বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সম্প্রতি একটা হাহাকার রব উঠেছে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশই উত্তীর্ণ হতে পারেনি। কলা অনুষদের ইংরেজি বিভাগের পরীক্ষায় যখন মাত্র দুজন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে তখন অনেকের টনক নড়েছে। এর আগে গত কয়েক বছর ধরে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষাগুলোতে পাশের হার যখন অস্বাভাবিক রূপ নিয়েছিলো এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কথিত জিপিএ-৫ পাওয়ার মহোৎসব তখন যারা একে শিক্ষার্থীদের চেয়ে সরকার ও শিক্ষা প্রশাসনের সাফল্য বলে আনন্দিত হয়েছিলেন তাঁদের একাংশ এখন এই নিয়ে যে উদ্বেগ দেখাচ্ছেন তা নিঃসন্দেহে লক্ষ করার মতো। এইসব পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনাকে অস্বীকারের মধ্য দিয়ে যারা একে কার্যত প্রণোদিত করেছিলেন তার এখন যে ব্যাখ্যাই দেন না কেন, তাঁদের নিজেদের নিশ্চয় জানা আছে যে ছাত্র ছাত্রীদের এই অবস্থার জন্যে তাঁদের দায়িত্ব এড়াবার উপায় নেই।
গত কয়েক দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে যে আলোচনার ঝড় সেটা যারা অনুসরণ করেন নি তাঁদের জন্যে এই তথ্যগুলো জানিয়ে রাখি; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা হয়; বিজ্ঞান অনুষদ বা ক’ ইউনিটে অকৃতকার্য হার ৭৮.৫০%, কলা অনুষদ বা ‘খ’ ইউনিটে পরীক্ষায় ফেলের হার ৯০.৪৫%, এবং বাণিজ্য অনুষদ বা ‘ ‘গ’ ইউনিটে অনুত্তীর্ণের হার ৭৯.৩৯%। সব মিলিয়ে কত শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছে তা নিশ্চয় পাঠকরা হিসেব করে বের করতে পারবেন। এই ফলাফল যে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে তা কিন্ত নয়, সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটেছে। ফলে একথা বলার সু্যোগ নেই যে এর পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ভূমিকা রয়েছে। এব ফলাফলের কারণে সব মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর অভাব হবে তা নয় (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, যেমন ইংরেজি বিভাগ)। বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আসনের চেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী এখনও প্রতিযোগিতায় টিকে আছে।
এসব ফলাফল ইঙ্গিত নয় বরঞ্চ সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দেয় যে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও মানের প্রতিফলন ঘটায় নি। এই অবস্থা যে একদিনে তৈরি হয়নি সেটা বুঝতে কারোই অসুবিধা হবার কথা নয়। গত কয়েক বছরে এই অবস্থার অবনতি হয়েছে, কিন্ত তার ভিত্তিভূমি তৈরি হয়েছে অনেক দিন ধরেই। কাঠামোগতভাবেই এই পরিস্থিতি তৈরি করার মতো অনুকূল অবস্থা ছিলো ও আছে- আমরা এখন কেবল তার অনিবার্য ফল দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছি। এই কাঠামোগত বিষয়গুলোর কয়েকটা উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। এসএসসি এবং এইচএসসি পর্যায়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার মান অর্থাৎ পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষা প্রদানের মানের পর্যবেক্ষনের কি ব্যবস্থা করা হয়েছে যা থেকে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারেন যে এই ক্ষেত্রের অবস্থা কী? কী ধরণের সূচক ও পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় মান নির্ধারন এবং মান পর্যবেক্ষনের জন্যে তা কী দেশের সব অভিভাবকরা জানেন? আমি অনুমান করি যে এমনকি শিক্ষা অনুরাগী নাগরিকরা পর্যন্ত এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন না কেননা এ সব বিষয় সাধারণ নাগরিকদের জানানো হয়নি। যারা মান নির্ধারণ করছেন এবং সেই মান অনুসরণ করা হচ্ছে কীনা তা নির্নয় করছেন তাঁদের জবাবদিহির কী ব্যবস্থা রয়েছে? কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মান অনুসরণ না করা হলে তার প্রতিবিধান কি? কেবল এমপিও তালিকা থেকে বাদ দেয়াই কি একমাত্র ব্যবস্থা হতে পারে? এই সব বিষয়ে আলোচনায় আমরা কখনোই উৎসাহী ছিলাম না; কিন্ত এখন যখন বছরের পর বছর ধরে চলা এবং ক্রমবর্ধমান সমস্যা আমাদেরকে একবারে খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে তখন অনেকেই হাহাকার রব তুলে নিজেদের হতাশা ব্যক্ত করছেন।
