
ফেনীর সোনাগাজী থেকে বরগুনার দূরত্ব কত? সাধারণ হিসাবে প্রায় আড়াই শ কিলোমিটার। এই দূরত্ব ভৌগোলিক। কিন্ত সোনাগাজীতে নুসরাত জাহানকে কেন্দ্র করে ২৫ মার্চের পরে যেসব ঘটনা ঘটেছে, যার পরিণতিতে নুসরাতকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, অভিযুক্তদের পক্ষে যে ধরনের প্রচার চালানো হয়েছে, তার সঙ্গে বরগুনায় ২৬ জুন রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার পর যেসব ঘটনা ঘটছে, হত্যা মামলার প্রধান আসামি ‘নয়ন বন্ড’ নামে পরিচিত সাব্বির আহম্মেদ নয়নের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়া এবং রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকাকে পুলিশের রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনার মধ্যে কি কোনো দূরত্ব দেখতে পান?
মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তাঁরা, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। এর বাইরে দৃশ্যত মিল পাওয়া যাবে কমই। বরং আপাতদৃষ্টে এই দুই ঘটনার মধ্যে পার্থক্য অনেক। নুসরাত মারা গেছেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের পরে, রিফাতকে হত্যা করা হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের জেরে। কিন্তু এই দুই হত্যার পরের ঘটনাপ্রবাহের দিকে ভালো করে তাকালে দেখবেন যে এর সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিবিদের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা সুস্পষ্ট, অভিযুক্তদের ব্যাপারে পুলিশের অতীত ভূমিকা রহস্যময় বললে কম বলা হবে, বরং বলা দরকার পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সখ্য নিবিড়। শুধু তা–ই নয়, এই দুই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হয় অভিযুক্তদের পক্ষে নতুবা প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্টদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে মিছিল/মানববন্ধনের ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একশ্রেণির মানুষ তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার চেয়ে কাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়, তা নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন। সেই প্রক্রিয়ায় একজন নারীকে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, যেভাবে তাঁর ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে একটি হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়াই উদ্দেশ্য—বিচার পাওয়া না–পাওয়ার বিষয় নয়।
স্থানীয় রাজনীতির প্রসঙ্গ উঠছে, কেননা আমাদের ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই যে যখন জানা গেল যে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের একজন নায়ক হচ্ছেন নয়ন বন্ড, ঠিক তার পরপরই বরগুনা আওয়ামী লীগের দুই নেতা নয়ন বন্ডের বিষয়ে পরস্পরের দিকে আঙুল তুলেছিলেন। আর সেই পটভূমিকায়ই কথিত বন্দুকযুদ্ধের নাটকীয় ঘটনা ঘটে, নয়ন বন্ড দৃশ্যপট থেকে অপসারিত হন। লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে যে এরপর না কোনো গণমাধ্যম, না স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁর নাম উচ্চারণ করছেন, তাঁর অতীত ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে কেউই আর উৎসাহী নয়। বরং আমাদের দৃষ্টি ও মনোযোগ এখন অন্যত্র। এই রকম সংবাদও বেরিয়েছিল যে নয়ন বন্ড পুলিশের ইনফরমার হিসেবে কাজ করেছেন। একাধিক মামলার আসামি কী করে পুলিশের ইনফরমার হন, সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখন সেই স্থানীয় পুলিশের ওপরই দায়িত্ব বর্তেছে রিফাতের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে আদালতে হাজির করার। সেই কাজে তাদের ‘কর্মতৎপরতার’ ফলেই এখন আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি রিমান্ডে প্রেরিত হয়েছেন, পুলিশ সুপার দাবি করেছেন যে আটক মিন্নি হত্যার সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ‘স্বীকার’ করেছেন। অন্যদিকে মিন্নি আদালতকে বলেছেন, ‘আমি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত নই।’
সোনাগাজীর ঘটনার ব্যাপারে যাঁরা অভিযুক্ত সেই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, তাঁর শিষ্য নূরউদ্দিন, আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলমের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের কী ধরনের সম্পর্ক ছিল, তা এখন সবার জানা। স্থানীয় থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের ভূমিকাও সবার জানা, তাঁকে আটক করা নিয়ে যে ধরনের নাটকীয়তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তা ব্যাখ্যাতীত। এখন এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে কিন্তু অভিযুক্তরা আদালতের চত্বরেই বাদীকে হুমকি দিয়ে তাঁদের খুঁটির জোর দেখাতে পেরেছেন। তদুপরি জানা গেছে যে ‘মামলার সাক্ষীরা আসামির স্বজনদের অব্যাহত হুমকির মুখে আছেন। এ জন্য আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তাঁরা সব কথা তুলে ধরতে পারছেন না’ (প্রথম আলো, ১১ জুলাই ২০১৯)। আটক হওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে মিন্নিও অভিযোগ করেছেন, রিফাতের বাবার ওপর ‘প্রভাবশালী মহলের চাপ’ আছে। সাব্বির আহম্মেদ নয়নের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে নেতার যোগাযোগের অভিযোগ, ওই দলেরই আরেকজন তুলেছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা যখন মানববন্ধনে নেতৃত্ব দেন, ব্যক্তিবিশেষকে আটকের কথা বলেন এবং পুলিশের পদক্ষেপে সেই দাবির বাস্তবায়ন দেখা যায়, তখন এই নিয়ে সংশয় তৈরি হয় যে, পুলিশ ও প্রশাসন কোনো প্রভাববলয়ের মধ্যেই আছে কি না। সোনাগাজীর হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস এবং এই রকম অসংখ্য জানা-অজানা ঘটনা থেকে মনে হয় না যে এসব ঘটনা কাকতালীয়।
রিফাতকে প্রকাশ্যে কারা হত্যা করেছে, তার ভিডিও আছে, ফলে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না; হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা মদদ দিয়েছে, কেন মদদ দিয়েছে, সেটি যেমন দেখার বিষয়, তেমনি দেখার বিষয় হত্যাকারীরা কেন মনে করতে পেরেছেন যে এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের পরেও তাঁরা নিরাপদেই থাকবেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মিন্নি সংশ্লিষ্ট কি না, সেটা খুঁজে দেখার যদি বাস্তব কারণ থাকে, তবে তা নিয়ে প্রশ্ন নেই, আমরা সেই রকম কিছুর সম্ভাবনা বিবেচনায় রাখব; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রভাবশালী এক অংশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই দিকে অঙ্গুলি সংকেতের পরেই পুলিশ কেন এই পথে এগোচ্ছে?
