গত বছরের সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখে রামুতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলার পুনরাবৃত্তি ঘটে গেল কাল পাবনার সাঁথিয়ায়। ঘটনার সূত্রপাত কথিত মতে, ফেসবুক। রামুতে উত্তম বড়ুয়া আর সাঁথিয়ায় রাজীব সাহা। রামুর উত্তম বড়ুয়া ছিলেন দরিদ্র দলিল লেখকের সহকারী আর রাজীব সাহা স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। রামুর ঘটনায় বলা হয়, উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুক ওয়ালে পবিত্র কোরআন কে অবমাননা করে ছবি পোস্ট করা হয়েছে। পরে অতি উৎসাহী স্থানীয় তথাকথিত জনতা (যাদের নাম পরিচয় খুঁজলে লজ্জা পেতে হয়) উত্তমের কথিত সেই ফেসবুকের স্ক্রিনশট কপি করে শত শত কপি রামুর ফকিরা বাজারে বিলি করে। সাঁথিয়ায় একই প্রক্রিয়ায় অভিযোগ করা হয় রাজীব সাহা তার ফেসবুকে মহানবী (সাঃ)এর নামে সম্পর্কে কটূক্তি করেছে। রামুর ঘটনার সূত্রপাত হয় সন্ধ্যার সময় এবং প্রথম আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে রাত ১২.০০ টার সময়। সাঁথিয়ায় ঘটে দিনের বেলায়। ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ৩ নভেম্বর প্রায় সবকটি জাতীয় দৈনিক এ খবর ছেপেছে। রামুর ক্ষেত্রে যেটা দেখেছি তা হল- কোন পত্রিকা পরিস্কারভাবে সঠিক ঘটনাক্রম উল্লেখ করেনি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেসব তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে তাতেও স্পষ্ট সময় উল্লেখ ছিল না। তাই আমি পত্রিকায় খুঁজছিলাম সাঁথিয়াতে- কবে, কখন, কে আক্রমণ শুরু করল? কি উদ্দেশ্য ছিল? কীভাবে ঘটল, ইত্যাকার সব বিষয়। রামু যেন চোখ খুলে দেওয়া একটি দুর্ঘটনা। সাঁথিয়া ঘটনা বর্ণনায় কেবলমাত্র “প্রথম আলো” একটি ঘটনাক্রম তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে। এখানে কার কি ভূমিকা তা বোঝার জন্য এই ঘটনাক্রম উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।
যেভাবে শুরুঃ
১। সকাল ১০ টা- বনগ্রাম বাজারে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, স্থানীয় ব্যবসায়ী বাবলু সাহার ছেলে রাজীব সাহা, যার বয়স ১৫ বছর, সে ফেসবুকে মহানবী (সাঃ) সম্পর্কে কটূক্তি করেছে।
২। সকাল ১১ টা- ফেসবুকের একটি পাতার ফটোকপি বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সে ফটোকপিতে নামসহ কভার ছবি, প্রোফাইল ছবি ও একটি পোস্ট ছিল। ফেসবুক পাতাটির নাম ছিল আপত্তিকর এবং কভারে একটি আপত্তিকর কার্টুন ছিল।
৩। সকাল ১১-১২ টা- ফটোকপি ছড়িয়ে পড়ার পর গ্রামে-মহল্লায় সবার মাঝে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজিত জনতা স্থানীয় ব্যবসায়ী বাবলু সাহার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছেলে রাজীব সাহাকে হাজির করতে বলে।
৪। দুপুর ১২ টা- রাজীব সাহাকে হাজির না করার ফলে উত্তেজিত জনতা বাজারের মাঝ দিয়ে যাওয়া ঢাকা-পাবনা মহাসড়কে গাছের গুড়ি ফেলে অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে।
৫। দুপুর ১২ টা – ০০ রাস্তায় বিক্ষোভ চলাকালীন সময় মহাসড়কের পাশের বনগ্রামের ঘোষপাড়া ও সাহাপাড়ায় ভাঙচুর শুরু করে। তারা প্রথমে বাবলু সাহার বাড়িতে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে ঘোষপাড়ায় আরও ২৫টি বাড়ী ও ২টি মন্দিরে ভাংচুর করে।
