ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী রিপাবলিকান গার্ডসের কুদস বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ক্ষমতাকাঠামোর অন্যতম প্রতীককে অপসারণ করেছে। এই পদক্ষেপ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য এবং উপসাগরীয় এলাকায় ইরান যে প্রভাব বিস্তার করেছে, তাকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা। সেই চ্যালেঞ্জ করার পদ্ধতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগ্রাসী হত্যাকাণ্ডের পথ বেছে নিয়ে কেবল যে তাঁর বেপরোয়া ও ইম্পালসিভ বা ঝোঁকনির্ভর মানসিকতারই আরেকটি উদাহরণ তৈরি করলেন তা নয়, কিংবা গোটা পৃথিবীকে আরও অনিরাপদ করলেন তা–ও নয়, তিনি এই অঞ্চলে নিকট ভবিষ্যতেই ইরানের আধিপত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পথ উন্মুক্ত করলেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলার প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য একই সঙ্গে সোলাইমানির গুরুত্ব, ট্রাম্পের পদক্ষেপের অদূরদর্শিতা এবং সম্ভাব্য চিত্রকল্পগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।
কাশেম সোলাইমানি যে ইরানের দ্বিতীয় শক্তিধর ব্যক্তি, পাঠকেরা তা ইতিমধ্যেই অবগত হয়েছেন। কাশেম সোলাইমানির মৃত্যু আর যেকোনো সামরিক নেতা, এমনকি সরকারপ্রধানের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা তৈরি করেছে এবং এ ঘটনার তাৎপর্য যেকোনো সময়ে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনার মাত্রা থেকে ভিন্ন। সোলাইমানির প্রাথমিক পরিচয় সামরিক ব্যক্তি হিসেবে, তাঁর উত্থান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে, কিন্তু তিনি যে কারণে ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিচিত হয়েছেন, তা হচ্ছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ও পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় ইরানের আধিপত্য বিস্তারের কর্মকৌশল বা স্ট্র্যাটেজির নির্মাতা। এই কৌশলের অন্তর্ভুক্ত ছিল কূটনীতি, যুদ্ধ, নিজ দেশের সরকারের ওপর প্রভাব তৈরি, দেশের অভ্যন্তরে সরকারবিরোধীদের দমন, গোপন হত্যা পরিকল্পনা, তার বাস্তবায়ন।
সোলাইমানির প্রভাবের ক্ষেত্র ইরানে সীমাবদ্ধ ছিল না—এটি তাঁর মিত্ররাও স্বীকার করেন, যদিও তাঁরা এটা খুব স্পষ্ট করে বলেন না, কেন ইরানের একটি বাহিনীর প্রধানের প্রভাব তাঁর দেশের সীমানার বাইরেও বিস্তার লাভ করা স্বাভাবিক ঘটনা বলে বিবেচিত হবে, তাঁর শত্রুরাও তাঁকে পৃথিবীর অন্যতম সমরবিদ বলে বর্ণনা করেন, কেননা অন্তত গত এক দশকে তিনি এতটাই সাফল্য অর্জন করেছেন যে তাঁর প্রতিপক্ষরা তাঁকে মোকাবিলা করতে পারেনি। ২২ বছর ধরে তিনি আল কুদস বাহিনী গড়ে তুলেছেন, তার নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এই বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনেই এই অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে উঠেছে, হিজবুল্লাহ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করলেও তার পেছনে আল কুদস, বিশেষ করে সোলাইমানির সাহায্য–সমর্থন রয়েছে, হামাসের সঙ্গেও তাঁর সখ্য। তাঁর এই কৌশলের কারণেই সিরিয়ায় বাশার আল–আসাদ সরকার তার বিরোধী বিদ্রোহীদের দমন করতে পেরেছে। সেই যুদ্ধে রক্তপাত এবং প্রাণহানির দায় দুই পক্ষেরই। সোলাইমানির সাফল্যে এই বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। ইয়েমেনে হুতিরা ইরানের প্রভাব বিস্তারের জন্য লড়ছে, যার কৌশলের প্রণেতা সোলাইমানি।
