পৌরসভাগুলোর নির্বাচনের পর এক সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে। এখন আমরা সুস্থিরভাবে ‘নির্বাচনের’ একটা মূল্যায়নের কথা বিবেচনা করতে পারি। তিরিশে ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে অনেকে বিভিন্ন রকম আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তার মধ্যে অনেকে এই আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সম্ভবত এই নির্বাচনে অংশ নেবেনা। তাঁদের এই আশঙ্কার কোন ভিত্তি ছিলোনা এই কারনে যে, বিএনপি ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে বা জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচনগুলোতে অংশ না নিলেও সব ধরণের স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ফলে এই নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়টি যারা বলছিলেন তাঁরা তাঁদের ধারণার কথা বলছিলেন, কারো কারো কথায় মনে হচ্ছিল বিএনপি অংশ না নিলেই তাঁরা আনন্দিত হন। তদুপরি ২০১৫ সালের গোড়াতে তিন মাসের ‘আন্দোলনের’ সামগ্রিক ব্যর্থতা, সাংগঠনিকভাবে দুর্বল পরিস্থিতি, নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং সরকারী চাপের মুখে সাংগঠনিকভাবে পর্যুদস্ত বিএনপির সামনে এই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিলো না। নির্বাচনের ফলাফল নয়, তাঁদের জন্যে চ্যালেঞ্জ ছিলো অংশগ্রহণ করা এবং শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা। নির্বাচন কেমন হবে সেই বিষয়ে বরঞ্চ অনেক বেশি সুস্পষ্ট ধারনা প্রকাশিত হয়েছিলো নির্বাচনের আগেই। পুলিশের মাধ্যমে করা জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হলে এই বিষয়ে আর সংশয় থাকে না যে ক্ষমতাসীনরা এক বড় ধরণের বিজয়ের নিশ্চয়তা তৈরি করেছেন।
এই পটভূমিকায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। নির্বাচনের ব্যাপারে এটা প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে, মোট ভোটারের সংখ্যা ছিলো ৬১ লাখ যা বাংলাদেশের মোট ভোটারের ৮ শতাংশের চেয়ে কম। ফলে ভোটার সংখ্যার বিবেচনায় এই নির্বাচনের তাৎপর্য খুব বেশি হবার কথা নয়। কিন্ত একাধিক কারনে এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার একটি হচ্ছে এই প্রথমবারের মতো মেয়রদের দলগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ। আরেকটি হচ্ছে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে তার অবস্থান ও অস্তিত্ব প্রমাণে সফল হবে কিনা সেটা দেখা। নির্বাচন কেমন হল? এই বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে যারা আছেন তাঁরা সম্যকভাবে অবহিত। একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক পীর হাবিব নির্বাচনের দিন ফেসবুকে লিখলেন, ‘চারদিকে যে খবর, এ ভোট না লুট’। ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুশতাক হোসেন নির্বাচনের মধ্যেই লিখলেন, “নির্বাচন নিয়ে ইতিহাসের দুঃখজনক পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ১৯৭৮-১৯৮৮ সালে জিয়া-এরশাদ বলতেন অবাধ নির্বাচন দিলে আওয়ামী-বাকশাল, জাসদ-বামওয়ালারা জিতে যাবে। তাই ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ (পড়ুন ১৯৭১এর পাকিস্তানী ভাবধারা) প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘ভারতের দালাল’দের ও ‘কমিউনিস্ট’দের ভোটে জিততে দেয়া যাবে না। তাই ‘মেকানিজম’ করেই ভোটে জিততে হবে। আর আজ! রাজনৈতিক যুক্তি উল্টোটা, কিন্তু ‘মেকানিজম’ একই। ভুল ‘মেকানিজমে’ কি সঠিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা যাবে?”