৬। এরপর তারা বনগ্রাম বাজারে বাবলু সাহার দোকানসহ আরও কিছু দোকানে ভাংচুর চালায়। এসময় অন্য দোকানদাররা বাবলু সাহাকে একটি কক্ষে লুকিয়ে রাখে।
৭। সময় উল্লেখ নেই- খবর পেয়ে সাঁথিয়া ও আতাইকুলা থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করলে স্থানীয় জনতা তাতে বাধা দেয়।
৮। দুপুর ১.৩০ টা- ৪.০০ টা- পাবনার পুলিশ সুপার মেরাজ হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ ও র্যাব এর একটি বড় দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে বাবলু সাহাকে উদ্ধার করে। এসময় পুলিশের সাথে বিক্ষুব্ধ জনতার ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। পড়ে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিপেটা করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
৯। বিকাল ৪.০০ টা- পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়িন্ত্রনে আসে।
একই ঘটনার বর্ণনায় অন্য একটি দৈনিক (“নিউ এজ”) বলছে- অন্তত ১১টি বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম গ্রামে। পুলিশ ও স্থানীয় সুত্র বলছে- সকালে একদল যুবকের গুজবের উপর ভিত্তি করে কয়েক ঘণ্টা ধরে এই আক্রমণ চালানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বলা হয়, স্থানীয় কিছু ব্যক্তি স্থানীয় বাজারে কম্পিউটার থেকে একটি ফেসবুক গ্রুপের ছবির প্রিন্ট দেখায় এবং ইসলাম ও নবীজীকে অবমাননা করা হয়েছে দাবী করা হয়। লোকজন উত্তেজিত হয়ে, মিয়াপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেনিতে পড়ুয়া রাজীব সাহার বাড়ী আক্রমণ করে, যার ফেসবুকে এই অবমাননার ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়। আক্রমণকারীরা রাজীবকে না পেয়ে তার বাবা বাবুল সাহাকে সকাল এগারটার দিকে গ্রামের বাজারে বেঁধে পেটাতে থাকে এবং অবশেষে তার বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের দোকানে হামলা চালিয়ে মুল্যবান জিনিস লুটপাট করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান যে, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় কমপক্ষে ১১টি বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে।
শুধু এই দুটি সংবাদপত্রের রিপোর্ট পর্যালোচনা করলেও বেশ কয়েকটি বিষয় ধরা পড়ে- প্রথমত- ঘটনার ধারাবাহিকতা (sequence) খুব স্পষ্ট নয় যেটা খুব জরুরী। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী সকাল ১০ টায় ঘটনার সুত্রপাত হলেও পুলিশ ঠিক কোন সময় ঘটনাস্থলে যায় তা ঠিক পরিস্কার নয়। পুলিশ থানা থেকে বের হওয়ার আগে জিডি করে বের হয় এবং থানায় ফিরেও রিপোর্ট লিপিবদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, অন্তত আইন তাই বলে, সেখান থেকে সঠিক তথ্য পাওয়া যেত। কিন্তু available তথ্য বিশ্লেষণ করলে ধারণা করা যায়- পুলিশ অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শেষ হওয়ার পর দুপুর ১.৩০টা থেকে ৪.০০টার মধ্যে যেকোন সময় ঘটনাস্থলে পৌঁছে টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে! কিন্তু এরপর আর কি ভয়াবহ পরিস্থিতি ঘটেছে যা তারা নিয়ন্ত্রণ করেছেন তা ঠিক স্পষ্ট নয়। কিন্তু যে প্রশ্নগুলির উত্তর দরকার তা হচ্ছে, পুলিশের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যেতে এতো সময় লাগল কেন? রামুর ঘটনায় তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পুলিশের পোশাক (uniform)পরা না থাকলে নিজেও আগুন দেয়ায় সামিল