একই সঙ্গে এটাও গুরুত্বের সঙ্গে বলতে হবে যে সোলাইমানির কৌশল এবং তাঁর অনুগত মিলিশিয়া বাহিনীগুলো ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে জানবাজি যুদ্ধ করেছে এবং কুর্দিরা যেমন এক ফ্রন্টে সাফল্য দেখিয়েছে, তেমনি দেখিয়েছে হাশেদ আল শাবি বা পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিট (পিএমিউ)। এটি হচ্ছে মিলিশিয়াদের একটি জোট, যা তৈরি হয় ইরাকি সরকারের তত্ত্বাবধানে ২০১৪ সালে শিয়া মিলিশিয়াদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমন্বয়ে। ২০১৮ সালে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দলগুলো ইরাকের রাজনীতিতে অংশ নেওয়া শুরু করে এবং নির্বাচনে বেশ ভালো ফল করে। যদিও হাশেদ আল শাবির সদস্যদের ২০১৯ সালে ইরাকের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাঁরা এখনো ইরাকি সরকারের চেয়ে বাইরের শক্তির প্রতি অনুগত বলেই মনে করা হয়।
সোলাইমানির কুদস বাহিনীর সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ না থাকলেও সোলাইমানির কৌশল ও নেতৃত্ব তাদের অনুপ্রেরণার জায়গা। এই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত মিলিশিয়ারা ইরাকে উপস্থিত মার্কিন বাহিনী এবং অন্যান্য স্বার্থের ওপর নিয়মিতভাবেই হামলা চালায়। আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে সোলাইমানির উপস্থিতি, কৌশল, প্রভাব নিয়ে বড় ধরনের আপত্তি করেনি, পরোক্ষভাবে সহযোগিতাই করেছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে একটি হুমকি হিসেবেই দেখেছে।
হুমকি হিসেবে বিবেচনা করলেও এবং সোলাইমানির ভূমিকা ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য একটা বাধা বলে মনে করলেও সোলাইমানিকে হত্যা বৈধ বলে বিবেচিত হতে পারে না। সোলাইমানির ভূমিকা অগ্রহণযোগ্য হলেও তাঁকে হত্যা করার অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের নেই। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ অবশ্যই নিন্দনীয়।
যুক্তরাষ্ট্র সোলাইমানিকে হত্যা করার চেষ্টা থেকে আগে একাধিকবার বিরত থেকেছে। অন্তত দুই দফা হাতের মুঠোয় পেয়েও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের বিবেচনায় প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রবিষয়ক নীতিনির্ধারকেরা এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর ক্ষতিসাধনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং রণকৌশলের বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা বিবেচনায় নিয়েছেন। দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের বিবেচনায় দেখেছেন যে এটি যুক্তরাষ্ট্রকে বিপদগ্রস্ত করবে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, অতীতের এসব বিবেচনাকে বাদ দিয়ে ট্রাম্প এখন কেন এই ধরনের ঝুঁকি নিলেন।
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের এখানেই হচ্ছে অদূরদর্শিতার লক্ষণ। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাঁকে সুবিধা দেবে, এটি তাঁর বিবেচনায় ছিল কি না, কিংবা সিনেটে আসন্ন অভিশংসনকে বিলম্বিত করা তাঁর লক্ষ্য কি না, সেটা আমরা কেবল অনুমান করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্র যদিও বলেছে পারস্য উপসাগরে এবং ইরাকে মার্কিন সৈন্য এবং অন্যান্য স্বার্থের ওপর শিয়া মিলিশিয়াদের উপর্যুপরি হামলার কারণে, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে এবং সোলাইমানি ও তাঁর অনুগত মিলিশিয়ারা আরও বড় ধরনের হামলা করতে পারে, এই তথ্যের ভিত্তিতে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু এগুলো নতুন কোনো ঘটনা নয়। তাঁকে কেন্দ্র করে এত বড় ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষে কোনো যুক্তিই নেই।
