সিরিয়ায় চলমান যুদ্ধের অবসানের দিকে সামান্য অগ্রগতি ঘটেছে এবং আশা করা যায় যে আগামী কয়েক সপ্তাহ ধরে এই পথে অগ্রগতি অব্যাহত রাখা গেলে সিরিয়া যুদ্ধের অবসানের পথ খুলতে শুরু করবে। এই অগ্রগতি যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটেছে এমন মনে করার কারন নেই, আবার এই নিয়ে অতিরিক্ত আশাবাদী হবারও কারন নেই। তবে সামান্য অগ্রগতিকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে পারি।
২৭ দিনের বেশি সময় আগে রাশিয়ার বিমান হামলা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে যারা নাটকীয়ভাবে আসাদ সরকারের বিজয় আশা করেছিলেন বা এখনও তেমন আশা করেন তাঁরা আমার এই সঙ্গে ভিন্নমত পোষন করবেন। যারা সিরিয়াকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা করেছিলেন তারাও আমার সঙ্গে একমত হবেন না। আমি যে অগ্রগতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করছি তা হল — এই সপ্তাহের শেষের দিকে ভিয়েনায় সিরিয়া নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনা শুরু হবার খবর। এই আলোচনা ২০১২-১৪ সালে জেনেভা আলোচনা থেকে ভিন্ন এই কারনেই নয় যে এটি এখন অন্য একটি শহরে অনুষ্ঠিত হবে, এই কারনে যে তার অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ইরানও থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগের পর্যায়ের আলোচনায় রাশিয়ার অংশগ্রহণ থাকলেও তা ছিলো কার্যত দ্বিতীয় সারির – এখন রাশিয়ার অংশীদারিত্ব বেশি। কেননা তার ঝুঁকি বেশি, তার ভাগও বেশি। এও বৈঠকে অংশ নেবে যুক্তরাষ্ট্র, সিরিয়া, ইউরোপিয় ইউনিয়ন ছাড়াও এই অঞ্চলের আরব দেশগুলো । ফলে এই আলোচনা, বিবিসি’র কূটনৈতিক বিশ্লেষক জেমস রবিনের ভাষায়, এই স্বীকৃতি যে, অবস্থা এতটাই খারাপ যে সব আঞ্চলিক শক্তির অংশগ্রহণ ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়। এই আলোচনার গুরুত্ব বুঝতে হলে প্রথমেই যেটা মনে রাখা দরকার তা হল সকল পক্ষ এখন একমত যে দ্রুত একটা রাজনৈতিক সমাধান বের করা দরকার; দ্বিতীয়ত ক্ষমতাসীন বাশার সরকার এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে আছে, তাঁরা এও জানে যে এই পরিস্থিতি তাঁরা সামরিকভাবে সমাধান করতে পারবে না এবং শক্তিশালী অবস্থান থেকে আলোচনা করার এই সুযোগ যে কোনো সময়ে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তৃতীয়ত রাশিয়া সিরিয়ায় দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধে থাকতে রাজি নয়, কেননা সেটা তার জন্যে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকারক, তদুপরি রাশিয়ার প্রধান লক্ষ্য ছিলো আসাদ সরকারকে আশু বিপদ থেকে রক্ষা করা যা তাঁরা ইতিমধ্যেই অর্জন করেছে (যারা ভেবেছিলেন যে রাশিয়া আইসিস-কে নির্মূল করার জন্যে সিরিয়ায় এসে হাজির হয়েছে তাঁরা নিশ্চয় চার সপ্তাহ পরে তাঁদের ভুল বুঝতে পারছেন)। চতুর্থত ইরান ইতিমধ্যেই যুদ্ধের কারনে লোকক্ষয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। যদিও ইরান অনেকদিন ধরেই আসাদের পক্ষে ‘স্বেচ্ছাসেবক’ এবং সেনাবাহিনীর অফিসারদের পাঠাচ্ছিলো, এখন সেই ক্ষতির পরিমান বেড়েছে। এই মাসেই নিহত হয়েছেন দুই জন জেনারেল, এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদিনিজাদের দেহরক্ষী, এ ছাড়া সিরিয়ায় ইরানের ‘সামরিক উপদেষ্টা’ বলে যাদের বলা হয় রেভ্যুলুশানারি গার্ডের তিনজন শীর্ষস্থানীয় অফিসারও প্রান হারিয়েছেন। (এ বিষয়ে নিউইয়র্কারে প্রকাশিত বিস্তারিত রিপোর্ট, লিখেছেন রবিন রাইট, ২৬ অক্টোবর ২০১৫)। ফলে এই বিষয়ে তাঁদের একটি সমাধান অনুসন্ধান জরুরি।
বিপরীতক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আগের অবস্থান থেকে অনেকটা সরে এসেছে – ইরানের অংশগ্রহণ বিষয়ে কোনোরকম আপত্তি না তোলা থেকেই বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছে যে ইরানকে বাদ দিয়ে কোনো রকম রাজনৈতিক সমাধান অসম্ভব, এটি নিসন্দেহে যুক্ত্ররাষ্ট্রের সাফ্ল্যের ইঙ্গিত দেয় না। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত উপলব্ধি করছে যে এখন আলোচনার পথে অগ্রস্রর না হলে দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাপ্রবাহের স্রোতে এই অঞ্চলে তার প্রভাবই শুধু কমবে তা নয়, সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে ইরান। সৌদিআরবের রাজ-পরিবারের ভেতরে যে টানাপোড়েনের খবর পাওয়া যাচ্ছে তা এই অঞ্চলে আরো অস্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়। দ্বিতীয়ত যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইরাকে তার সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে এবং আইসিসের বিরুদ্ধে রণাঙ্গন পর্যায়ে ‘স্পেশাল ফোর্স’কে ব্যবহার করছে বলেই প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। কিছুদিন আগে সেখানে একজন মার্কিন সৈন্যের নিহত হবার খবর থেকে জানা যায় যে এখন ইরাকে আইসিসের বিরুদ্ধে মার্কিনী সেনারা অভিযান চালাচ্ছে। সিরিয়া সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে এই গ্রীষ্মকাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আসাদকে আপাতত ক্ষমতায় রেখেই সমাধানের কথা ভাবছিলো ভিয়েনা আলোচনা তার লক্ষন (এ বিষয়ে দেখুন প্রথম আলোতে প্রকাশিত আমার নিবন্ধ , ১৯ অক্টোবর ২০১৫)। তৃতীয়ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাঁদের হাতে এখন যে ‘শরনার্থী সমস্যা’ আছে কেবল তারই সমাধান করতে চাইছে তা নয়, তাঁরা চাইছে যে ভবিষ্যতে যেন এমন পরিস্থিতির সূচনা না হয়। আর তার জন্যে রাজনৈতিক সমাধানের কোনো বিকল্প নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে এই রাজনৈতিক সমাধানে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সায় দেবে কিনা। সেটা নির্ভর করবে আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়ে কতটা অগ্রগতি হল তার ওপরে। তবে আমাদের মনে রাখা দরকার যুদ্ধ শুরু করা যত সহজ তার ইতি টানা ততটা সহজ নয়। ফলে এর সিরিয়া যুদ্ধের সমাধান অচিরেই সমাধান হবে মনে করার কারন নেই, কিন্ত অন্তত এখন এই আশাবাদ তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার , সিরিয়ায় সমস্যার সমাধান হলেই আইসিস সমস্যার সমাধান হবে না। তবে এই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই – সামরিক ও আদর্শিক – শক্তিশালী করতে তা সহায়ক হবে।