ফজলুল হক স্যার বলেছেন “বিচার চাই না”। পত্রিকায় এই কথা পড়ে হতচকিত হয়েছি, রোমাঞ্চিতও হয়েছি। কী করে একজন বাবা এমন করে ভাবতে পারেন? নিছক অভিমানের কথা মনে হয় নি এটাকে। এর অর্থ নিশ্চিত বলা না গেলেও টের পেয়েছি, ফজলুল হক স্যার একটা ধাক্কা দিয়েছেন। এই মুহূর্তে এর চাইতে শক্ত প্রতিবাদ আর কী হতে পারে? আমি হয়ত কিছু তত্ত্ব আর কল্পনার মধ্য দিয়ে স্যারের কথাটা বোঝার চেষ্টা করব। কিন্তু কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উর্ধ্বে একটি অদ্বিতীয় ঐতিহাসিক স্লোগান “বিচার চাই না”। এটা আমার বিশ্লেষণ নয়, অনুভব। ফজলুল হক স্যার সাহিত্যের শিক্ষক। সব জ্ঞানের মিলনস্থল সাহিত্য। সেখানে অনেক বছর ধরে বিচরণ করেছেন তিনি। অনেকের শিক্ষক ছিলেন, আলো দেখিয়েছেন। আজকের তিন শব্দে যে তেজ আর দিপ্তী, এই সময়ের সব ক্ষুদ্রতাকে ছাপিয়ে গেছে। অনুভবের জমিনে আর বেশিক্ষণ থাকব না, আমার স্বভাবগত বিশ্লেষণ চেষ্টার জমিনেই ঢুকব।
কোন একটা ঘটনার ফল হিসাবে যখন সমাজ পাল্টে যাবার উপক্রম হয়, সে পরিবর্তনটা প্রগতি হবে কি হবে না, কী করে বুঝব? অথবা এই পরিবর্তনের ফলে আমাদের সমাজ আরো ন্যায়ভিত্তিক হয়ে উঠবে নাকি সামাজিক ন্যায্যতা কমে যাবে? কীভাবে বুঝব আমি আমার ব্যক্তি বা শ্রেণীস্বার্থের ভেতরে থেকে পক্ষপাতমূলক অবস্থান নিচ্ছি না। ভবিষ্যত আমরা দেখি না, আমাদের ভবিষ্যত জ্ঞান অতীতের উপর ভর করে দাঁড়ায়। চিন্তার সুবিধার জন্যই আমরা মাপকাঠি খুজি। কারো কারো চিন্তা থেকে ধার করে একটা আনুমানিক ভাবনা ভেবেছিলাম, যেটাকে পণ্ডিতরা ‘থট এক্সপেরিমেন্ট’ বলেন। ফজলুল হক স্যারের কথা শুনে ভাবনাটা মনে পড়ল।
ধরা যাক আপনার সবচাইতে আপনজন, যেমন আপনার সন্তান। তার কথা ভেবে আপনি ঘুম থেকে ওঠেন, ঘুমাতে যান, যার ভবিষ্যতের জন্য আপনি ঊদয়াস্ত পরিশ্রম করেন। সে চোখের আড়াল গেলে এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকতে পারেন না। হঠাৎ করে একদিন ঘোষনা এল, আপনার সন্তান জন্মানোর পর তাকে আপনি আর দেখবেন না। তার চেহারাও আপনার অপরিচিত থাকবে। আপনাকেও সে চিনবে না। এরপর তাকে সমাজের যে কোন একটি পরিবারে, পরিস্থিতিতে বড় হতে দেয়া হবে। লটারির মাধ্যমে ঠিক হবে কোন পরিবারে বা পরিস্থিতিতে সে বড় হবে। অথবা হঠাৎ একদিন বাংলাদেশের সব বাবা মা-’র সন্তানরাই অদল-বদল হয়ে এক বিশাল কাণ্ড হল। অদলবদলকাণ্ড। আপনি কারো কারো সন্তানের বাবা অথবা মা হলেন। এমন অবস্থায় আপনি কেমন সমাজ চান? আপনি জানেন অন্য কোন একটি পরিবারে বা পরিস্থিতিতে আপনার সন্তানটি বড় হচ্ছে। আপনি যখন দেখবেন সেই সমাজে কোন একটি বাচ্চা অসতর্কতার জন্য একটি গর্তে পড়ে আছে, একদিন পার হলেও তাকে উদ্ধার করা যায় নি, আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে? অথবা চুরির অপবাদে একটি বাচ্চাকে যখন পিটিয়ে মারা হবে, আপনার কি মনে হবে না, সে আপনার সন্তানও হতে পারত। হয়ত এভাবে কোন বাচ্চাতে পেটাতে গেলেও কেপে উঠতে পারে নিষ্ঠুরতম হাতটিও। তাহলে আমাদের মাপকাঠিটা কী দাঁড়াল? আমরা একটি ঘটনায় সিদ্ধান্ত নেবার সময় ভেবে দেখতে পারি, হঠাৎ অদলবদলকাণ্ড ঘটে গেলে আমরা কী চাইতাম? সম্ভবত এভাবে ভাবলে ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজের শর্তগুলো আমাদের সামনে আরেকটু স্পষ্ট হত!