হতেন বলে বলেছিলেন এমনটি সরকারী প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। সেই ওসিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ক্লোজ কর হয়েছে! এই ক্লোজ করা একটি ফৌজদারি অপরাধের প্রকৃত শাস্তি কিনা সেটা নিয়ে বিশদ লেখার ইচ্ছে আছে বিধায় সে আলোচনায় আপাতত গেলাম না। সাঁথিয়াতেও সেরকম বিষয় ছিল কিনা তা আমদের জানতে হবে। এটি জানতে পারলে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ কি ভাবনা নিয়ে দেশ শাসন করছেন তা জানার আগ্রহ থেকে হয়ত বিশাল আকারের গবেষণাও হয়ে যেতে পারে। রামুতে যে প্রশ্ন উঠেছিল তা এখানেও উঠবে- আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি করছিল? তাদের কাছে কি কোন খবর ছিল না। বাংলাদেশে এমন কোন অঞ্চল নেই যেখানে “এন এস আই” এর গোয়েন্দা কায্যক্রম নেই। ঘটনার চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- ফেসবুক কোন ইস্যু নয়। একইদিনে স্থানীয় মাননীয় প্রতিমন্ত্রী কোন এক মাদ্রাসার উদ্বোধন উপলক্ষে এলাকায় অবস্থান করছিলেন! তাঁর কোন মন্তব্য বা কর্মকাণ্ডের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। রামুতে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নিম্নসারির নেতারা গুজব সৃষ্টি এবং প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল – যা সরকারী দুটি তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে- পরবর্তীতে অপরাপর সকল বিরুদ্ধ রাজনৈতিকদলগুলোর মধ্যে এক প্রকারের ঐক্য সৃষ্টি হয় এবং এই fraternity ৫০টির মত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বাড়ী, দোকান এবং ১৩টি বৌদ্ধ মন্দিরে আগুন দিতে মূল ভুমিকা পালন করে। সাঁথিয়ার ঘটনায় এই fraternity-ই কাজ করেছে কিনা তা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। রামুর ঘটনায় “মোটিভ” কি ছিল তা কোন প্রতিবেদনেই উল্লেখ নেই। বলা হয়েছে এটি বের করার জন্য সকল গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বিত উদ্যেগ প্রয়োজন। জানি না সেই সমন্বিত উদ্যেগ এদেশে কখনো নেয়া হবে কিনা তবে এখন অবধি হয়নি এটাই সত্যি।
সাঁথিয়ার ঘটনাও রামুর ঘটনার মত উদ্দেশ্য বা মোটিভ নিয়ে বেশ সন্দেহ সৃষ্টি করে, যেমন- রাজিবের বাবাকে (নিউ এজ এর মতে) বেঁধে পেটানো ছাড়া আর কাউকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে বলে কোথাও উল্লেখ নেই। শুধুমাত্র রাজীবের বা তাঁর বাবার উপর যদি রাগ হত তাহলে অন্য ২৫টি বাড়ীতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ কেন? দেখা যাচ্ছে এসব ঘটনায় (হামলায়) লুটপাট একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। রামুতেও হয়েছে, সাঁথিয়ায়ও তাই।
এবার আসি অন্য একটি প্রসঙ্গে- রামুতে তথাকথিত জনতা এতটাই উত্তেজিত ছিল যে তারা হিতাহিত জ্ঞ্যান হারিয়ে ফেলেছিল- ইসলামের অবমাননা অনেকের বুকে তীব্র প্রতিশোধের আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। এরকম ঘটনাগুলোতে সাধারণত যা দেখা যায় আক্রমণকারীরা আক্রান্তের ধন সম্পদ লুট করার পাশাপাশি নারীদের ধর্ষণ করে। পাকিস্তানীরা আমাদের তাই করেছিল। রক্ত দূষণ করা ছিল যার মূল উদ্দেশ্য। ইরাক যুদ্ধে আমেরিকানরা তাই করেছে। অন্যান্য যুদ্ধগুলো বিশ্লেষণ করলে একই বিষয় দেখা যাবে। এমন কি ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় এমনটি ঘটেছিল। রামুতে তা হয়নি, সাঁথিয়াতেও