November 22, 2024

http://goo.gl/eqznp8

তারেক আল-তায়েব মোহাম্মদ বুআজিজি’র কথা কি মনে আছে? তাকে তাঁর কাছের মানুষেরা ডাকতেন ‘বাসবুসা’ বলে। তিউনিসিয়ার ছোট্ট শহর সিদি বাউজিদের নগর কেন্দ্রে সবজি বিক্রেতা ছিলেন বুআজিজি। ২৪ বছর বয়সী তরুণ নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন তিউনিসিয়ার ক্ষমতাসীনদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে, ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ সালে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছিলো সারাদেশে, একমাস পার হবার আগেই ২৩ বছর ধরে ক্ষমতাসীন জাইন আল আবেদিন বেনআলীকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে হয়েছিলো। বুআজিজি এবং তিউনিসিয়ার এই ঘটনা আরব বিশ্বে যে আন্দোলনের ঝড় তৈরি করেছিলো তাকে ‘আরব বসন্ত’ বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। ‘আরব বসন্তের’ হাওয়ায় যে পরিবর্তনের সুচনা হয়েছিল তার শেষ খবর আমাদের অনেকেরই জানা আছে; গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং অংশগ্রহণমূলক শাসনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। তার বদলে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা, গৃহযুদ্ধ এবং অব্যাহত রক্তপাত। উদাহরণ অনেক, তবে কিছু নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। মিসরে সেনাবাহিনীর শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বাহরাইনের ক্ষমতাসীনরা আরো বেশি শক্তি অর্জন করে নিপীড়ক ব্যবস্থাকে জোরদার করেছে, লিবিয়ার মুয়াম্মর গাদ্দাফী ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হয়েছেন কিন্ত সেখানে গণতন্ত্র এখনও সুদূরপরাহত, সিরিয়ায় অব্যাহত গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে ইসলামিক ষ্টেট নামের একটি চরমপন্থী রাষ্ট্র, ইয়েমেনে ২০১২ সালে ক্ষমতাসীন আলী আবদুল্লাহ সালেহের দেশত্যাগের পর যতটুকু শান্তি এসেছিলো এখন তা প্রায় সম্পূর্ণ অপসৃত – চলছে শিয়াদের বিরুদ্ধে সুন্নিদের সংঘাত, এক গোত্রের সঙ্গে আরেক গোত্রের লড়াই যাতে যুক্ত হয়েছে আল কায়েদা, দেশ এখন বহুভাগে বিভক্ত হতে চলেছে। এই রকম প্রেক্ষাপটে ২০১০ সালের শেষ দিনগুলো কিংবা আশাবাদী ২০১১ সালকে আরব বিশ্বে অনেক দূরের সময় বলে মনে হয়।
এই অঞ্চলের আরব দেশগুলো যখন বিভিন্নভাবে এই ধরণের নেতিবাচক চেহারা তুলে ধরছে, তার মধ্যে তিউনিসিয়া অনেকের কাছেই ব্যতিক্রম। বিশেষ করে গত মাসে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে কোনো কোনো বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করেন যে তিউনিসিয়ায় যা ঘটছে তা আরব বিশ্বের জন্যে শিক্ষনীয়। যাঁদের নিয়মিতভাবে তিউনিসিয়ার খোঁজ খবর রাখবার সুযোগ হয়নি তাঁদের জন্যে জানাই যে তিউনিসিয়ায় বেন আলী সরকাকের পতনের পর সেখানে ২০১১ সালে গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যাতে ইসলামপন্থী দল আন-নাহাদা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। আন-নাহাদা বেনা আলীর শাসনামলে ছিলো নিষিদ্ধ সংগঠন। ২১৭ আসনের ৮৯টিতে বিজয়ী আন-নাহাদার নেতা হামাদি জেবালি প্রধানমন্ত্রী এবং মানবাধিকার কর্মি মোনসেফ মারজুকি প্রেসিডেন্ট হিশেবে দায়িত্ব