ডিসেম্বর 7, 2025
Health_care_self_potrait_Edvard_Munch

This post has already been read 16 times!

কোভিড-১৯ মহামারি স্বাস্থ্যসম্পর্কিত প্রচলিত তত্ত্ব এবং তা থেকে উৎসারিত নীতিকৌশলে অসংখ্য সীমাবদ্ধতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। সমগ্র নীতিকাঠামো এবং ব্যবস্থাপনায় বড় রকমের সংস্কার প্রয়োজন।

স্বাস্থ্যসেবা ও বাজারব্যবস্থা

বাজারব্যবস্থায় অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য ব্যক্তির চাহিদা পূরণে সক্ষম। সবার স্বাস্থ্যসেবা ক্রয়ের সামর্থ্য থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৮ সালে প্রায় ৩ দশমিক ৬৫ ট্রিলিয়ন ডলার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের জিডিপির চেয়ে এক ট্রিলিয়ন বেশি। তবু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন তথা ৮ দশমিক ৬ শতাংশ নাগরিক স্বাস্থ্যবিমার আওতার বাইরে রয়ে গেছে। ২০০৭ সালে মাইকেল মুর অস্কার মনোনীত চলচ্চিত্রে দেখিয়েছেন, নাইন-ইলেভেনের সামনের সারির যোদ্ধা ফায়ার সার্ভিসের আহত কর্মীরা স্বদেশে বঞ্চিত হয়ে কিউবায় গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিতে বাধ্য হয়েছেন।

বাংলাদেশের একজন নাগরিক নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্যসেবা বাবদ মোট খরচের ৭৪ শতাংশ ব্যয় করেন। এটা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ এবং বৈশ্বিক গড় (১৮ শতাংশ) থেকে অনেক বেশি। উচ্চমূল্যের কারণে এখনো অধিকাংশ মানুষ আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। সর্বশেষ খানা আয়–ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ মানুষ কবিরাজ, হাতুড়ে ডাক্তার কিংবা ওষুধের দোকানের কর্মীদের কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকে। মাত্র ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা পেতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হয়।

স্বাস্থ্যসেবাকে চাহিদা ও পণ্য হিসেবে না দেখে ব্যক্তির অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক প্রয়োজন হিসেবে দেখতে হবে। রংপুরে জন্মগ্রহণকারী উইলিয়াম বেভারিজ ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্যে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রবর্তনে নেতৃত্ব দেন। এ ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্র থেকে অধিকার হিসেবে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রবর্তনের বিকল্প নেই—এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হচ্ছে।

প্রতিষেধক ও চিকিৎসা

স্বাস্থ্যসেবা শুধু চিকিৎসা নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞায় রোগের অনুপস্থিতি নয় বরং শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে সুস্থ ও ভালো থাকা বোঝায়। প্রচলিত প্রবাদ, ‘আরোগ্যের চেয়ে প্রতিরোধ শ্রেয়’। প্রতিরোধ ও চিকিৎসা উভয়ই প্রয়োজনীয়। প্রতিরোধমূলক পূর্বব্যবস্থা খরচও কমায়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও সমন্বয়হীনতা রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা উভয় নিশ্চিতকরণে বড় ধরনের বাধা। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষার ঘাটতি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রচারণা জরুরি।

পরিবেশ ও জলবায়ু

স্বাস্থ্যসেবা–সম্পর্কিত আলোচনায় পরিবেশ ও প্রতিবেশের বিষয়টিও অবহেলিত থেকে গেছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা না গেলে মানুষের জীবনমান ও সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা সম্ভব নয়। প্রকৃতি ও পরিবেশকে উৎপাদনের কাঁচামাল তথা পণ্য হিসেবে বিবেচনা করায় প্রকৃতির ক্ষতি ত্বরান্বিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মানুষ ও প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। নতুন নতুন রোগজীবাণু পরিবেশে অবমুক্ত হচ্ছে। কোভিড-১৯–এর মতো অতিমারি প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে মানুষের বিযুক্তি, জীববৈচিত্র্যের বিনাশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনেরই অন্যতম পরিণতি।

ক্ষমতা ও আধিপত্য

বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাত গুটিকয় কোম্পানির হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এগুলো স্বাস্থ্যসেবার বদলে মুনাফা অর্জনেই বেশি মনোযোগী। কোম্পানিগুলোর নির্ধারিত দামে মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা কিনতে হচ্ছে। বৃহৎ ওষুধ কোম্পানিগুলোর ক্ষমতা ও আধিপত্যের কারণে স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বজনীন করা সম্ভব হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো গত বছর প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার লবিংয়ে ব্যয় করেছে। বিরোধী দল দাবি করছে, ক্ষমতাসীন দল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রেক্সিট-পরবর্তী বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে তাদের জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় করপোরেশনের হাতে তুলে দিতে চাইছে। মুনাফার তাড়নায় সর্বজন খাতের সবকিছুকেই নিজেদের করায়ত্ত করার চেষ্টারত। বাংলাদেশেও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীতন্ত্র অতি মুনাফা করে চলেছে। তারা নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করছে না। স্বাস্থ্যসেবা যেন ব্যক্তি খাতের শৃঙ্খলমুক্ত না হয়—তারা এ ব্যাপারেও সোচ্চার।