না। অনিয়ন্ত্রিত আক্রমণ হবে অগোছাল, যাচ্ছে-তাই। কে কি করছে কারো উপর কারো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। কিন্তু রামুর ঘটনা আশ্চর্যজনকভাবে সুনিয়ন্ত্রিত! সাঁথিয়াতেও তাই মনে হচ্ছে। দুটো ঘটনার প্রাথমিক বিশ্লেষণে মনে হয়- কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে এই ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে। তবে সেটি, বরাবরের মতই, কেবল “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার জন্য” বলে মনে করার কোন কারণ নেই। রামুতে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে সরকারী রিপোর্টে প্রকাশ, তাই সরকার তার অনুগামীদের দিয়ে বিচার বানচাল করার ষড়যন্ত্র করবে, এই যুক্তি ধোপে টেকে না। তাই সাঁথিয়ার ঘটনার সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন এবং সেটি নিয়মিত গোয়েন্দা বাহিনী দিয়েই।
রামু ও সাঁথিয়া দুটো ঘটনাতেই একটি বিষয় একই- ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম ও মহানবীকে অবমাননা। সেটি দেখে ধর্মপ্রাণ মানুষের উত্তেজনা। এই ক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায়, উত্তেজনা প্রশমনের জন্য যে ধর্মের অনুসারী এই ধর্মীয় অবমাননা করেছে তার ধর্মের উপর আঘাত করে উত্তেজিত ধর্মপ্রাণ জনতা প্রত্যাঘাত করতে চাইবে। কিন্তু এর সাথে লুটপাট কেন? তাহলে কি ধরে নেব যে, ধর্মীয় উত্তেজনার সাথে প্রাপ্তিযোগও আনুষঙ্গিক বিষয়?
রামু ও সাঁথিয়ার ঘটনায় ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে- স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- যারা এই ধর্মীয় অবমাননা হয়েছে বলে মনে করলেন তাদের ধর্ম বোঝার ক্ষেত্রে কতটুকু শিক্ষা ছিল? তাদের জীবনাচারের মধ্যে ধর্মের প্রকৃত প্রভাব কতটুকু? তাছাড়া, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, রাজীব তার ফেসবুকে ইসলাম ধর্মের অবমাননাকর কোন মন্তব্য করেছিলেন বা পোস্ট করেছিলেন, তাই বলে আম জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নিলেন কেন? বাংলাদেশের ফৌজদারি দন্ডবিধিতে এটিকে সুস্পষ্টভাবে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে এর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া, বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নামক কালো আইনটির মধ্যেও ন্যূনতম ৭ বছর এবং সর্বোচ্চ ১৪ বছর জেল ও এককোটি টাকা আর্থিক জরিমানার কথা বলা হয়েছে। তারপরও আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া কেন? আর, এই ঘটনাগুলো প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে যদি বিদ্যমান আইনগুলো পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখতে না পারে তবে নতুন করে আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে হবে। একই সাথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
রামুর ঘটনায় হাজার হাজার মানুষের একসাথে আক্রমণের কথা বলা হয়েছে। রাতের ঘটনা বিধায় এবং আক্রমণকারীরা সশস্ত্র ছিল বিধায় কারো উপায় ছিল না সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা। তাই যা বলা হয়েছে তার পুরোটাই অনুমান নির্ভর। পুলিশ তদন্ত করে মোবাইল ফোনের অবস্থান নির্ণয় কিংবা কল ট্রাফিক পরীক্ষা করে বের করতে পারত- কতজন অংশ নিয়েছিল সেই আক্রমণে।