এই কল্পতরু বাস্তব থেকে অনেক দূর বিবর্জিত এমন নয় আসলে। রানা প্লাজায় আহত-নিহতদের পরিজনদের কাছে এমনই কল্পতরু সেদিন প্রাণদায়ি হয়ে উঠেছিল। তাঁরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রিয়জনকে উদ্ধার করতে বিদ্ধস্ত দালানের ভেতরে ঢুকে পড়ছিলেন। কেউ কেউ তাঁদের ভাবনার ব্যখ্যা দিয়েছেন বলেই সেটা বোঝা সম্ভব হয়েছে। হয়ত নিজের বোনটিকে খুঁজতে এসে পাননি। তখন নেমে পড়েছেন সম্মিলিত উদ্ধারে, আশা করছেন উদ্ধারকর্মী অন্য কেউ হয়ত খুঁজে পাবে তার বোনকে, আর তিনি হয়ত খুঁজে পাবেন অন্য কারো বোনকে। সংকটের মুখে একধরনের সম্মিলিত ভাবনার উদ্ভাস দেখা যায়। সেদিন এমন হয়েছিল। একটি সমাজ একটি দেহের মত হয়ে উঠেছিল। আজকে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, সেখানেও কি রানাপ্লাজা ধ্বসে পড়ার মত পরিস্থিতি হাজির হয়নি আমাদের সামনে? আপনি যখন আপনার পরিজনের নিরাপত্তার কথা ভাবছেন, অন্যের সন্তানের প্রতি আপনার মমতা কি আপনার সন্তান বা পরিজনের জন্যেও দরকারি হয়ে উঠবে না? কিছুক্ষণ গভীর ভাবে ভাবলে রানা প্লাজার সাথে আজকের দুর্যোগের মধ্যে আমরা কি কোন মিল খুঁজে পাব? নাকি কি এখনো সেই সময় আসে নি?