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যখন আবার টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ, রাশিয়া বিষয়ে দেশের ভেতরে–বাইরে উদ্বেগ—সেই সময় ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে তিনি হয় অন্য বিবেচনা মাথায় রেখেছেন অথবা তাঁর ধারেকাছে এমন কোনো পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা নেই, যিনি এ কথা তাঁকে বোঝাতে পারেন, এই পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া কী হবে। জন বোল্টন মন্ত্রিসভায় সবচেয়ে কট্টর ইরানবিরোধী ছিলেন কিন্তু এখন তাঁর কোনো প্রভাব নেই। তারপরও এই সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো। এর বিবেচনা একটাই হতে পারে, তা হচ্ছে এই অঞ্চলে ইরানের বিরোধীরা সৌদি আরব ও ইসরায়েল এই পদক্ষেপ নিতে ট্রাম্পকে প্রভাবিত করেছে।
ইরানের শক্তি ক্ষয় হলে ইয়েমেনে হুতিদের মোকাবিলায় সৌদি আরব সুবিধা লাভ করবে, লেবাননে হিজবুল্লাহর কৌশলের ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখা দিলে তাতে ইসরায়েলের লাভ। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, ট্রাম্প এটাই সম্ভবত আশা করছেন যে ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের কৌশল নির্মাতা এবং ক্রীড়নককে সরিয়ে দিলে ইরানকে এতটাই দুর্বল করা যাবে যে, ইরানকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। এর আরেকটি দিক হচ্ছে ইরানের অর্থনৈতিক সংকট। তেল বিক্রিসহ অন্যান্য ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে ইরানের অর্থনীতি অত্যন্ত দুর্বল। ফলে ইরান কোনোভাবেই আর তার আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের ধারা বজায় রাখতে পারবে না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর বন্ধুরা যে ধরনের প্রত্যাশা করছেন, আসলেই কি তাই ঘটবে? এই আক্রমণের ও হত্যাকাণ্ডের জবাব ইরান কীভাবে দেবে? এটা বোঝার জন্য কাশেম সোলাইমানির অনুসৃত কৌশলের কাছেই ফিরতে হয়। ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর সোলাইমানি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ইরানের জন্য লাভজনক নয়, বিজয়ের আশা না করাই ভালো। সেই বিবেচনায়ই এসব মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। ইরান এখন তাদের মাধ্যমেই জবাব দেবে বলে অনুমান করা যায়। অসম যুদ্ধ চলতে থাকবে, এই অঞ্চলে এবং বিশ্বের অন্যত্র যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে আক্রমণের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করল। আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের একটা অন্তহীন বৃত্ত চক্রের সূচনা হলো।
কোনো রকম প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতো আগ্রহ বা সক্ষমতা ইরানের নেই, ইরান এখন আবার পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করেছে। এই সময়ে আরেকটি প্রত্যক্ষ যুদ্ধ তার জন্য আত্মঘাতী হবে, এখন দেশের ভেতরে যে সমর্থন সরকার পাচ্ছে, তা যুদ্ধে গিয়ে বেশি দিন ধরে রাখা যাবে না। কিন্তু অবিলম্বে যেটা হবে, সেটা হচ্ছে ইরাকের অভ্যন্তরে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারা আরও শক্তি ও সমর্থন নিয়েই ইরাকি সরকারের ওপর চাপ দেবে, যেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে দেওয়া হয়। তার অর্থ হবে ইরাকে মার্কিনদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির অবসান হবে। এর ফলে সিরিয়ায় মার্কিনদের যতটুকু উপস্থিতি আছে, তা বহাল রাখা অসম্ভব হবে। তার অর্থ হচ্ছে এই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব কমার বদলে বাড়বে এবং তা ঘটবে নিকট ভবিষ্যতেই।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত ৫ জানুয়ারি ২০২০