সাঁথিয়ার সাম্প্রদায়িক আক্রমণ নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই লেখা লেখার সময় অবধি কোন মন্তব্য পাওয়া যায় নি। জানি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেতৃবৃন্দ এর চেয়েও অনেক বড় বড় বিষয়ের সমাধান করতে ব্যস্ত। কিন্তু তাতে বিপন্ন মানুষের মর্যাদা, সম্মান বা নিরাপত্তা বোধ কোনটাই ফিরে আসবে না। আর তাই আমরা চাইব- এই দায় চাপানোর সংস্কৃতি চিরতরে বন্ধ হোক। পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হোক যাতে প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়ে। কেউ যেন ভেবে না বসে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলেই অপরাধ করে পার পাওয়া যায় বা যাবে। সমাজের সাম্য যদি ধরে রাখতে হয় তাহলে অপরাধীর শাস্তি হওয়াটা খুবই জরুরী। আর অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার এ এক পূর্ব শর্ত।
আমাদের সৌভাগ্য যে, এখন পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল অপর দলের উপর সাঁথিয়ায় এই সাম্প্রদায়িক আক্রমণের দায় চাপাননি। রামুতে ঘটনার দিন থেকেই এই নাটক শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই নাটকের সবচেয়ে খারাপ দিক হিসেবে উভয় দলের নিম্নসারির স্থানীয় নেতারা এখন প্রভাবশালী নেতায় পরিণত হয়েছে, কিংবা প্রভাবশালীর আশ্রয় প্রশ্রয় পাচ্ছে- ফলে তারা গ্রেফতার হচ্ছে না। হলেও খুব তাড়াতাড়ি জামিনে বের হয়ে আসছে। এতে এলাকায় আইনের প্রয়োগ ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ প্রগাঢ় হচ্ছে। এটি সমাজের পূর্বের অবস্থা ফিরে আসার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে মানুষের মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি বিরাজ করত। আশা করছি সাঁথিয়ার ঘটনা এসব থেকে মুক্ত থাকবে।
রামুর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রামুতে সব ধর্ম বর্ণের মানুষের মিশ্রণে যে সমাজ ছিল তা ভেঙে এক রাতে কমিউনিটিতে রুপান্তর করেছে। কমিউনিটি বোধ প্রকারান্তরে ধর্মীয় পরিচয়ের অবস্থান নির্দেশ করে। রামুতে তা ছিল না। রামুবাসি আমরা বৌদ্ধ, আমরা আলাদা- এই শিক্ষা নিয়ে আমরা বেড়ে উঠিনি। এখন সংবাদপত্রের বদৌলতে আমরা কমিউনিটির ছোট্ট গন্ডির মধ্যে আটকা পড়েছি। এই বোধ আগামী বেশ কিছু প্রজন্মকে তাড়া করবে এবং এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে/করবে। সাঁথিয়াতে সংঘটিত আক্রমণের বর্ণনা দিতে গিয়ে, নিউ এজ পত্রিকার সংবাদদাতা পরিস্কার করে কোটেশন মার্কের মধ্যে উল্লেখ করেছেন, ‘Hindu-majority village’ were set on fire during the attacks মনে হচ্ছে সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন আগে থেকেই কমিউনিটি বোধের মধ্যেই ছিলেন। আস্ত সমাজের অংশ ছিলেন না। যদি সেটা সংবাদদাতার বোঝার ভুল হয় তাহলে তাকে বলব বিষয়টি নিয়ে অন্তত দশবার ভাবতে, আর যদি সত্যিকার অর্থেই হিন্দুরা কমিউনিটির অংশ ছিলেন, তাহলে এই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের উপর হামলার ঘটনা তদন্ত কতদূর এগোবে তা আগে থেকেই বলে দেয়া যায়। দেলওয়ার হোসেন সাইদি কে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজব সৃষ্টি করে সারা দেশে এ পর্যন্ত একশরও বেশী হিন্দুদের মন্দির ভাংচুর করা হয়েছে, লুটপাট করা হয়েছে অনেক বাড়ী, দোকান। সেসব নিয়ে দেশজুড়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই। কোন সংগঠিত আন্দোলন