আরো অনেক সমস্যা রয়েছে; তার কিছু নিয়ে বিস্তর আলোচনাও হয়। তথাকথিত কোচিং ব্যবসা এবং স্কুল পর্যায় থেকে শিক্ষা বোর্ড, এমনকি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত, দুর্নীতি নিয়ে আমরা প্রায়শই শুনতে পাই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, পাঠাগার, গবেষণাগার এবং এমনকি ক্ষেত্রে বিশেষে শ্রেণী কক্ষ, না থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার অত্যাবশ্যকীয় দিক থেকে বঞ্ছিত হন; ফলে তাঁদের কাছ থেকে জ্ঞান আশা করার কোন কারণ নেই। তাঁদের কাছ থেকে যদি কেবল পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল আশা করা হয় তবে তাঁরা এর চেয়ে বেশি কিছু দিতে পারবেনা। আর সেই ভালো ফলাফল দেবার জন্যে যেনতেন উপায় বেছে নিতে উৎসাহিত করার লোকের অভাব না থাকলে এই অবস্থাই হবার কথা। সমাজে ও রাজনীতিতে যখন এই আদর্শ প্রতিষ্ঠিত যে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি বিবেচ্য বিষয় নয়, বিবেচ্য হল ফল তখন শিক্ষার্থীরা কেন কষ্ট স্বীকার করতে আগ্রহী হবে? এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে আমি শিক্ষার্থীদের এই ধরণের আচরণকে সমর্থন করছি। বরঞ্চ এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া যে শিক্ষার্থীরা কেবল বই বা ক্লাশ থেকেই শেখে না তার সমাজ থেকেও শিক্ষা লাভ করে। যে সমাজে রাজনীতিবিদরা প্রক্রিয়াকে পদদলিত করতে পারেন এই যুক্তিতে যে ফলটাই আসল কথা এবং জবাবদিহি অনুপস্থিত থাকে এই যুক্তিতে যে তাতে অনাকাঙ্খিতরা সুবিধা লাভ করতে পারে, সে সমাজে অন্যরা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভিন্ন পথ অনুসরণ করবেন কেন?
শিক্ষার সঙ্গে দৈনন্দিন রাজনীতিকে জড়িয়ে ফেলার যে কুফল সেটা এখন আমাদের চোখের সামনে হাজির হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফলের সঙ্গে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতাকে যুক্ত করে রাখা হবে; যতদিন পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রী ফল প্রকাশের দিন ফলাফল জানাতে সরকার প্রধানের দফতরে হাজির হবেন ততদিন পর্যন্ত এই বৃত্তচক্র ভাঙ্গা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করিনা। শিক্ষার বিস্তার সরকারের দায়িত্ব; সুযোগ বলুন অধিকার বলুন সেটার নিশ্চয়তার বিধান করা সরকারের কর্তব্য; শিক্ষা উপকরণ সবার হাতে যাবার ব্যবস্থা করা প্রশাসনিক দায়িত্ব; শিক্ষার মান নির্ধারন এবং তার পর্যবেক্ষন সংশ্লিষ্ট স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার বিষয় – কিন্ত ফলাফল একান্তভাবেই একজন শিক্ষার্থীর বিষয়। একজন শিক্ষার্থী যেন তার সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ভালো ফল করতে পারে সেটা দেখা সমষ্টির কাজ হতে পারে, তার অনুকুল পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব সমাজ এবং রাষ্ট্র নিতে পারে কিন্ত তার ফলের কৃতিত্ব রাষ্ট্রের হতে পারে বলে আমি মনে করিনা। সেটা করলেই দেখা যায় যে শিক্ষার্থীরা আর ‘শিক্ষার্থী’ থাকেন না হয়ে ওঠেন ভিন্ন কিছুর উপাদান। আমার কাছে মনে হয়েছে এখন বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ফলের কৃতিত্ব নিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে ফেলা হয়েছে। এর পরিণতি যে কেবল ব্যক্তি হিসেবে শিক্ষার্থীরা বইবেন এবং নিকটজন হিসবে তাঁদের পরিবারগুলো বইবেন তা নয়; এটা বইতে হবে গোটা জাতিকে। আশার বিষয় এই যে, বর্তমান অবস্থা যেমন নিয়তি-নির্ধারিত ছিল না তেমনি এটা অপরিবর্তনীয়ও নয়।
(প্রথম আলো’তে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪-এ প্রকাশিত)
থাম্বনেইলের ছবি/সূত্র: রাফায়লের আঁকা দ্যা স্কুল অব এথেন্স