কুর্মিটোলার কালশীতে বিগত শবেবরাতের রাতে যে গণহত্যা ঘটানো হলো, তা আমাদের আবারো কিছু পুরনো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সরেজমিনে যারা ঘটনাস্থল দেখে এসেছেন, তাদের বর্ণনা এবং দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জেনেছি পার্শ্ববর্তী একটি বস্তিতে বিদ্যুত্ সংযোগ দেয়া নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার সঙ্গে বিহারি ক্যাম্পের অধিবাসীদের বচসার সূত্রপাত। তারা বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বাধা দেয়ার কারণে ইলিয়াস মোল্লা ক্ষিপ্ত হয়ে স্থানীয় যুবলীগের নেতাদের পাঠিয়ে দেন ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। তারা ক্যাম্পে গিয়ে বাড়ির দরজায় তালাবদ্ধ করে বালির বস্তা দিয়ে আটকে আগুনে পুড়িয়ে দশজন এবং গুলি করে একজনকে হত্যা করে। যুবলীগের মাস্তানরা যখন এই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল, তখন পুলিশ পাশে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ আছে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে। তার মানে দাঁড়ায় রাষ্ট্রযন্ত্রের সায় আছে এ হত্যাকাণ্ডে। বিগত এপ্রিল মাসে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই কালশীতে একই সঙ্গে দশ ব্যক্তিকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা আমাদের সামনে একটি বিষয় পরিষ্কার করেছে আর তা হলো, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে এত বড় মাপের হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব না। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত র্যাব সদস্যদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে এসব বিষয় এখন পরিষ্কার।
কালশীর ঘটনায় পুলিশ আক্রান্তদের বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা করেছে, এমনটাই হয়। যে দেশে জাতিবিদ্বেষের কারণে বছরের পর আদিবাসীদের হত্যা ও নিপীড়ন চলে, যেখানে ধর্মীয় অজুহাতে মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে তাদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়, যেখানে নানা অজুহাতে ভূমিলুণ্ঠন প্রক্রিয়া চালু রাখতে ধর্ম অবমাননার ধুয়া তুলে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়, সে দেশে ভিনদেশী ‘আটকে পড়া’ উপাধি পাওয়া উনমানুষদের পুড়িয়ে মারা হবে এটাই তো স্বাভাবিক!
হত্যা প্রচলিত আইনেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কারো বিরুদ্ধে হত্যায় কিংবা অন্য কোনো ধর্তব্য ফৌজদারি অপরাধে কারো জড়িত থাকার অভিযোগ এলে পুলিশ সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক নিয়মে গ্রেফতার করবেন, তাকে বিচারের মুখোমুখি করবেন, এটাই আইনে বলা আছে। কিন্তু অভিযোগ যখন ক্ষমতাবান কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আসে, তখন কার্যত পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কোনো প্রকার তত্পরতাই দেখা যায় না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে আলাদা করে বলতে হয়, ‘অপরাধী যে-ই হোক না কেন, তাকে গ্রেফতার করতে নির্দেশ দিয়েছি।’ এটি এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আমরাও এখন অপেক্ষা করি কখন এ ধরনের বক্তব্য আসবে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এত বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের পর তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য ইতিহাসে সবচেয়ে খেলো ও হাস্যকর মন্তব্য হয়ে থাকবে। কালশীর ঘটনায়ও এর ব্যতিক্রম দেখছি না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কোনো প্রকার তদন্ত বা পর্যবেক্ষণ ছাড়াই বলে দিলেন, এটি নিছক দুর্ঘটনা। মন্তব্য যা-ই হোক, এখন অবধি কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। বিচারিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে এমন কোনো বিচারিক আদেশও নেই, তাই অগ্রগতিও নেই। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় যদি একজন আইনজীবী খুন না হতেন আর মহামান্য হাইকোর্ট যদি হস্তক্ষেপ না করতেন, তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায়, সাত খুনের ঘটনায় আজ অবধি কেউ গ্রেফতার হতেন না। কালশীর ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হবেন বা বিচারের মুখোমুখি হবেন, তেমন নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী কিংবা সংসদ সদস্যকে পুলিশ গ্রেফতার করবেন, এমন আশা কেউ যদি করে থাকেন, তাহলে তিনি কেবল দিবাস্বপ্ন দেখার আনন্দ পাবেন, এর বেশি কিছু না। আমরা আজ আর কারো আশ্বাসে বিশ্বাস করি না। করে লাভও হয় না। অভিজ্ঞতা অন্তত তা-ই বলে।
