সাভারের মর্মান্তিক ঘটনার পর উদ্ধার কাজ, আহতদের চিকিৎসা, ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন, অভিযুক্তদের গ্রেফতার, বিচার প্রক্রিয়ার আইনি দিক শুরু এ সব যখন চলছে তখন তাঁর পাশাপাশি আরো কিছু দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে বলেই অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়। যারা সাভারের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে এসেছেন – সাধারণ মানুষ – তাঁরা এই ঘটনাগুলোর ওপরে নজর রাখতে পারবেন না – কেননা তাঁরা যথার্থভাবেই এখন নিহত এবং আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁরা তাঁদের সাধ্য দিয়ে মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছেন। তাঁদের কাছে আশু কাজগুলোই জরুরি। কিন্ত এ সব বিষয়ে আইনজীবীদের উচিৎ এগিয়ে আসা এবং অন্যদের – বিশেষত মানবাধিকার সংগঠন এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর – উচিৎ সে বিষয়ে নজর রাখা, সরকার ও সংশ্লিষ্টদের ওপরে চাপ সৃষ্টি করা। অন্যথায় কয়েক দিন পরে আমরা আবিষ্কার করবো দীর্ঘ মেয়াদে শ্রমিকদের বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে যেগুলো তাঁদের কার্যত সাহায্য না করারই সামিল। উদাহরণ দিলে আমার বক্তব্যটা বুঝতে সুবিধা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে মালিকরা এক হাজার লোকের চাকরি দেবে। লক্ষনীয় যে তা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী, মালিকরা নয়। সংখ্যার দিক থেকে তা মোটেই নিহত বা আহতদের সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ন নয়। আহতের সংখ্যা যেখানে দুই হাজারের বেশি সেখানে কারা এই চাকরি পাবেন তা বলা হচ্ছে না। অনুমান করা যায় যে নিহতের সংখ্যা ৫শ’র বেশি হবে। তাঁদের পরিবারের কি হবে সেটা বলা হচ্ছে না। যে সব শ্রমিক নিহত হয়েছে তাঁদের এককালিন টাকা দেয়ার মানে হল তাঁদের আর কোন দায়িত্ব নেয়া হলো না। ফলে এটা নিশ্চিত করা দরকার যাতে নিহতদের পরিবারের জন্যেও চাকরি বা স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করা হয়। সে কারণে এটা সুনিশ্চিত করা দরকার যে প্রতিশ্রুত এই চাকরির সংখ্যা বাড়াতে হবে। আহতদের এই সব চাকরিতে নিয়োগ করা হলে তাঁদের জন্যে কর্মক্ষেত্রে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। এই ধরণের চুক্তির বাস্তবায়ন মনিটরিং করার জন্যে শ্রমিক, সাংবাদিক, আইনজীবি, বিচারক, শিক্ষাবিদদের নিয়ে কমিটি করা হোক। এই ধরণের প্রতিশ্রুতি যদি মালিকরা দিয়ে থাকেন তবে তাঁর জন্যে বিজিএমইএ’র সঙ্গে আইনানুগ প্রকাশ্য চুক্তি হোক। বাস্তবায়নে সময়সীমা বেধে দেয়া হোক, তাঁর ব্যর্থতার জন্যে শাস্তির বিধান থাকুক, সমিতি ব্যর্থ হলে সরকারের সুনির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকুক যেন তাঁরা বাস্তবায়ন করে। অন্যথায় এগুলো অন্য অনেক প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি কিছু হবে বলে মনে হয়না।
যারা আহত হয়েছেন তাঁদের মাসে ১০ হাজার টাকা করে দেবার ঘোষণাটাতে অস্পষ্টতা আছে – প্রধানমন্ত্রী বলেছেন “তারা যাতে মাসে অন্তত ১০ হাজার টাকা করে পান, আমরা এ ব্যবস্থা করব।”তার মানে কে দেবে তাঁর কোনো নিশ্চয়তা নেই। সরকার দিতেই পারে, তাঁর দায়িত্বও বটে; কিন্ত তাঁর অর্থ হল মালিকদের অপরাধের দায় সারাদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হল। সরকার সেটা মালিকদের কাছ থেকে কিভাবে আদায় করবেন সেটা জানানো দরকার। কতদিন পাবেন আহতরা এই অর্থ? কিভাবে তা মনিটরিং করা হবে? এই তালিকা কে কবে তৈরি করবে? আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতায় শেষ পর্যন্ত তা যে বাধা পড়বেনা তাঁর নিশ্চয়তা কে দেবে?
