমত হয়েছেন, তাঁদের কোন অংশ গ্রহণযোগ্য হবে এবং কোন অংশ হবে না?
তা ছাড়া আইনমন্ত্রী ৭০ অনুচ্ছেদবিষয়ক যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা-ও কতটা বাস্তবোচিত, সেটা বিবেচনা করা দরকার। কেননা, বিচারপতি খায়রুল হকও সেই প্রসঙ্গে বলেছেন। এই রায়ের প্রধান বিষয় ৯৬ অনুচ্ছেদ হলেও তাঁর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ৭০ অনুচ্ছেদ, এই অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও বিষয়, ফলে এ নিয়ে আলোচনা করা খুব জরুরি।
৭০ অনুচ্ছেদের অবাক ব্যাখ্যা
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের প্রধান বিষয় অবশ্যই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নয়; কিন্তু সংশোধনী বাতিলের রায়ে এই অনুচ্ছেদের ৩২ বার উল্লেখ এবং বাতিলের ভিত্তিভূমি হিসেবে ৭০ অনুচ্ছেদের পুনঃ পুনঃ আলোচনা আমাদের এই অনুচ্ছেদের গুরুত্ব এবং তার দীর্ঘ ছায়া স্মরণ করিয়ে দেয়। রায়ের পরে যে আলোচনা চলছে, তাতে যাঁরা বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্য আমাদের বিশেষ বিবেচনা দাবি করে। তাঁদের অবস্থান ও বক্তব্য দুই-ই এর কারণ। তাঁরা দুজনই এই ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে কথা বলেছেন। তদুপরি এই অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা একটি রিট পিটিশনের শুনানি হাইকোর্টে চলছে।
বিচারপতি খায়রুল হক ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে যা বলেছেন, তা তিন দশক ধরে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা সপ্রমাণ হাজির করেছেন, তার ঠিক বিপরীতে। তাঁদের এই বিপরীত অবস্থানের অধিকার অস্বীকার করা আমার লক্ষ্য নয়। শুধু এটা মনে করিয়ে দেওয়া যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করার পথে এই ধারার বিপদ নিয়ে বিচারপতি হক ২০০৬ সালে তাঁর দেওয়া রায়ে যে অবস্থান নিয়েছিলেন, ২০১৭ সালে আইন কমিশনের প্রধান হিসেবে তিনি সেই অবস্থানে নেই। বিচারপতি হক ২০০৬ সালে এক মামলার রায়ে মন্তব্য করেছিলেন যে ৭০ অনুচ্ছেদের বিধিনিষেধ একজন এমপিকে দলীয় বন্দীতে পরিণত করেছে (শাখাওয়াত লিটন, ‘সংসদের বাইরে এমপিরা স্বাধীন!’ ডেইলি স্টার বাংলা সংস্করণ, ২৫ মে ২০১৭)। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে খায়রুল হক এই ৭০ অনুচ্ছেদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বুধবার তড়িঘড়ি করে আইন কমিশনের নামে যে সংবাদ সম্মেলন করেন, তাতে বলেছেন, ‘বারবার বলা হয়েছে সাংসদেরা স্বাধীন নন। সংবিধানের ৭০ ধারা তাঁদের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। এ কারণেই যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা তাঁদের হাতে থাকা উচিত নয়, যাঁরা নিজেরাই স্বাধীন নন। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সাংসদেরা স্বাধীন। কারণ, ৭০ ধারায় বলা আছে, কোনো সাংসদ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। যদি দেন তবে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হবে। সংসদে ভোটাভুটিটা কিন্তু কোনো দলের পক্ষে-বিপক্ষে হয় না। একবারই দলের পক্ষে-বিপক্ষে হতে পারে, যখন নো-কনফিডেন্স মোশন থাকে। সে ক্ষেত্রে ৭০ ধারার কথা আসে।’ (প্রথম আলো, ১০ আগস্ট ২০১৭)।
