November 21, 2024

বাংলাদেশের পুরান ঢাকার হোসনি দালান এলাকায় তাজিয়া মিছিলের প্রস্ততির সময়ে শুক্রবার গভীর রাতে বোমা হামলায় এক কিশোর নিহত হয়েছে। সেখানে একাধিক বোমা বিস্ফোরনের ঘটনা ঘটেছে বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে। বলাবাহুল্য যে এই মিছিলে অংশ নিতে সমবেতরা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। বাংলাদেশে বোমা বিস্ফোরন এখন আর বড় রকমের খবরের বিষয় নয়, কিন্ত এই বোমা বিস্ফোরণটি যে আর দশটি বোমা বিস্ফোরন থেকে আলাদা সেটা কমবেশি সবাই বুঝতে পারেন। আমার কাছে মনে হয়েছে এটি দেশে সেক্টারিয়ান ভায়োলেন্স বা ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করার ঘোষণা।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার বিষয় একেবারে নতুন ঘটনা সেটা সবশ্যই বলা যাবেনা। কেননা ইসলাম ধর্মের অনুসারী আহমাদিয়া গোষ্ঠীর সদস্যরা অনেক দিন ধরেই আক্রান্ত হয়ে এসেছেন। ১৯৮০-এর দশকে খতমে নবুয়ত আন্দোলন নামে একটি সংগঠনের প্রসার ঘটার পর থেকে আমরা আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের প্রচার এবং তাঁদের ওপরে হামলা প্রত্যক্ষ করি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সেটাই ছিলো ধর্মীয় সম্প্রদায় পরিচয়ের কারনে কোনো গোষ্ঠীর আক্রান্ত হবার ঘটনা। এই ধরণের পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে অব্যাহত থাকলেও এই ধরণের বোমা হামলার ঘটনা ঘটেনি। শিয়া সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বিভিন্ন রকমের অনাকাঙ্ক্ষিত ও বৈষম্যমূলক এবং তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে অবমাননাকর মন্তব্য শোনা গেলেও তাঁদের ওপরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে এমন জানা যায় না। তাছাড়া এই হামলা কেবল ঐ সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপরে হয়েছে তা নয়, এ ক্ষেত্রে তা হয়েছে ঐ সম্প্রদায়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ওপরে, সেখানে সমবেত মানুষদেরকে লক্ষ্য করে। পূর্ব বাংলায় শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সংখ্যা সব সময়ই ছিলো অত্যন্ত কম। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনামলেও ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েনের অসংখ্য ঘটনা ঘটলেও পূর্ব বাংলায় শিয়া-সুন্নি সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সংঘাতের ঘটনা বিরল। উত্তর ভারতের ক্ষেত্রে তা বলা যাবেনা। বাংলায় এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে অসমতা স্বত্বেও সম্পর্কে টানাপোড়েন না থাকার একটা কারন অবশ্যই সংখ্যাল্পতা। কিন্ত আরেকটি কারন হল
পুর্ব বাংলার সাধারন মানুষ সম্প্রদায়গত এই বিভাজন নিয়ে চিন্তিত ছিলো না। সেই সময়ে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রধানত নগরাঞ্চলে (যেমন মুর্শিদাবাদ, হুগলী, ঢাকা, কোলকাতা) থাকতেন। ১৮৮৩ সালে জেমস ওয়াইজের প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে যে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ কমছে কেননা তাঁরা সুন্নি মহিলাদের বিয়ে করছেন। তার অর্থ তখনও আন্তঃসম্প্রদায় বিয়ে মোটেই অগ্রহনযোগ্য ছিলো না। শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা যে তাঁদের স্বতন্ত্র পরিচয় বহাল রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন, সেটা আমরা জানতে পারি রফিউদ্দিন আহমদের ‘দি বেঙ্গলি মুসলিমস ১৮৭১-১৯০৬; এ কোয়েস্ট ফর আইডেন্টিটি’ গবেষণা গ্রন্থে। তিনি আমাদের এও স্মরণ করিয়ে দেন যে, মুর্শিদাবাদের নবাব এবং ঢাকার নবাব পরিবার ছিলো শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। শুধু তাই নয়, দানবীর হিশেবে পরিচিত হাজী মুহম্মদ মহসিন ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। তার মৃত্যুর পরে তার ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের এলিট নেতাদের মধ্যে বিরোধ হয়েছিল। হুগলী ইমামবাড়া পরিচালনায় সুন্নী সম্প্রদায়ের সদস্যদের অংশগ্রহণ নিয়ে আপত্তি ছিলো শিয়াদের। কিন্ত তাতে হুগলী ট্রাষ্ট, যেখান থেকে বিভিন্ন রকম দান করা ও বৃত্তি দেয়া হতো, তার কাজে বিঘ্ন হয়নি। সৈয়দ আমীর আলী, মুসলিম শিক্ষাক্ষেত্রে যার অবদান অসামান্য, তিনিও ছিলেন এই সম্প্রদায়ের মানুষ এবং তিনি মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছিলো, কিন্ত তা হালে পানি পায় নি। রফিউদ্দিন আহমেদ আমাদের জানান যে, মোহররমের সময় আলাদা করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকতো, হুমকিও থাকতো কিন্ত সুন্নী সম্প্রদায়ের মানুষ এতে অংশ নিতো এবং সহিংসতা ঘটেছে কালে ভদ্রে।
পাকিস্তান আমলেও শিয়া-সুন্নী সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমার খুব একটা পরিবর্তন দেখতে পাইনা। আর এটাও তো স্মরণযোগ্য যে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্য। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শিয়াদের উপস্থিতি আমার বিভিন্নভাবে লক্ষ্য করি এবং এই বিষয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানেও খুব বেশি টানাপোড়েন হয় না তার কারন দু’টি বলে আমরা চিহ্নিত করতে পারিঃ প্রথমত পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্নে পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে ইস্লামকে তার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেনি। এই বিষয়ে অব্যাহত বিতর্কের কারনেই পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন বিলম্বিত হয়। দ্বিতীয়ত সেই সময়ে যে ব্যবসায়ীদের পাকিস্তানের আসবার জন্যে উৎসাহিত করা হয়েছিলো তাঁরা সংখ্যালঘু মেমন, বোহরা, খোজা ইশনা-আশারি, খোজা-ইসমাইলী সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।
এই ইতিহাস বলার উদ্দেশ্য একটাই – তা হল শিয়া-সুন্নী বিরোধের প্রশ্নটি পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অনুপস্থিত ছিলো। পাকিস্তানেও এটি ছিলো অনুপস্থিত। কিন্ত পাকিস্তানে তার সূচনা হয় জিয়াউল হকের শাসনামলে, ১৯৭৭ সালের পরে। পাকিস্তানের ইসলামীকিকরণের যে প্রক্রিয়া তাই সম্প্রদায়গত বিভক্তির প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লব, ইরানী বিপ্লবের প্রভাব বিস্তার রোধে সৌদি আরবের কূটকৌশল, আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর প্রবেশ, আফগানিস্তানের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র সমর্থন, পাকিস্তানে আফগান শরনার্থীদের অবস্থান। এই সম্প্রদায়গত বিভক্তির ধারাবাহিকতায় আমার দেখতে পাই যে পাকিস্তানে দেওবন্দের অনুসারীরা তৈরি করে আঞ্জুমানে সিপাহী-ই-সাহাবা (১৯৮৫) যা পরে সিপাহী-ই-সাহাবা নাম ধারন করে; আহলে হাদিসের অনুসারীরা তৈরি করে লস্কর-ই-তৈয়বা (১৯৮৮); শিয়া সম্প্রদায় তৈরি করে সিপাহি-ই-মুহাম্মদ (১৯৯১); বারেলভিরা তৈরি করে সুন্নী তাহরিক (এবং পরে আঞ্জুমানে সিপাহ-ই-মুস্তফা); ইতিমধ্যে ১৯৯৪ সালে সিপাহ-ই-সাহাবা ভেঙ্গে তৈরি হয় লস্কর-ই-জংভী।
