১ উত্থান ও শক্তি
ইরাক ও সিরিয়ার একাংশজুড়ে প্রতিষ্ঠিত কথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএসের দখল ও আধিপত্য এবং সংগঠনটির জঙ্গি কার্যক্রম মোকাবিলার উদ্দেশ্যে প্যারিসে ৩০টির বেশি দেশের প্রতিনিধিদের সম্মেলনে যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সেটা বৈঠকের আগেই নির্ধারিত ছিল। যে দেশগুলো মনে করেছে, এই গোষ্ঠীকে অবিলম্বে মোকাবিলা করা দরকার এবং তার জন্য সম্মিলিত সামরিক অভিযানের কোনো বিকল্প নেই, তারাই সেখানে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। যারা এই বৈঠকে আমন্ত্রিত হয়নি, সে রকম অনেক দেশও এই বিষয়ে অভিন্ন মত পোষণ করে যে আইসিসের ধ্বংসসাধন না করতে পারলে এই অঞ্চলে গত কয়েক বছরে যে সহিংস পরিস্থিতি চলছে, তাকে ম্লান করে দিয়ে আরও বেশি প্রাণঘাতী অবস্থার উদ্ভব ঘটবে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর বাইরের দেশগুলো, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর ধারণা, ইতিমধ্যেই দেরি হয়ে গেছে। এই শক্তি সম্ভবত তাদের দেশেও আঘাত হানবে। কিন্তু প্যারিসের এই বৈঠকে অর্জিত ঐকমত্য বাস্তবায়ন সম্ভব কি না, সম্ভব হলে কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এবং তার পরিণতি কী হবে, সেগুলোই এখন আলোচনার বিষয়।
প্যারিসের বৈঠকে এবং কয়েক দিন আগে দেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষণে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক এই কোয়ালিশনের লক্ষ্য হচ্ছে আইএসের ক্ষমতা হ্রাস ও ধ্বংসসাধন এবং সংগঠনের নিয়ন্ত্রণাধীন জায়গাগুলো পুনরায় ইরাকের নিয়ন্ত্রণে আনা। এই লক্ষ্য অর্জনের বাস্তব দিক এবং সমস্যাগুলো বিবেচনা করতে হলে আইএসের উত্থানের কারণ এবং তার বর্তমান শক্তির আকার ও উৎস বিষয়ে ধারণা থাকা দরকার।
এ বছরের রমজান মাসের প্রথম দিনে ‘খেলাফত’ বলে নিজেদের ঘোষণা করলেও এবং দিনটির সঙ্গে ১০০ বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনার, যা শেষ খেলাফতের অবসানের প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রারম্ভ বলে বিবেচিত, যোগাযোগ থাকলেও আবু বকর আল বাগদাদির নেতৃত্বাধীন এই সংগঠনের কার্যক্রম যে ইসলাম ধর্মের কথিত স্বর্ণযুগের প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত নয়, সেটা ইতিহাস বিষয়ে সামান্য ধারণার অধিকারী এবং ইসলাম ধর্মের শিক্ষার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন। আইএসের উত্থানের পেছনে কাজ করেছে একাধিক রাজনৈতিক ও সামরিক কারণ। ইরাকে ২০০৩ সাল থেকে গঠিত সরকারের অনুসৃত নীতি, বিশেষ করে সুন্নি জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতাবঞ্চিত করা; সিরিয়ায় তিন বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধ, বিশেষ করে সেখানে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতা সঞ্চয়; আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইরান ও সৌদি আরবের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা; এবং সামগ্রিকভাবে এই পরিস্থিতি থেকে নিজস্ব লাভ অর্জনের চেষ্টায় পশ্চিমা দেশগুলোর অদূরদর্শী এবং অনেক ক্ষেত্রে স্ববিরোধী নীতি অনুসরণ। ২০১০ সালের শেষ নাগাদ শুরু হওয়া ‘আরব বসন্ত’ বলে পরিচিত অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রায়ণের ব্যর্থতা—তা মিসরে ক্ষমতা থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডকে বলপূর্বক অপসারণ কিংবা বাহরাইনে বিরোধীদের দমনে সরকারি সাফল্য কিংবা লিবিয়ায় ক্ষমতাবদলের পরও সবার অধিকার নিশ্চিত না হওয়া—যেভাবেই দেখি না কেন এবং যে ঘটনাগুলোকেই আমরা বিবেচনায় নিই না কেন, এ সবই রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সঙ্গে আধুনিক মারণাস্ত্রের সহজলভ্যতা, অনেক ক্ষেত্রে যা তুলে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরের এমন সব শক্তির হাতে, যাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্ববীক্ষা শুধু সংকীর্ণই নয়, তাদের আনুগত্যও পরিবর্তনশীল। আপাতদৃষ্টে বিস্ময়কর মনে হলেও এটাও সম্ভবত এই হিসাবের বাইরে রাখা সম্ভব নয় যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদার নেতৃত্বের আকর্ষণ ক্ষমতার অভাব এবং সাংগঠনিকভাবে শক্তি হ্রাসও আইএসের উত্থানের পেছনে কাজ করেছে। যে কারণে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে গত কয়েক মাসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে জঙ্গিবাদী আদর্শে উজ্জীবিত বলে দাবিদার তরুণ-তরুণীরা বিভিন্নভাবে আইএসে যোগ দিচ্ছেন এবং তার হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। এদের এক অংশ আসছে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো থেকেও।