যারা আহত হয়েছেন তাঁদের চিকিৎসার আশু ব্যবস্থায় অনেকে এগিয়ে এসেছেন। কিন্ত আহতদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন হবে অনেক দিন ধরে। (আমার আশংকা যারা স্বেচ্ছায় উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন, যে সব বাহিনীর সদস্যরা কাজ করেছেন তাঁদের অনেকেও ভবিষ্যতে বিভিন্ন রকম অসুস্থ্যতায় পড়তে পারেন।) যারা আহত হয়েছেন তাঁদের দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসার জন্যে সরকারের দরকার দ্রুত পরিকল্পনা নেয়া দরকার। সেটা করা দরকার চিকিৎসকদের সাথে নিয়েই। সে জন্যে জন্যে একটা তহবিল তৈরি করা দরকার। সেটা আসা উচিৎ মালিকদের সংগঠন থেকে (এবং যারা অপরাধী তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াফত যদি করা হয়ে থাকে); তাতে সাধারণ মানুষ, অন্যান্যরা চাইলে অর্থ দিতে পারবেন। এই জন্যেও একটা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাতে করে এক ধরণের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, সরকার বা সমিতির নেতৃত্ব বদলের ফলে এই দায়িত্বে যেন ভাটা না পড়ে।
গার্মেন্টস শিল্প এলাকায় হাসপাতালের জন্যে আগেও দাবি করা হয়েছে। কিন্ত তাতে সরকার ও মালিকরা কর্ণপাত করে নি। এখন আশা করি তাঁদের কানে পানি যাবে। তবে অভিজ্ঞতা বলে তাঁর সম্ভাবনা কম। বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে সরকার উদযোগ নিয়ে সে আলোচনা অবিলম্বে শুরু করতে পারে। কিন্ত রাতারাতি হাসপাতাল তৈরি হবেনা। ফলে আহতদের চিকিৎসার জন্যে সাভার, ঢাকা এবং দেশের অন্যত্র কয়েকটি হাসপাতালের সঙ্গে সরকার ও গার্মেন্টস মালিক সমিতি একটা চুক্তি করতে পারেন যে সাভারের ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে এসব হাসপাতালে।
রানা প্লাজায় আরো যাঁদের ব্যবসা ছিল, বিশেষত ছোট ছোট দোকান মালিক তাঁরা এখন পথে বসতে চলেছেন। তাঁদের ব্যাপারে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয় তাঁর জন্যে সরকার ও বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে দাবি তোলা দরকার। আমাদের কোনো অবস্থাতেই তাঁদের ভুলে গেলে চলবেনা। তাঁদের সাহায্যেও এগিয়ে আসতে হবে। সৌভাগ্যবশত এবং সাবধানতা অবলম্বন করার কারণে তাঁদের জীবন রক্ষা হয়েছে; সামনে তাঁদের কঠোর সংগ্রামের দিন। তাঁদের ব্যাপারে কি করনীয় সেটা দ্রুত চিন্তা করা দরকার, সেটা তাঁদের সঙ্গে নিয়েই ভাবতে হবে।
যারা আহত ও নিহতদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন, গত কয়েক দিন দিবারাত্রি তাঁদের জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন তাঁদের কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তাঁদের কাজের পাশাপাশি এখন এ সব বিষয়ে নজর দেয়া দরকার। আশা করি সরকার এ বিষয়ে সচেতন থাকবেন, এবং আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মিরা ভেবে দেখবেন কি করে শ্রমিকদের এই প্রয়োজনগুলো পূরণ করা যায়। সাভারে নিহতদের কাছে আমাদের ঋন অপরিশোধ্য। সেই ঋনের স্বীকৃতি হিসেবে হলেও আমাদের এখনই এসব কাজে এগিয়ে আসতে হবে।
বিডিনিউজ২৪-এ প্রকাশিত