এই সম্প্রদায়গত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর উত্থানের পেছনে কাজ করেছে একাধারে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বহুল আলোচিত এবং উপরে উল্লিখিত। ইরানী বিপ্লব এই ধারণা তৈরি করতে পেরেছিলো যে ইসলামী বিপ্লব কোনো কল্পনা নয়, অন্যদিকে ধর্মকে ব্যবহার করে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ধারনা চালু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ধারনাই প্রতিষ্ঠিত করে যে সারা পৃথিবীর মুসলমানরা একটি দেশে সমবেত হয়ে যুদ্ধ করতে পারে।
কিন্ত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যে দুটি দিক এই জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর বিস্তারের ক্ষেত্রে ধাত্রীর ভূমিকা পালন করে তা হল দেশে জবাবদিহিহীন শাসন এবং রাষ্ট্রের শক্তি প্রয়োগের ধারা। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির সুযোগে পরস্পর বিরোধী এই সব সশস্ত্র গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে চাপিয়ে দিতে পেরেছে এবং তাতে সাহায্য করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। ইসলামপন্থী এই সব দলের ছত্রছায়ায় এদের বিকাশ, কিন্ত রাষ্ট্র তাঁদের মোকাবেলায় সাধারনের শরণাপন্ন হয় নি – উপরন্ত সাধারনের ওপরে নির্যাতন চালানো হয়েছে, মধ্যপন্থী দলগুলোকে রাজনীতির বাইরে রাখা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক গোষ্ঠীকে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে সম্প্রদায়গত বিভেদকে টিকিয়ে রেখেছে রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীনরা। দেশের সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা হয় তাঁদের সাহায্য করেছে, নতুবা তাঁদের ব্যাপারে পালন করেছে এক ধরণের উদাসীনতা। গোষ্ঠীগত আক্রমন এবং প্রতি-আক্রমণের (তা আত্মরক্ষার নামেও যদি হয়) এই ধারা একবার তৈরি হলে তা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পাওয়া যায় না, পাকিস্তানের ইতিহাস তাই বলে। রাষ্ট্র দায়মুক্তির, সম্প্রদায়গত সহিংসতার ব্যাপারে বিচারহীনতার এমন এক সংস্কৃতি তৈরি করেছে যে তা দেশের অস্তিত্বকেই বিপদাপন্ন করেছে। পাকিস্তানে যখন এই ভয়াবহ প্রক্রিয়ার সূচনা হয় তখন ক্ষমতাসীনরা একাধারে নিজেদের টিকে থাকার কাজে এবং মার্কিনীদের মনোতুষ্টিতে ব্যস্ত ছিলো। এইসব অবস্থার সুযোগে দেশের ভেতরে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিভক্তি বেড়েছে, দেশীয় জঙ্গী গোষ্ঠীর বিস্তার ঘটেছে এবং তাঁরা সুযোগ পাওয়া মাত্র আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কিন্ত পাকিস্তানে সম্প্রদায়গত বিরোধের হানাহানির প্রথম দিনটিতে নিশ্চয় কেউ অনুমান করেন নি যে এই পরিণতি কী হবে।
বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং গত কয়েক মাসে যেসব ঘটনা ঘটছে তার প্রেক্ষাপটেই এই হামলাকে বিবেচনা করতে হবে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি, মত প্রকাশের ওপরে নিয়ন্ত্রন, শক্তি প্রয়োগের ওপরে ক্ষমতাসীনদের অতিমাত্রায় নির্ভরতা, কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি, স্থানীয় জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর শক্তি সঞ্চয়, বিদেশি নাগরিকদের হত্যার পটভূমিকায় এখন সম্প্রদায়গত সহিংসতা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করবে। সেই সব দিক বিবেচনা করেই আমার কাছে মনে হয়েছে দেশে সেক্টারিয়ান ভায়োলেন্স বা ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করার ঘোষণা হচ্ছে এই বোমাবাজি।

Leave a Reply