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি যেমন আইএসের উত্থানকে সাহায্য করেছে, তেমনি ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি সংগঠনটিকে সাহায্য করেছে এক বিশাল পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠতে; যে কারণে তাদের পক্ষে প্রায় ৩০ হাজার সদস্যের একটি বাহিনী গড়ে তোলা এবং বহাল রাখা সম্ভব হচ্ছে। আইএসকে গোড়াতে নির্ভর করতে হয়েছে বিদেশি অর্থের ওপরে; অভিযোগ রয়েছে যে সৌদি আরব ও কাতারের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে তারা অর্থ পেয়েছে। কিন্তু ইরাকের বিভিন্ন এলাকায় তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি তৈরির পর আইএসের জঙ্গিরা স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে তাদের অর্থের সংস্থান ঘটাতে থাকে, কিন্তু তার পরে তাঁরা অর্থ সংস্থানের জন্য জিম্মি আটকের পথ বেছে নেয়। এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যতটা খবর প্রকাশিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ঘটনা ঘটেছে বলেই অনুমান করা যায়, কেননা অনেক ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা গণমাধ্যম মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের কর্মচারীদের মুক্ত করেছে। এই বছরের এপ্রিলে চারজন ফরাসি সাংবাদিককে এই গোষ্ঠীর হাত থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মুক্ত করা হয়; জার্মান পত্রিকা ফোকাস-এর ভাষ্য অনুযায়ী এই পরিমাণ ১৮ মিলিয়ন ডলার।
এ ধরনের ঘটনা কেবল আইএস ঘটাচ্ছে তা নয়, সিরিয়ার জঙ্গিগোষ্ঠী জাবহাত আল নুসরার কাছ থেকে ১৩ জন খ্রিষ্টান নানকে মুক্ত করা হয় চার মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। মার্কিন সরকার এই বিষয়ে সব সময়ই ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিল যে ইউরোপীয় সরকার এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মুক্তিপণ দেওয়ার ঘটনা জঙ্গিরা লোকজনকে জিম্মি করতে উৎসাহিত করছে। নিউইয়র্ক টাইমস একবার হিসাব দিয়েছিল যে ফরাসিরা ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৫ মিলিয়ন ডলারের মতো মুক্তিপণ দিয়েছে। পাশাপাশি কাতারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সরকারের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগাযোগের কারণে তারা এ ধরনের অর্থ আদান-প্রদানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। এই প্রক্রিয়ায় আইএসের হাতে কী পরিমাণ অর্থ জমেছে, তার কোনো হিসাব কারও কাছেই নেই; তবে তা কয়েক মিলিয়ন ডলার বলেই বিশ্লেষকদের অনুমান।
ইরাকের বিভিন্ন এলাকা আইএসের দখলে আসার পর তাদের অর্থের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে তেল। এক হিসাব অনুযায়ী এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইরাকি এলাকাগুলোয় কমপক্ষে চারটি তেলক্ষেত্র আছে। সেখানে তেলকূপ আছে ৪০ থেকে ৭০টি। এখান থেকে প্রতিদিন যে তেল উত্তোলন ও পরিশোধন হয়, তার পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার ব্যারেল। আর তা বাজারদর থেকে অনেক কম মূল্যে এমনকি ২০ থেকে ৬০ ডলারে বিক্রি করে তাদের দৈনিক আয় দাঁড়ায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার। প্রশ্ন উঠতেই পারে, কারা এই তেল কেনে? ইরাকের কোনো কোনো তেল কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ফড়িয়ারা এই তেল শেষ পর্যন্ত মসুল প্রদেশের মাধ্যমে তুরস্কে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। একইভাবে আনবার প্রদেশের মাধ্যমে তারা তেল নিয়ে যায় জর্ডানে, কুর্দিস্তানের পথে ইরানে, তা ছাড়া রয়েছে সিরিয়ার কালোবাজার, যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে যেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষে বাছবিচার করা অসম্ভব—কার কাছ থেকে কী তেল তারা কিনছে।