নেই। কেউ প্রশ্ন করে না- রামুতে সব মন্দির রাষ্ট্রীয় খরচে নির্মাণ করা হলে সাঁথিয়াতে তা নয় কেন, হিন্দু মন্দিরগুলো নয় কেন, বাড়ীগুলো নয় কেন? সাঁথিয়াতে মোট ২৬টি বাড়ী-ঘর ও ২টি মন্দিরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ উঠেছে। আমরা আশা করব সরকার কোন প্রকার দ্বিতীয় চিন্তা ছাড়াই এইসব বাড়ী-ঘর ও মন্দির রাষ্ট্রীয় খরচে পুনঃনির্মাণ করে দেবে। কেননা, এটি দয়া দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়, এটি রাষ্ট্রের দায়/দায়িত্বের বিষয়। কেননা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সকল নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেটি যখন রাষ্ট্র দিতে ব্যর্থ হয় তখন রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব থাকে পীড়িতের দুঃখ মোচনের উদ্যেোগ নেয়ার।
এখানে আর একটি কথা না বললেই নয়- রামুর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর (আমারই করা) একটি মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট বিগত ৩ অক্টোবর ২০১২ ইং তারিখে, দেশের সকল মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডাসহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন যা এখনো বলবৎ আছে। অথচ এই আদেশের পরপরই বাইতুল মোকারম মসজিদে আগুন দেয়া হয়। শতাধিক হিন্দুদের মন্দিরে আগুন ও লুটপাট চালানো হয় (মার্চ-মে ২০১৩)। এ বছরের আগস্টে মাটিরাঙ্গার তাইন্দঙ্গে প্রায় চারশ মানুষের উপর নির্যাতন চালিয়ে ঘরছাড়া করা হয়, একটি বৌদ্ধ মন্দিরে আগুন দেয়া হয়। এখানে মনে রাখা দরকার, বাইতুল মোকারম কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনার জায়গা হলেও নাগরিক হিসেবে এটির উপর সকলের দাবী রয়েছে। আমি মনে করি বাইতুল মোকারম আমার সম্পদ, তেমনি তাকে রক্ষার দায়িত্বও আমদের সকলের। এই বক্তব্য সকল প্রার্থনালয়, উপাসনালয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
রামুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে করা রিট মামলার চূড়ান্ত শুনানি এখনো হয়নি। সে অর্থে এখন পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ছিল কি ছিল না, তা নিয়ে কোন সমাধানে আসা যায় নি। এটি বিগত মে মাস থেকে আদালতের কার্য তালিকায় আছে, হয়ত অদূর ভবিষ্যতে চূড়ান্ত শুনানি হয়ে যাবে। সাঁথিয়ার ঘটনা নিয়ে এর চেয়েও দ্রুত গতিতে সমাধানে আসা জরুরী। কেননা, মানুষ ভুল থেকেই শেখে। রামুর ভুল আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সাঁথিয়ার এই ঘটনাই অপ্রত্যাশিত। তাই এবার দেখার পালা সাঁথিয়া আমাদের কি শেখায়?
লেখাটি মনযোগ দিয়ে পড়েছি। আমি বর্তমানে পাবনাতে আছি এবং ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমার জানা। কারণ পাবনা থেকে জাতীয় পত্রিকায় দীঘদিন কাজ করার ফলে স্থানীয়ভাবে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি আছে। অপরদিকে স্থানীয় হিন্দু নেতাদের সাথে আমার বেশ ভাল বন্ধুত্ব রয়েছে। ফলে ঘটনার ভেতর এবং বাহির দুটোই জানা আছে। সাথে সকালে আমার এক অনুজ প্রতিম বর্তমানে সুপ্রীম কোটের আইনজীবি – তাঁর সাথে কথোপকথনে আম বেশ মর্মাহত। আমাদের উচিত যেহেতু আমার এদেশের নাগরিক সেহেতু আমাদের নাগরিক হিসেবে সাংবিধানিক অধিকার ভোগ পাওয়ার অধিকার আছে। এবং সেটি আদায়ের জন্য অন্য সকল নাগরিকদের মত আমাদেরও অধিকার চাইবার অধিকার আছে। এতে যদি কেই সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করে সে আমার অহংকার। আমি লেখকের সাথে একমত। আমার কথা হল যদি বাচতে চাও মাথা উচু করে বাচো আর যদি না পারো তবে মৃত্যুও ভাল।