গোলাম মোর্তোজা লিখলেন, ‘পরিষ্কার ধারনা করেছিলাম-বলেছিলাম-লিখেছিলাম, পৌর নির্বাচন হবে, আগের কয়েকটি নির্বাচনের মতোই। … বলতে চেয়েছিলাম ভোটারদের ভোট দিতে হবে না, কিন্ত ভোটের বাক্স ভরে যাবে। পৌর নির্বাচনে ভোটের বাক্স ভরে গেছে, ভোটারদের কষ্ট করে ভোট দিতে হয়নি” (কারও সঙ্গে মিলছে না, গোলাম মোর্তোজা, প্রিয় ডট কম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫)। সংবাদপত্রগুলোর খবর হিসেবে যুগান্তর এবং ডেইলি স্টারের কথা উল্লেখ করি – “প্রশ্নবিদ্ধ ভোট : ইসির ভরাডুবি”, “Irregularities aplenty” । রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে সরকারিভাবে স্বীকৃত ‘বিরোধী দল’ জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের সদস্য জি এম কাদের বলেন, ‘এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না’।
সিপিবি সমেত চার দল আলাদা আলাদা বিবৃতি দিয়ে বলেছে ‘পৌরসভার নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে’। ক্ষমতাসীন জোটের অন্যতম শরিক জাসদের সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরুল আম্বিয়ার বক্তব্য, ‘আমাদের প্রত্যাশা বড় কিছু ছিল না। প্রথমত, আমরা চেয়েছিলাম দলের ভোটের শতকরা হার যাচাই করে দেখতে। কিন্তু কেন্দ্র দখল হলে সেই সুযোগ আর থাকে না। তা ছাড়া অনেক জায়গায় সত্যিকার ভোট হয়নি।’ বিএনপি নির্বাচনে কারচুপি ইত্যাদির কথা বললেও, এই নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করলেও সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী “ভরাডুবিকেও ‘সাফল্য’ ভাবছে বিএনপি”।
নির্বাচনের এই পরিস্থিতিতে কেউ কেউ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, বিএনপির আমলে এর চেয়ে ভালো কিছু হয়নি। এই কথার সমর্থনে যারা বিএনপি আমলের সংবাদপত্রের পাতার ছবি তুলে ধরেছেন তাঁরা অবশ্যই ধন্যবাদ দাবি করতে পারেন। আশা করি এই সব ছবি না দেখলেও আমাদের মনে আছে অতীতে কি ঘটেছিলো। ক্ষমতায় থাকার সময়ে বিএনপির এই কার্যক্রমের ফল কী হয়েছে তা কি আমরা বিস্মৃত হয়েছি? তা ছাড়া বিএনপির এই ভূমিকা যে গণতান্ত্রিক আচরণ ছিলো না তা যে কেউ স্বীকার করবেন। বিএনপির এই ইতিহাস টেনে এনে এই পৌরসভার নির্বাচন যে ওই মাত্রার তাই কি প্রকারান্তরে বলা হল না?
এবার তাহলে ফলাফলের দিকে তাকানো যাক। ২৩৪টি পৌরসভায় নির্বাচন হবার কথা। এর মধ্যে সাতটিতে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। আর ফলে মোট ভোট গ্রহণ হয়েছে ২২৭টি পৌরসভায়। অনিয়মের কারণে ২০টি পৌরসভায় ফল প্রকাশ স্থগিত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ পেয়েছে ১৬৮টি মেয়র পদ, বিএনপি ১৯টি, জাপা ১টি। ২৬টি মেয়র পদে জিতেছে আওয়ামি লীগের ১৭ জন বিদ্রোহী প্রার্থী, বিএনপির ২ জন বিদ্রোহী প্রার্থী এবং ৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এই ফলাফলের সঙ্গে ২০১১ সালের পৌরসভার নির্বাচনের তুলনা করা একার্থে কঠিন, কিন্ত স্মরণ করা যেতে পারে যে সেই নির্বাচনে বিএনপির ৯২ জন মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলো, আওয়ামী লীগের ৮৮ জন। নির্বাচন মানেই অনিশ্চয়তা, ফলে এই নির্বাচনে আগের নির্বাচনের মতো ফলাফল হবে এমন আশা করাটাই অসমীচীন।
কিন্ত এই নির্বাচনের যে দিকটি লক্ষ্যনীয় তা হল ভোটের হার। প্রশ্ন উঠছে নির্বাচনের প্রদত্ত ভোটের হার কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুযায়ী ভোট পড়েছে ৭৪ শতাংশ। ২০১৪ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬২ থেকে ৬৪ শতাংশ। তার আগে ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেখানে ১৪৭টি আসনের জন্যে ভোট গ্রহণ হয়েছিলো সেখানে সরকারী হিসেবে ভোট পড়েছিল ৪০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। সর্বশেষ ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ভোটের হার ছিল ৪৪ শতাংশ। স্পষ্টত এই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার অনেককেই বিস্মিত করেছে। কিন্ত আমরা এই হার নিয়ে সংশয়ী হতাম না যদি না তার মধ্যে দৃশ্যত কিছু অন্য কিছুর ইঙ্গিত থাকতো। কেননা ২০০৮ সালের সাধারন নির্বাচনে ৮৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি আমাদের মনে কোন সংশয়ের তৈরি করেনি, যেমন করেনি ২০০১ সালে প্রায় ৭৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি। এই সব নির্বাচনে কে বিজয়ী হয়েছে সেটা দিয়ে নির্ধারিত হয়নি ভোটারের উপস্থিতি স্বাভাবিক কিনা। কোনো বিশেষ দলের হারা জেতার ওপরে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কিনা সেটা নির্ভর করে না।