ফজলুল হক স্যারের কথায় আবার ফিরে আসি। উনার ছেলে মারা গেছেন। হত্যার শিকার হয়েছেন। সন্তান, বাবা, অথবা পরিজনের মৃত্যু মানুষকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। মানুষ জৈবিক পরিচয়ের অংশ এই প্রবনতা। এর উর্ধ্বে ওঠা সহজ কাজ নয়। “বিচার চাই না” শুনে প্রথমেই তাই থমকে যেতে হয়। ব্যপারটা এমন নয় যে আমি এমনটা প্রত্যাশা করি না কোন মানুষের থেকে। বরং এমন শক্তিমান মানুষদেরই আমাদের দরকার, কিন্তু তারা বিরল। তাদের দেখা যদিও বা কালেভদ্রে মেলে, আমাদের মনযোগ সহসাই অন্যদিকে সরে যায়। তিনি চোখের নিমিষেই একদিকে অনেক উর্ধ্বে উঠলেন, আবার অন্যদিকে মাটিতে নেমে এলেন। বাস্তবতার মাটিতে। এই উর্ধ্বে উঠতে পারা তাকে বাস্তবতার একজন সফল পাঠক আর পর্যবেক্ষকই বানাল না কেবল, তিনি একটি দারুন স্লোগানও আমাদের হাতে তুলে দিলেন — “বিচার চাই না”। বারবার তিনি মনে করিয়ে দিলেন বুঝে শুনেই বলেছেন এই কথা। যারা সান্ত্বনা দিয়ে এই দীপ্তি থেকে আপনার চোখ সরিয়ে নিতে চায়, বা সেটাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে চায় তারা কী চায় তারাই বলতে পারে।
অনুমান করা যায় স্যারের দৃষ্টিতে আজকের বাংলাদেশ, আর এই দেশের সমাজ রানাপ্লাজা হয়ে ধ্বসে পড়েছে। সন্তানেরা সব চাপা পড়ে আছে সেখানে। কালো পট্টি বাধা লেডি জাস্টিসের মতই ফজলুক হক স্যার। কঠোর কিন্তু অন্ধ লেডি জাস্টিসের মত, যেন চোখে কালো পট্টি বাধা। তাই তিনি আপন পর আলাদা করছেন না। কিন্তু একই সাথে কঠোরও তিনি। বিষাদ্গ্রস্ত না হয়ে দৃঢ়তা ধরে রেখেছেন তার প্রত্যয়ে, প্রকাশে। যেই আততাইয়ীরা তার সন্তানের হত্যার জন্য দায়ি, তারাও স্যারের সন্তান হতে পারত, এমনটাও হয়ত স্যার ভেবেছেন। বলছেন তাদের প্রতি স্যারের কোন অভিযোগ নেই। যেন খুব বাচ্চা অবস্থায় স্যারের কোন ছেলে হারিয়ে গিয়েছিল। তাকে তিনি আর খুঁজে পাননি। এই সমাজেরই কোন একটি অন্ধগলিতে, এতিম খানায়, মাদ্রাসায় অথবা অন্য কোথাও ভালবাসাহীন পরিবেশে ছেলেটি বড় হয়েছে। তার বন্ধুটি হয়ত শাপলা চত্ত্বরে মিছিল করতে এসে মরে গিয়েছিল। কেউ সেই মৃতদেহটিকে হাজার দিয়ে গুণ করেছে, আর অন্যদিকে অন্য কেউ হয়ত তাকে গোণাতেই ধরে নি। দীপণকে যারা মেরেছে তাদের মধ্যে সেই হারানো সন্তানটিও থাকতে পারে। যে মারা গেছে সেও হয়ত স্যারের এমনই একজন সন্তান। আলাদা করে কেবল দীপনের বাবা তিনি হতে পারেন নি, অথবা হতে চান নি।
সলিল চৌধুরীর অনবদ্য গান, “বিচারপতি তোমার বিচার……”। জনতা জাগুক বা না জাগুক, কিন্তু এই স্লোগান কোন সামান্য স্লোগান নয়। বিচার চাওয়া আর না চাওয়ার মধ্যে ফারাক সামান্য নয়। বিচার মানুষ কার কাছে চায়? বিচারপতির বিচার তবে কাকে বলে? আমাদের হৃদয়গুলো যদি প্রাণহীন হয়ে না গিয়ে থাকে, সেখানে প্রাণের সঞ্চার করার সব গুণ এই স্লোগানের আছে। আর কিছু না করি আমরা কি অন্তত ভাবতে বসব, কীভাবে এখানে এসে পৌছালাম? শাহাবাগের থিসিস এখন এন্টিথিসিস আকারে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। সিনথেসিস কীভাবে হবে? সেটার উত্তর আমরা বের করতে চাই কি? ন্যায়বিচারের বিবেচনার গণ্ডী কেবল দাপ্তরিক আদালতেই আটকে থাকে না। সেই দাপ্তরিক বিচারালয়ের ইট-কাঠ-পাথরের উপর প্রাণ আসে তার ন্যায্যতায়, নিষ্ঠায়, নিরপেক্ষতায়। সেই প্রাণ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব কে নেবে?