আমরা জানি যে আজকের বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া সাব্বির আহম্মেদরা ‘নয়ন বন্ড’ হতে পারেন না, রিফাত ফরাজীরা এই দুঃসাহস দেখাতে পারেন না। তাঁদের রক্ষাকর্তারা যে আরও অনেক পথ বেছে নেবেন, সেটাও আমাদের বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই। কলুষিত রাজনীতির যে বৃত্তচক্র দল, পুলিশ, প্রশাসনকে একত্র করে দেয় এবং দেশের প্রায় সর্বত্রই দিয়েছে, সেই বিবেচনায় বরগুনা আর সোনাগাজীর দূরত্ব আড়াই শ কিলোমিটার তো দূরের কথা, এক কিলোমিটারও নয়।
এসব প্রশ্ন আরও জোরদার হয়ে উঠছে এই কারণে যে, যে প্রক্রিয়ায় এই মামলার প্রধান সাক্ষী এখন অভিযুক্ততে পরিণত হয়েছেন, তা প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা জানি না যে একটানা ১১ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আয়শা সিদ্দিকা আইনি সহায়তা পেয়েছিলেন কি না। দেশের প্রচলিত আইন ও পদ্ধতি দাবি করে যে তাঁকে এই সুবিধা দিতে হবে। উচ্চ আদালতের এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও আছে। আমাদের মনে এই প্রশ্ন ওঠে এই কারণে যে তাঁকে যখন আদালতে হাজির করা হয়, তখন তাঁর পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। তাঁর বাবা অভিযোগ করেছেন যে আইনজীবীদের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তাঁরা দাঁড়াননি। কোনো কোনো গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে যে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভয়ের কারণেই কোনো আইনজীবী মিন্নির পক্ষে দাঁড়াতে রাজি হননি। কিন্ত এই রকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কেন আইনজীবী দেওয়া হয়নি, কেন এই অবস্থা সত্ত্বেও আদালত পুলিশের রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেছেন?
আদালতে আইনজীবীদের এই অনুপস্থিতি দেশে একধরনের ‘মব জাস্টিসের’ ইঙ্গিত বহন করে। কেননা, অতীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটনায় কথিত ধর্ষক থেকে শুরু করে আইসিটি আইনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত মামলায় যখন অভিযুক্তদের পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়িয়েছেন, তখন তাঁর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে বিষোদ্গার করা হয়েছে। অনেক সময় বিভিন্ন সংগঠন এই দাবি নিয়ে মানববন্ধন করেছে, যেন আইনজীবীরা অভিযুক্তদের পক্ষে না দাঁড়ান। জেলা পর্যায়ের আইনজীবী সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েই অভিযুক্তের পক্ষে না দাঁড়াতে আইনজীবীদের অনুরোধ করেছে। এমনকি রিফাতের হত্যার ঘটনার পরেও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম রিফাত হত্যাকারীসহ খুনিদের পক্ষে আদালতে না দাঁড়াতে আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এই ধরনের আচরণ এবং ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এই ধরনের কথাবার্তা আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
যাঁরা অতীতে অত্যন্ত সরবে এই ধরনের প্রচার চালিয়েছেন, মিডিয়া ট্রায়ালে বিচারকের ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন মিন্নির পক্ষে আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাঁরা কি জানতেন না যে অবস্থা তাঁরা চাইছেন, এটাই তার অনিবার্য পরিণতি? আর যাঁরা বিচার চান না, তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোনাগাজীর নুসরাতের চরিত্র হননের কাজে সিদ্ধহস্ত ছিলেন, আজকে তাঁদের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন মিন্নি। আইনের শাসনে যেকোনো অভিযুক্তরই আইনি সহায়তা পাওয়া অধিকার; কিন্তু মব জাস্টিসের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থকেরা আইনের শাসন চান না, তাঁরা আদালত নয়, আইনি প্রক্রিয়া নয়—চান বিচারের নামে ‘শত্রু’ নিধন। অন্যদিকে সামাজিক চাপ বা ভীতির কারণে যদি আইনজীবীরা তাঁদের দায়িত্ব পালন না করেন, তবে বুঝতে হবে তাঁরাও এই কাজেই শামিল হলেন।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ২০ জুলাই ২০১৯