একইভাবে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্য তথ্যনির্ভর নয়।’ আইনমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, যেহেতু ‘সময়-সময় তাঁদের [সাংসদদের] ফ্রি ভোট দেওয়ারও সুযোগ আছে’ এবং যেহেতু ‘বিচারপতিদের বিষয়ে পার্টি ভোট হবে না ফ্রি ভোট হবে’ তা এখনো নির্ধারিত হয়নি এবং যেহেতু ‘পার্টি লাইনে’ ভোট হবে এমন কোনো ‘ইঙ্গিতও ছিল না’, সেহেতু আদালতের ধারণা সঠিক নয়। ৭০ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গে একই ধরনের কথা খায়রুল হকও এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে ডিবেট বা ভোটাভুটিতে ৭০ অনুচ্ছেদের কোনো দলের ওপরে প্রভাব নেই (বিডি নিউজ ২৪, ‘কখনো এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ঠিক নয়, তা যত মহান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হোন না কেন’, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)।
গত কয়েক দশকে, বিশেষত ১৯৯১ সালে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তনের পর দেশের সংসদের কার্যক্রম এবং গণতন্ত্রের গতিধারা নিয়ে যাঁরাই গবেষণা করেছেন, তাঁরাই এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে ৭০ অনুচ্ছেদ দেশের গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করেছে (এ বিষয়ে উদাহরণ হিসেবে দেখুন, রওনক জাহান, পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জেস অব ডেমোক্রেটাইজেশন, প্রথমা, ২০১৫)।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের পূর্বসূরি হচ্ছে ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ জারি করা রাষ্ট্রপতির ২৩ নম্বর আদেশ, যাতে বাংলাদেশের গণপরিষদের সদস্যদের সদস্যপদ বাতিলের কথা ছিল। সেখানে দুটি কারণে সদস্যপদ বাতিলের বিধান করা হয়, যদি কোনো সদস্য যে দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন তা থেকে ‘পদত্যাগ করেন’ অথবা বা ‘ওই দল থেকে বহিষ্কৃত’ হন। খসড়া সংবিধানেও একইভাবে তা অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু সংসদে বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে সামান্য বদল করা হয়, সেখানে দল থেকে বহিষ্কার করার কারণে সদস্যপদ বাতিলের বিধান তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু তার বদলে এর চেয়েও কঠিন ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়—যদি দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তবেই সাংসদ পদ বাতিল হওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়।
এ বিষয়ে অনেকেই আপত্তি তোলেন এবং এই বিধানের বিষয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, ‘৭০ অনুচ্ছেদের মধ্যে এমন একটা অগণতান্ত্রিক বিধান রাখা হয়েছে, যা পৃথিবীর আর কোনো সংবিধানে নেই। এই বিধান নিয়ে সেদিন সাধারণ আলোচনার সময়েও বলেছিলাম, এই বিধান পাকিস্তানি ডিক্টেটর আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্রেই শুধু আছে। এ ছাড়া আর কোথাও এর নজির নেই।’ একে গণতন্ত্রের ‘টুঁটি টিপে হত্যা’ বলেই তিনি মত দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে গৃহীত সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে ৭০ অনুচ্ছেদে আরও ব্যাখ্যা সংযোজন করা হয়। ব্যাখ্যায় বলা হয়, যদি কোনো সাংসদ, যে দল তাঁকে নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত করেছে, সে দলের নির্দেশ অমান্য করে—(ক) সংসদে উপস্থিত থেকে ভোটদানে বিরত থাকেন, অথবা (খ) সংসদের কোনো বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তিনি ওই দলের বিপক্ষে ভোট দান করেছেন বলে গণ্য হবেন। ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীতে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আগের অনুচ্ছেদগুলো ও এর ব্যাখ্যা অক্ষুণ্ন রেখে অনুচ্ছেদটিতে দফা (২) ও (৩) সংযোজন করা হয়। যাতে বলা হয়, ‘যদি কোনো সময় কোনো রাজনৈতিক দলের সংসদীয় দলের নেতৃত্ব সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সংসদে সে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতৃত্বের দাবিদার কোনো সদস্য কর্তৃক লিখিতভাবে অবহিত হওয়ার ৭ দিনের মধ্যে স্পিকার সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী ওই দলের সকল সংসদ সদস্যের সভা আহ্বান করে বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের দ্বারা উক্ত দলের সংসদীয় নেতৃত্ব নির্ধারণ করবেন এবং সংসদে ভোটদানের ব্যাপারে অনুরূপ নির্ধারিত নেতৃত্বের নির্দেশ যদি কোনো সদস্য অমান্য করেন তাহলে তিনি (১) দফার অধীন উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেছেন বলে গণ্য হবে এবং সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে।’
এরপরের সংশোধনীটি হয় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৭৫ ও ১৯৯১ সালে সংযোজিত বিষয়গুলো বাদ দিয়ে এই অনুচ্ছেদকে ১৯৭২ সালের সংবিধানের জায়গায় ফেরানো হয়েছে। ফলে আমরা ১৯৭২ সালের যে পরিস্থিতিতে ছিলাম, সেখানেই প্রত্যাবর্তন করেছি।
সে কারণেই যুক্তি দেখানো হচ্ছে যে ৭০ অনুচ্ছেদ সাংসদদের কিছু স্বাধীনতা দেয় এবং বিশেষ করে পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে তা আরও শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু এখানে তিনটি বিষয় আমাদের বিবেচনা করা দরকার। প্রথমত, বাস্তবতা—পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে সংসদে কি এমন কোনো উদাহরণ তৈরি হয়েছে, যেখানে সরকারি দল, এমনকি সরকারি জোটের সাংসদেরা ক্ষমতাসীন দলের উত্থাপিত বিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ভোট দিয়েছেন? এমনকি যেসব সদস্য বিতর্কে অংশ নিয়ে বিভিন্ন বিলে সংশোধনীর প্রস্তাব করেছেন কিন্তু তা গ্রাহ্য হয়নি, তাঁরাও কি ওই সব বিলে সম্মতিসূচক ভোট দেননি? এই একই প্রশ্ন আমরা তুলতে পারি এমনকি জোট সদস্যদের ক্ষেত্রেও। দ্বিতীয়ত, সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের মধ্যকার সম্পর্ক—সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ কি আমরা কেবল ওই অনুচ্ছেদ দিয়েই বিবেচনা করব নাকি তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নয় অনুচ্ছেদগুলোও বিবেচনায় রাখব? যে সংসদের সংসদ নেতা, দলের সংসদীয় দলের প্রধান, দলের নেতা ও সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি এবং যাঁর হাতে সাংবিধানিকভাবেই ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ ঘটেছে, তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের সম্ভাবনা কতটুকু? তৃতীয়ত, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি—যে দেশের প্রধান প্রধান দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা, ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ অনুপস্থিত, সেখানে কেবল একটি সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ কোনো সাংসদকে তাঁর দলের বিরুদ্ধে
ভোট দেওয়ার সাহস জোগাবে, এমন মনে করার পেছনে যুক্তি পাওয়া অসম্ভব।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারে। কিন্তু এই রায়ে দেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার বিষয়ে যেসব পর্যবেক্ষণ আছে, সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে দেশের এবং সাংবিধানিক রাজনীতির জন্য ইতিবাচক কিছু অর্জনের সম্ভাবনা নেই। আইনমন্ত্রী বলেছেন যে সরকার বিচার বিভাগের সঙ্গে ‘পাওয়ার কনটেস্টে অবতীর্ণ হয় নাই’। এই বক্তব্য ইতিবাচক। এখন দেখার বিষয় তাঁর এই বক্তব্য তাঁর দলের ও সরকারের সদস্যদের আচরণে কতটা প্রকাশিত হয়।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ১২-১৩ আগস্ট ২০১৭