আর্থিকভাবে শক্তিশালী এবং অনুকূল আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই সংগঠনের বিরুদ্ধেই প্যারিসের সম্মেলনে সমবেত দেশগুলো তাদের অভিযান পরিচালনার অঙ্গীকার করেছে। লক্ষণীয় যা তা হলো, তারা বলেনি যে তারা নিজেরা কথিত এই ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে যাচ্ছে; তাদের ঘোষণায় বলা হয়েছে যে তারা ইরাককে এই জঙ্গিগোষ্ঠী মোকাবিলায় সাহায্য করবে। কিন্তু এ ঘোষণার আগেই যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এই গোষ্ঠীকে মোকাবিলায় ইরাক ও সিরিয়ার ভেতরে বিমান হামলা চালাবে। গত কয়েক মাসে তারা অন্তত ১৫০টি হামলা চালিয়েছে ইরাকে এবং প্যারিসের বৈঠকের পর বাগদাদের কাছে আইএসের লক্ষ্যবস্তুর ওপরে বোমা ফেলেছে।
২ মোকাবেলার সমস্যা
জঙ্গি সংগঠন আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যে কোয়ালিশন গড়ে উঠেছে, তার লক্ষ্য সামরিক অভিযানের মাধ্যমে এই সংগঠনের বিলুপ্তি ঘটানো। প্যারিসে আনুষ্ঠানিক আলোচনার মধ্য দিয়ে এই কোয়ালিশন গড়ে উঠেছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির সমন্বয়ে। গত কয়েক দশকে আমরা দেখেছি, কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযানের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো এই যে তারা একটি জায়গায় সমবেত থাকে না। যদিও আইএসকে একটি ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা নিয়ে কারও কারও আপত্তি থাকতে পারে যে এই সংগঠন একটি নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে এখনো সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায়নি, কিন্তু তার আক্রমণের শিকার হয়েছে বিদেশি নাগরিকেরা এবং এই সংগঠনের হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে ইরাক ও সিরিয়ার বাইরের নাগরিকেরাও এবং তাদের লক্ষ্য যে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি, তা অনস্বীকার্য। আইএসের অবস্থান চিহ্নিত নির্দিষ্ট এলাকায়৷ ফলে তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো সম্ভব এবং এটি কোয়ালিশনের জন্য একটি অনুকূল অবস্থা। দ্বিতীয় অনুকূল বিষয় হলো এই যে এই কোয়ালিশনে রয়েছে ১০টি আঞ্চলিক মুসলিম দেশ। তাদের সমর্থন ও অংশগ্রহণের ফলে এই অভিযানকে পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযান বলে চিহ্নিত করা যাবে না।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও এই অভিযানের সাফল্য নিয়ে এবং তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, সামরিক কৌশলের বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। এ যাবৎ পশ্চিমা শক্তিগুলো বলেছে যে তারা ইরাককে সাহায্য করবে এবং এ পর্যন্ত বিমান হামলার বাইরে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সেনা পাঠানোর ব্যাপারে তাদের অনীহা জানিয়েছে। ২০০১ সালে আফগানিস্তান অভিযান এবং ২০০৩ সালে ইরাক হামলার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো দেশই আর প্রত্যক্ষভাবে কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে রাজি নয়। কিন্তু কেবল বিমান হামলার মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার সদস্যের একটি বাহিনীকে পরাজিত করা এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলো উদ্ধার করা সম্ভব বলে কোনো সামরিক বিশেষজ্ঞই মনে করেন না। তার জন্য যে স্থলশক্তি দরকার, সেটা যে ইরাকের নেই, তা সবাই বুঝতে পারেন। কেননা, এই ইরাকি সেনাবাহিনীই আইএসের আক্রমণের মুখে পশ্চাদপসরণ করেছে এবং তাদের ফেলে আসা অস্ত্রই জঙ্গিদের বড় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এসব জানা সত্ত্বেও এ বিষয় নিয়ে কেউই আলোচনায় খুব বেশি উৎসাহী নয়।
তবে মনে রাখা দরকার যে সামরিক কৌশলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই পরিস্থিতি তৈরির পেছনে যে কারণ, তার সমাধান খোঁজা। এই কোয়ালিশনে অনুপস্থিত দুই দেশের ভূমিকা আইএসের উত্থানের পেছনে কাজ করেছে, তা হলো ইরান ও সিরিয়া। যদিও তারা উভয়েই চায় যে আইএসের শক্তি ক্ষয় হোক এবং তাদের বিলোপ হোক, কিন্তু দুই দেশের ক্ষমতাসীনেরা চায় না তাতে এমন কোনো শক্তির হাত জোরদার হোক, যা তাদের জন্য হুমকি হতে পারে। যেমন ইরান চায় যে সুন্নি গোষ্ঠী হিসেবে আইএসের অবসান ঘটুক, এতে ইরাকে সুন্নিদের অবস্থানও দুর্বল হবে এবং শিয়ানিয়ন্ত্রিত সরকার জোরদার হবে। আইএস প্রশ্নে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের মিল থাকলেও সিরিয়া প্রশ্নে দুই দেশের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। যেহেতু আইএসের একটি অংশ সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে, সেহেতু আসাদ সরকার চায় যে এদের শক্তির অবসান হোক; কিন্তু তারা মোটেই এটা চায় না যে আইএসের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় বিমান হামলা শুরু করুক বা এই সুযোগে দুর্বল হয়ে পড়া আসাদবিরোধীরা আবার শক্তি সঞ্চয় করুক।