ভালো করে অনুসন্ধান করলে যে সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট যে এই হার স্বাভাবিক নয়। ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৭৪টি পৌরসভায়। ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে ৬৩টি পৌরসভায়। ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫টি পৌরসভায়। মাত্র দুটি পৌরসভা ছাড়া বাকি সবগুলোতে ৬০ শতাংশের ওপরে ভোট পড়েছে। সব মিলে ক্ষমতাসীন দলের প্রাপ্ত ভোটের গড় হার ৫৩.৫৪ শতাংশ। কিন্ত সেই হারে পৌঁছুতে ৩১টি পৌরসভায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। এর মধ্যে ১৪টিতে পেয়েছে ৯০ শতাংশের ওপরে। বিপরীতক্রমে ২০৪টি পৌরসভায় বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের হার ২৭.৬৭ শতাংশ। বিএনপি’র প্রাপ্তির চেয়েও বেশি জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে যে এই সংখ্যাগুলোকে স্বাভাবিক মনে হয় কিনা। মাত্র আট শতাংশ ভোটারের ওপরে আস্থা রেখে ক্ষমতাসীনরা দেখতে পারতেন যে বিএনপির মতো সাংঠনিকভাবে পর্যুদস্ত এবং তার নেতৃবৃন্দের বিতর্কিত বক্তব্য প্রদানের পর দলটি আসলেই মানুষের কাছে আর গ্রহণযোগ্য আছে কিনা। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন এবং ২০১৫ সালের ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মধ্য নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতা এখন শুন্যের কোঠায়। রাজনৈতিক দলগুলো এই কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তার অর্থ এই নয় যে প্রাতিষ্ঠনিকভাবে তাঁরা একে কার্যকর বলে মনে করে। অন্যথায় রাজনৈতিক দল্গুলোকে স্বীকার করতে হবে যে তাঁদেরকেও বাংলাদেশের ভোটাররা একেবারেই প্রত্যাখান করেছে। কেননা হিসেব অনুযায়ী জাতীয় পার্টি (জাপা) পেয়েছে ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ ভোট (প্রার্থী ৭০টি পৌরসভায়)। জাসদ ৩ দশমিক ৩০ (প্রার্থী ১৯টি পৌরসভায়), ওয়ার্কার্স পার্টি ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ (প্রার্থী ৬টি পৌরসভায়), কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) শূন্য দশমিক ৭১ শতাংশ (প্রার্থী ৪ পৌরসভায়)।
এই সব বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনই শুধু নয়, নির্বাচনী ব্যবস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে কিনা সেটাও ভাবা খুবই জরুরি। আজ যারা ভাবছেন যে এতে করে কেবলমাত্র একটি বিশেষ দল বা গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন নাগরিকদের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব কোন দলের বিষয় হতে পারেনা। অনেকেই বিরাজমান পরিস্থিতির জন্যে ২০১৪ সালের সাধারন নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তকে দায়ী করেন। বিএনপি’র এই সিদ্ধান্ত বিএনপির জন্যে যে ক্ষতিকারক হয়েছে সেটা সহজেই বোঝা যায়, দলগতভাবে তার পরিণতি বিএনপি’কেই বইতে হবে। জামাতের সঙ্গে সখ্যের লাভ যদি দল পেয়ে থাকে তার ক্ষতিও তাকেই বইতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ এবং গণহত্যার বিচারের প্রশ্নে দলের অবস্থানকে স্পষ্ট না করার যে ক্ষতি বা পরিণতি সেটা যারা বিএনপি করেন তাঁদের প্রাপ্য। কিন্ত অন্য যারা ২০১৪ সালে এই যুক্তিতে নির্বাচন বর্জন করেছিলেন যে তাঁরা সুষ্ঠূ নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখেন না, নাগরিকদের প্রতি তাঁদের কি এই বিষয়ে কোন দায়িত্বই নেই? অন্যদিকে যারা ক্ষমতাসীন জোটের অংশীদার কিন্ত বুঝতে পারেন অতীতের ‘নির্বাচনের মেকানিজম’ দেশের জন্যে ভাল হয় নি তাঁরা এখন এই নির্বাচনী মেকানিজমের বিষয়ে নিরবতাকে কেন সঠিক ভাবছেন?
এই মুহুর্তে এই সব ব্যবস্থা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যাচ্ছে বলে তাঁরা এবং তাঁদের সমর্থকরা ভাবতে পারেন যে এই নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। কিন্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ভেঙ্গে পড়ছে তা ভবিষ্যতে এমন গোষ্ঠী ও শক্তিকেও সাহায্য করতে পারে যারা এই ধরণের প্রতিষ্ঠান রাখতেই চান না। ক্ষমতাসীনদের আচরণে সেই পথ তৈরি হচ্ছে কিনা ক্ষমতাসীনদের সমর্থকরা সেটা ভেবে দেখতে পারেন।
৫ জানুয়ারি ২০১৬