নেন। গণপরিষদের ওপরে দায়িত্ব বর্তায় একটাই; তা হল সংবিধান রচনা। এই প্রক্রিয়ায় বিতর্ক দেখা দেয় নারীদের সমতার অধিকার, রাষ্ট্র এবং ধর্মের সম্পর্ক, প্রেসিডেন্টের যোগ্যতা এবং সংবিধান পাশ হবার পরে ক্ষমতার হাত বদলের প্রক্রিয়া নিয়ে। ক্ষমতাসীন আন নাহাদার ওপরে রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে চাপ তৈরি হয় দুই দিক থেকে। একদিকে উগ্র ইসলামপন্থীরা, বিশেষত আনসার আলী শরিয়া, আন নাহাদা যথেষ্ট ইসলামপন্থী নয় বলে দেশ উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়, ২০১২ সালে তাঁরা নিরাপত্তা রক্ষী ও পুলিশের ওপরে হামলা চালায়, ২০১৩ সালে তিউনিসের শহরতলিতে পুলিশের সঙ্গে এঁদের সংঘাতে মারা যায় এক ব্যক্তি । অন্যদিকে দেশের উদার সেক্যুলারপন্থীরা অভিযোগ করতে শুরু করে যে ক্ষমতাসীনরা দেশে ইসলামপন্থী নীতিমালা চালুর জন্যে সংবিধানে বিভিন্ন ধরণের নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করছে। প্রস্তাবিত সংবিধানে নারীদের সমতার বিধান না থাকায় সেই নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে একজন বিরোধী দলীয় নেতার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আন নাহাদার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় এবং তিনি পদত্যাগ করেন। অক্টোবর মাসে একজন মানবাধিকার কর্মি আততায়ীর হাতে মারা গেলে সরকার এর সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ তোলা হয়। এই সব চাপ স্বত্বেও আন নাহাদা সংবিধান তৈরির কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্যেই চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্ত প্রশ্ন থেকে যায় যে সংবিধান তৈরি হওয়া এবং পরবর্তি নির্বাচনের আগে কে ক্ষমতায় থাকবে । সেই বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয় ২০১৩ সালের অক্টোবরে – সংবিধান রচনার পরে আন নাহাদা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবে যারা নির্বাচনের আয়োজন করবে। প্রনীত সংবিধান ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি এক সাধারণ নির্বাচনে তা অনুমোদন লাভ করে। সেই সংবিধানের আওতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এ বছরের ২৬ অক্টোবর।
নির্বাচনের আগে সবার নজর ছিলো আন নাহাদা’র ওপরে; গত তিন বছরে দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের সাফল্য কম, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে কয়েক গুন এবং তাঁরা উগ্র ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই গণমাধ্যমগুলোর অভিযোগ। নাগরিকদের মধ্যে আশংকা ছিলো যে এই দফা বিজয়ী হলে দলটি আরো শক্তিশালী হবে। সেক্যুলারপন্থীদের মনে ইসলামপন্থীদের বিষয়ে যে আশঙ্কা, তার ভিত্তি থাকুক অথবা না থাকুক, সেটা তো ছিলোই। সেই প্রেক্ষাপটেই সেক্যুলারপন্থীদের মধ্যে শক্তিশালী দল হিশেবে উত্থান ঘটে নিদা তিউনেস (তিউনেসিয়ার ডাক) দলের। ২০১২ সালে এই দলের প্রতিষ্ঠা, নেতৃত্বে আছেন ৮৭ বছর বয়সী বেহি সিয়াদ এসবেসি। লক্ষনীয় হল যে এসবেসি রাজনীতিতে নতুন কেউ নন; তিনি তিউনেসিয়ার সাবেক দুই শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট – হাবিব বরগুইবা (১৯৫৭-১৯৮৭) এবং বেন আলী (১৯৮৭-২০১১)- এর মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন। প্রথম প্রেসিডেন্টের আমলে তিনি তিনবার মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন। তাঁর যে দল সেই দলের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন থেকে শুরু করে বামপন্থী এবং মধ্যপন্থীদের এক সম্মিলন ঘটেছে, কিন্ত তাঁর প্রধান শক্তি হল বেন আলীর সাবেক দল আরসিডি’র কর্মিরা। গণজাগরণের পর আরসিডি নিষিদ্ধ হয়ে যায়, কিন্ত দলের কর্মিরা এখন এসবেসি’কে কেন্দ্র করে জড়ো হয়েছে। তাঁদের ঐক্যের ভিত্তি একটাই এবং তা হল আন নাহাদা’র বিরোধিতা। তাঁদের এই বিজয়কে পশ্চিমা দেশগুলো যে ইতিবাচকভাবে দেখেছে তা বলাই বাহুল্য; কারো কারো মতে এ হচ্ছে ইসলামপন্থার বিরুদ্ধে সেক্যুলারপন্থীদের বিজয়।
কিন্ত দলের ভেতরে ইতিমধ্যেই কিছু সংকটের লক্ষন দেখা দিয়েছে। দলের সম্মেলন করার পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছে, সেটা দলের বামপন্থীদের কারণেই; কেননা বামপন্থীদের মধ্যে আশঙ্কা ছিলো যে সাবেক আরসিডি’র কর্মিরা অভ্যন্তরীণভাবে ক্ষমতা দখল করে নেবে। কিন্ত তাঁর পরিণতি খুব ভালো হয়েছে সেটা বলা যাবেনা। ২৩ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলের প্রার্থী হয়েছেন এসবেসি। আর সেই সিদ্ধান্ত হয়েছে দলের উচ্চ পর্যায়ের হাতে গোনা মানুষদের দিয়ে। এখন অবস্থা দৃষ্টে স্পষ্ট যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যদিও ৩৭ জন প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন কিন্ত আন নাহাদা’র কোনো প্রার্থী না থাকায় এসবেসির বিজয় প্রায় নিশ্চিত, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেও তাঁর সম্ভাবনা খুব বেশি নেই। আন নাহাদা কাউকে সমর্থনও করেনি। নির্বাচনের আগেই প্রশ্ন উঠছে যে এসবেসি বিজয়ী হলে পার্লামেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট হবে একই দলের। তাছাড়া নির্বাচনের প্রচারাভিযান শুরু হবার পর এসবেসি’র বক্তব্যগুলো তাঁর এক সময়কার নেতা হাবিব বরগুইবার মতোই শোনাচ্ছে। আধুনিক তিউনিসিয়ার জনক বলে পরিচিত বরগুইবার শাসনে ধর্ম এবং রাজনীতির দূরত্ব যেমন ছিলো, যেমন দুর্নীতি ছিলো নিয়ন্ত্রনে, তেমনি গণতন্ত্রও ছিলো অনুপস্থিত। বরগুইবার শাসনামলে এসবেসি যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী (১৯৬৫-৬৯) ছিলেন সে সময় বিরোধীদের সইতে হয়েছে নিপীড়ন।
গত কয়েক বছরে তিউনিসিয়ার অর্জন অনেক। সকলের গ্রহণযোগ্য একটি আধুনিক সংবিধান রচনা এবং দুটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান আরব বিশ্বের গত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহের বিবেচনায় বড় অর্জন বলতেই হবে। কিন্ত এখন তিউনিসিয়া এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে পথ দুটি — সকলের অংশগ্রহণমূলক একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি অথবা পুরনো পথে এক ধরণের কর্তৃত্ববাদী শাসনে ফিরে যাওয়া। দেশের ক্ষমতাসীনরা কোন পথ বেছে নেবেন? দেশের উদার গণতন্ত্রকামীরা এই কঠিন সময়ে কী ভূমিকা নেবেন?
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ১৬ নভেম্বর ২০১৪
থাম্বনেইলের ছবি: কার্টুন, তিউনিশিয় ডোমিনো এফেক্টের মুখোমুখি হুসনি মোবারক। সূত্র: উইকিপিডিয়া

Leave a Reply