আইএসের প্রতি সৌদি আরবের সক্রিয় সমর্থনের কথা অনেক দিন ধরেই জানা। সৌদি ক্ষমতাসীনেরা নিঃসন্দেহে উদ্বিগ্ন যে আইএস অতিরিক্ত সাফল্য লাভ করলে তা তাদের জন্যই হুমকি হয়ে উঠবে। কিন্তু আইএসের পরাজয় হলে এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মধ্যকার প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে সৌদি আরব দুর্বল হবে কি না, সেটাও তাদের বিবেচ্য। ফলে তারা এই অভিযানে কতটা ভূমিকা রাখতে চাইবে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আইএসের উত্থানের অন্যতম কারণ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। সেখানে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের দাবিতে আন্দোলনের গোড়াতে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনপুষ্টদের একাংশ যে এই নতুন সংগঠনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে, তা সরবে না বলা হলেও ওয়াশিংটন-লন্ডনের নীতিনির্ধারকেরা সেটা জানেন। এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দুটি মত রয়েছে বলেই জানা যায়। একাংশের ধারণা যে সিরিয়ার সংকটের গোড়াতেই আসাদবিরোধীদের সুস্পষ্টভাবে সমর্থন ও সাহায্য প্রদান করলে এই অবস্থার সূচনা হতো না। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তা-ই মনে করেন বলে ফেব্রুয়ারি মাসে এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন। অন্যদিকে আরেক অংশের ধারণা, সে সময় কাউকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য না করাই সঠিক হয়েছে। কেননা, এর মধ্যেই আইএসের লোকেরা ছিল, তাদের সাহায্য করলে এখন যুক্তরাষ্ট্রই বিপদগ্রস্ত হতো। যেভাবেই দেখা হোক, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ অব্যাহত রেখে আইএসের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান সফল হবে কি না, তা নিঃসন্দেহে প্রশ্নসাপেক্ষ। আসাদ সরকার বলেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ নিয়ে একত্রে কাজ করতে রাজি। কিন্তু তার মানে হবে আসাদ সরকারকে মেনে নেওয়া। অন্যদিকে, যদি আসাদ সরকারকে না জানিয়ে আইএসের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ বিমান হামলা চালায়, তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ।
আইএসের মতো সংগঠনকে আদৌ নিশ্চিহ্ন করা যায় কি না, সে বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা সব সময়ই সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছেন। আল-কায়েদার বিরুদ্ধে অভিযানের সময় বারবার বলা হয়েছে যে সংগঠন হিসেবে একে অস্তিত্বহীন করে ফেলার ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। যা করা যেতে পারে তা হলো তাকে নেতৃত্বহীন করে ফেলা, তার আবেদন অকার্যকর করা এবং আদর্শিকভাবে এ ধরনের আদর্শের বিরুদ্ধে প্রচারণা অব্যাহত রাখা। তা ছাড়া যেসব কারণে এ ধরনের সংগঠনের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হওয়ার যে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ, সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া। এখন আবার যখন আইএসের ধ্বংসসাধনের ও নিশ্চিহ্ন করার কথা বলা হচ্ছে, এই আলোচনা আবারও ফিরে এসেছে।
আইএসের বিরুদ্ধে অভিযানের এসব সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সে প্রশ্নের উত্তর এক দিনে পাওয়া যাবে না। কেননা, এমন ধারণা করার কারণ নেই যে এই অভিযান হবে স্বল্প সময়ের অভিযান। যে কারণে প্যারিসের ঘোষণাপত্রে কেবল সামরিক অভিযানের কথা বলা হয়নি; বলা হয়েছে আঞ্চলিক সীমান্তগুলো নিয়ন্ত্রণের কথা, আইএসের অর্থের সংস্থান বন্ধের ব্যবস্থা করা, বিদেশিদের এই যুদ্ধে যোগদান বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া এবং এই আদর্শের মোকাবিলা করার কথা।
থাম্বনেইলের ছবির সূত্র: http://goo.gl/tk84CY