এবার আসি তদন্তের আলোচনায়। কেউ না কেউ আগুন দিয়েছে এবং দশজন ব্যক্তিকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে, এটিও বস্তুগত প্রমাণসহ সত্য। বিহারিদের সেই ক্যাম্পে বিভিন্ন জায়গায় গুলির চিহ্ন আছে, এও সত্য। পুলিশ তাদের তদন্ত প্রক্রিয়ায় কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করবেন, সেটি তাদের বিবেচনার ব্যাপার; কিন্তু যেসব বিষয় সাধারণ জনগণ সাদা চোখে দেখছি, সেসবের ব্যাখ্যা পুলিশের তদন্তে থাকা উচিত। বিগত ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে বৌদ্ধমন্দির পোড়ানোর ঘটনায় ‘গান পাউডার’ ব্যবহার করা হয়েছিল, পুলিশের কোনো তদন্তে সেসব নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন হয়েছে বলে আজ অবধি শুনিনি। তাছাড়া ঘটনা-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক কারণে আলামত সংরক্ষণ করা হয়েছিল কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। রামুর ঘটনায় পুলিশের জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল বিধায় পুলিশ দিয়ে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা উচিত হয়নি। স্বার্থের সংঘাতের কারণে পুলিশের তদন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। কালশীর হত্যাকাণ্ডের পরও একই অভিযোগ আসছে এবং দুদিন পরই ঢাকায় মুষলধারায় বৃষ্টিপাত হয়েছে; পুলিশ তার আগেই আলামত সংগ্রহ করেছিল কিনা জানি না। যদি না করে থাকে, তাহলে অনেক আলামত ধুয়ে মুছে যাওয়ার শঙ্কা আছে। ফলে পুলিশের তদন্তে সঠিক তথ্য বের হয়ে না আসার শঙ্কা রয়েছে। এত গেল কেতাবি কথা, যদি তারা তদন্ত করেন, যদি সে তদন্ত নিরপেক্ষ হয়, যদি তারা উপরের চাপ ব্যতীত কাজ করতে পারেন, এবং আর অনেক অনেক ‘যদি’র উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ সূচক হয়, তবেই হয়তো প্রকৃত অপরাধীরা বিচারের মুখোমুখি হবেন। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা আমাদের বলে দেয় এসব ‘যদি’র উত্তর কখনই সাধারণ জনগণের পক্ষে হয় না। ক্ষমতা, বিত্ত, ব্যক্তিগত যোগাযোগ আমাদের তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। ফলে আমরা কখনই প্রকৃত অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি হতে দেখি না। এভাবেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি গেড়ে বসেছে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। বিশ্বজিত্ হত্যাকাণ্ডের বিচার একটি ব্যতিক্রম মাত্র।
কালশীর হত্যাকাণ্ডের পর দেশে চলমান আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে— ক্ষমতাবানদের ভূমি দস্যুতা। মিরপুর ফ্লাইওভার হওয়ার পর থেকে মিরপুর ও পল্লবী এলাকার ভূমির দাম এখন গগনচুম্বী। ‘আটকে পড়া’ বিহারি বাংলাদেশীদের যদি তাদের ক্যাম্প থেকে তাড়ানো যায়, তাহলে কোটি টাকার ভূমি গ্রাস করা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই এটিকে হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ হিসেবে দেখছেন। সারা দেশে বিভিন্ন অজুহাতে বিগত বছরগুলোয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পরিচালিত সহিংস আক্রমণগুলোর পেছনে মূল কারণ ছিল ভূমিদস্যুতা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে বিগত এক বছরে জামায়াত বিএনপি যেসব হামলা চালিয়েছে, তার পেছনেও ছিল ভূমিদস্যুতা। তিন পার্বত্য জেলায় নিয়মিত হত্যা, ধর্ষণ, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত যে সন্ত্রাস চলছে, তার পেছনেও ভূমিদস্যুতা। এ ভূমিদস্যুতার পেছনে রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য নয়, স্বার্থ যেখানে এক সেখানে রাজনৈতিক পরিচয় কোনো বাধা নয়। ক্ষমতাসীন দলের হলে সুবিধা এটুকুই যে পুলিশ প্রোটেকশন পাওয়া যায়। হায়রে আমার দেশ! এই প্রোটেকশন আক্রান্তদের পাওয়ার কথা ছিল। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের চুক্তির প্রাথমিক শর্তই হলো রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু রাষ্ট্র নাগরিকের জান, মাল ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দিতে ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ। ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রই মদদদাতা কিংবা উস্কানিদাতা। আমাদের আইন, রাষ্ট্র পরিচালনার মন্ত্র সবই ক্ষমতাবানদের পক্ষে। এসব নিয়ে প্রশ্ন করলেও প্রাণ সংহার হওয়ার শঙ্কা আছে। আমাদের বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন, কিন্তু কেমন স্বাধীন তা নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার পর দেশের নাগরিকরা আরো ভালোভাবে জেনেছেন।
বিহারিদের খুন করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের নাগরিকদের একটি অংশের মনে প্রত্যক্ষ সায় আছে, কেননা এ বিহারিদের একটি অংশ একাত্তরে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানের এই বিহারি জনগোষ্ঠী, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যাদের জন্ম, তারা যে কোনো বিচারে বাংলাদেশী। তাদের ভোটের রাজনীতির কারণে ভোটার পরিচিতিপত্র দেয়া যায়; কিন্তু পাসপোর্ট দেয়া যায় না। এ দ্বিচারিতার মধ্যে আটকে আছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র। যে দুই বছরের শিশুটি আগুনে পুড়ে মারা গেল, সে কোন জাতি বা সম্প্রদায়ভুক্ত তা বুঝে ওঠার আগেই খুন হলো। এ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। রাষ্ট্র দেশের হিন্দুদের, আদিবাসীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ। এ ব্যর্থতার দায় কেউ নেবেন না। সহিংসতা প্রতিরোধে রাষ্ট্র কোনো কার্যকর ব্যবস্থা আজ অবধি নিতে পারেনি। মহানগর, জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে কাউকে ফৌজদারি অপরাধে দায়ী করে বিচারের মুখোমুখি করতে দেখি না। এসব দাবি বাচালতা হিসেবেই দেখা হবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার সবকিছুরই শেষ আছে। আমরা রাষ্ট্রের অনেক বেশি মানবিক দায়িত্বশীলতা দাবি করি।
প্রকাশ- ২৮ জুন ২০১৪, অষ্ট প্রহর বনিক বার্তা।