স্বাস্থ্যসেবা ও অভিজাত শ্রেণি

বাংলাদেশে প্রচলিত ব্যবস্থাগুলো মূলত ঔপনিবেশিক শাসনসূত্রে প্রাপ্ত। ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখতেই সংস্কার হাতে নেওয়া হয়েছিল। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর মাধ্যমে ইংরেজ শাসন-শোষণ পাকাপোক্ত করতে শিক্ষায় সংস্কার করা হয়েছিল। ১৮৩৫ সালের ‘ইংরেজি শিক্ষা আইন’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারতে এমন একটি শ্রেণি তৈরি করা হয়েছিল। দুটি বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ সীমাবদ্ধ ছিল সামরিক বাহিনীর মধ্যে।

বাংলাদেশ আমলে নানা ধরনের বাজারমুখী সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ‘খাতভিত্তিক কর্মসূচি’ নেওয়া হয়েছে। লাইন ডিরেক্টরেট চালু হয়েছে। আমলাতন্ত্রের আকার বেড়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই রয়ে গেছে। নিজেদের মতো সংস্কারের চেষ্টা করা হয়নি। ফলে জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী তথা অভিজাত গোষ্ঠী স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে মনোনিবেশ না করে বিদেশে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চলেছেন। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যায়। এ অর্থের প্রায় অর্ধেকই যায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। করোনাকালের প্রথম দিকে তাঁদের বিদেশে যাওয়াও অসম্ভব ছিল। নিজ দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে ব্রতী হলে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।

দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাস্থ্যসেবায় মাথাপিছু সরকারি ব্যয় বাংলাদেশে সর্বনিম্ন (৮৮ ডলার)। ভারতে ২৬৭ ডলার, পাকিস্তানে ১২৯ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ৩৬৯ ডলার এবং মালদ্বীপে দুই হাজার ডলার। করোনার পরও বরাদ্দ আগের মতোই রয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কমপক্ষে জিডিপির ৫ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলে; কিন্তু চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র দশমিক ৯ শতাংশ এবং বাজেটের ৫ দশমিক ১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ বরাদ্দও কার্যকরভাবে ব্যবহার হচ্ছে না।

প্রাথমিক সংস্কারের শুরু: সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা

স্বাস্থ্যকে সবার অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সর্বজনীন জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা চালু করা প্রয়োজন। ব্যাপক কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনতে হবে। এতে কাঠামোর সমন্বয় করবে জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন এবং কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে নির্বাচিত স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। প্রথমত, সব নাগরিকের নিবন্ধিত সাধারণ ডাক্তার থাকবে। দ্বিতীয়ত, বিশেষজ্ঞ হাসপাতালের সঙ্গে নিবন্ধিত সাধারণ ডাক্তারের মাধ্যমে সংযোগ বা রেফারেল ব্যবস্থা চালু থাকবে। এ ক্ষেত্রে একটি জাতীয় জনসংখ্যা তথ্যভান্ডার প্রয়োজন। জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে জন্ম, মৃত্যু, আয়-ব্যয়সহ নাগরিকের প্রয়োজনীয় সব তথ্য-উপাত্তের ডিজিটাল তথ্যভান্ডার থাকবে। এটি ব্যবহার করে অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি পরিচালনা করা যাবে। আদমশুমারিরও প্রয়োজন হবে না।

স্বাধীন স্বাস্থ্য কমিশন, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও গবেষণা

সবার জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কার্যকর করতে সাংবিধানিক সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন স্বাস্থ্য কমিশন আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসাসেবা–ব্যবস্থাকে পৃথক করতে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারকে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নামে দুটো আলাদা ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যশিক্ষা ও গবেষণাকে ঢেলে সাজাতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় স্বাস্থ্যশিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের একাংশ যাতে প্রশাসক হিসেবে গড়ে ওঠে এবং তারাই যাতে স্বাস্থ্য প্রশাসনে নিয়োজিত থাকে, তার আইনগত ভিত্তি তৈরি করতে হবে।

স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি

স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের ভোটে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত হবে। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি, নাগরিক সমাজের অংশীজন ও জনপ্রতিনিধিরা আনুপাতিক হারে নির্বাচিত হবেন। নির্দিষ্ট ভোক্তা অধিকার চার্টার থাকবে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরাসরি স্বাস্থ্য কমিশনের সঙ্গে কাজ করবে।

উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা টেকসই উন্নয়নের মূল নিয়ামকগুলোর একটি। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা উন্নত মানবসম্পদ তৈরি করে। বিশ্বব্যাংকের মানবসম্পদ সূচক ২০১৮ অনুযায়ী, ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন ও সংস্কার ছাড়া কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, স্বাস্থ্যের সঙ্গে জীবনের প্রশ্ন জড়িত। সুতরাং এই খাতের অগ্রাধিকার সর্বোচ্চ হওয়াই কাম্য। সব অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে আশু সংস্কার জরুরি। স্বাধীনতার ৫০তম বছরে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাই হোক অর্জনের অন্যতম লক্ষ্য।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত

থাম্বনেইলের ছবিসূত্র: বোস্টন গ্লোব

This post has already been read 16 times!

মন্তব্য করুন