আমরা কেন নিজেদের বাংলাদেশের নাগরিক বলে পরিচয় দেয় না। কোনো বিশেষ গোষ্ঠি কে সংখ্যা লঘু বলে কি তাদের নাগরিক আধিকার ক্ষুন্ন করি না। আমার খুব কষ্ট হয় ্যখন দেখি সংখ্যা লঘু বলে আমার দেশের লোককে ছোট করা হচ্ছে।
রামু বা সাথিয়া আমাদের দু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ধর্মীয় বদ মেজাজ কততা ভয়ংকর। এ নিয়ে যত কথা হয়েছে তাতে সমস্যার মুলে কেউই যাওয়ার চেষ্টা করেন নি। সেটা কে রাজনৈতিক রঙ লাগাতেই সবাই ব্যাসত। যে কোন ধর্মের অবমাননা প্রসাশনিক ভাবে আইনের আওতায় আনতে হবে। অবমাননা দু প্রকারের হয়। ১) যারা এই অবমাননার মতো বিপদজনক অপকর্মটি করে ২) যারা এটাকে পাবলিক এর মাঝে ছড়ায় ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টির জন্য। প্রথম জন তো তার কর্মের দ্বারা অবমাননা করলই তবে তা ছিল সীমিত পরিসরে, কত জন মানুষ আর আ টি ব্যাবহার করে, কয় জন এই বা এটি জানল, দ্বিতীয় পক্ষ এটি কে ফুলিয়ে ফাপিয়ে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিল। তাতে ধর্মের বৃহত্তর অবমাননা হল। রুল অফ ল দ্বারা এর প্রতিকার হলে ধর্মানুসারী মানুষ স্বস্তি পাবে। আইন নিজের হাতে তুলে নিবে না। দুঃখজনক হলে ও সত্য যে শাসক শ্রেণী বিশেষ করে আওয়ামীলীগ এই কার্ড টি নিয়ে নিচক রাজনৈতিক খেলায় মত্ত থাকে প্রায়শঃ, এটা আত্ম বিধ্বংসী, ভয়ঙ্কর। এটা বন্ধ হওয়া জরুরি। নইলে আমরা নিজেদের সভ্য মানব প্রজাতি হিসেবে দাবি করতে পারবনা কোন কালেই।
একটি কথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনতার মনে রাখা উচিত- রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জে কি বলেছেন মনে নেই? তিনি বলেছেন – একের অপরাধে অন্যকে দায়ী করা যাবে না, ভাইয়ের অপরাধে ভাইকে, গোষ্ঠীর কোন একের অপরাধে গোষ্ঠীকে দায়ী করা যাবে না। প্রত্যেকে তার নিজের অপরাধের জন্য নিজে দায়ী। এই সব অপরাধের বিচার রাষ্ট্রের হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিত। আপনার দায়িত্ব প্রতিবাদ করা, প্রতিহত করা নয় যেখানে রাষ্ট্রই এ ব্যাপারে আইন করেছে। আপনার প্রতিবাদ রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে দ্রুত। আর সবার প্রতি অনুরধ, অন্যকে আঘাত দিয়ে নিজে নিরাপদ থাকতে পারেন না, এমন ভয়ংকর খেলা খেলবেন না কারো কোথায় প্ররোচিত হয়ে।
মুসলিম জনতার মনে রাখা উচিত আল কুরআন এর বাণী- তোমার প্রতিবেশী ভিন ধর্মী তোমার নিকট পবিত্র আমানত। যে ব্যাক্তি আমানত খেয়ানত( তসরুপ) করে সে কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না। জান্নাতে যেতে চান? তা হলে নিজেকে সংবরন করুন। কুরআন হাদিস মেনে চলুন, এর উপর ই আপনার আমার ধর্ম দাড়িয়ে আছে। কুরআন হাদিসের নির্দেশ অমান্য করলে আপনি কার ধর্ম পালন করলেন? আর একটি কথা জরুরি- আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বলেছেন- ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না, কারন ইতিপূর্বে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে।
বিশ্লেষণধর্মী লেখা খুবই ভাল লাগল । লেখকের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে; এদেশে আমি কোন নাগরিক নই বলে মনে হচ্ছে ।
এমন লেখা আরো দরকার।