পরমাণু শক্তি হ্রাস ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ইরান তার প্রতিশ্রুতি পালন করেছে—জাতিসংঘের পারমাণবিক সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে এ কথা বলার পর ইরানের ওপর ২০০৩ সাল থেকে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটেছে। গত বছরের মাঝামাঝি ইরান জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানির সঙ্গে পরমাণু শক্তি হ্রাস বিষয়ে যে চুক্তি করেছিল, তার পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপের তৃতীয় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ সাফল্যের সঙ্গে পূরণ করার ফলে এখন ইরানের ওপর আর কোনো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থাকল না। এর আশু প্রতিক্রিয়া হচ্ছে যে ইরান আবার বিশ্ববাজারে তেল রপ্তানি করতে সক্ষম হবে এবং অনুমান করা হচ্ছে যে এতে করে দেশটি অচিরেই বিশ্ববাজারে দৈনিক কমপক্ষে পাঁচ লাখ, মাস ছয়েকের মধ্যে ১০ লাখ ব্যারেল তেল সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। তা ছাড়া দেশের বাইরে ইরানের যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ আটক করা হয়েছিল, ইরান এখন সেগুলো ধীরে ধীরে ফেরত পাবে।
প্রায় ১২ বছর ধরে আলোচনা প্রচেষ্টার—যাতে কখনো অগ্রগতি হয়েছে, কখনো এসেছে স্থবিরতা—পরিণতি এসেছিল গত বছরের মাঝামাঝি ভিয়েনায় চুক্তি স্বাক্ষর এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে। ‘যৌথ সার্বিক কর্মপরিকল্পনা’ নামের এই চুক্তির সবচেয়ে বড় দিক ছিল যে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনবে এবং এই প্রক্রিয়ার নজরদারি করবে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থা। ভবিষ্যতেও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর নজরদারির ব্যবস্থা থাকবে। এই চুক্তির আওতায় গত কয়েক মাসে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে এমনভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে, যাতে করে ইরানের পক্ষে পরমাণু অস্ত্র তৈরি আপাতত প্রায় অসম্ভব। স্মরণ করা যেতে পারে যে জাতিংঘের এই পারমাণবিক সংস্থাই ২০০৮ সালের মে মাসে এবং ২০১১ সালের নভেম্বরে প্রকাশ্যে ইরানের পারমাণবিক কার্যকলাপের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল।
এই চুক্তির আওতায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ এবং ইরানের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ হ্রাসের বিষয়ে পাঁচটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছিল। তার মধ্যে প্রথমটি ছিল ফাইনালাইজেশন ডে বা চূড়ান্তকরণ দিবস, যেদিন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ চুক্তি অনুমোদন করে, অর্থাৎ ২০ জুলাই। তার ৯০ দিন পরে ছিল অ্যাডাপশন ডে বা গ্রহণ দিবস, যেদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনসভাগুলোর এই প্রস্তাব গ্রহণের বাধ্যবাধকতা ছিল, দিনটি ছিল ১৮ অক্টোবর। তৃতীয় দিন ছিল ইমপ্লিমেন্টেশন ডে বা বাস্তবায়ন দিবস; বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার প্রতিবেদন যেখানে এ বিষয়ে ইরানের পক্ষ থেকে সব শর্ত পালন এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ সম্পন্ন করার ফল জানানো হবে, তারপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে। সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল না, কিন্তু বলা হয়েছিল, তা হতে হবে ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসে। এখন সেই পদক্ষেপ নেওয়া হলো। চতুর্থ পদক্ষেপ আসবে গ্রহণ দিবস থেকে আট বছর পরে, অর্থাৎ ২০২৩ সালে। একে বলা হয়েছে ট্রানজিশন ডে বা পরিবর্তন দিবস। যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, যদি আট বছরের আগে সম্পন্ন হয়, তবে এই দিন আগেও আসতে পারে। আর সব শেষে টার্মিনেশন ডে বা সমাপ্তিকরণ দিবস আসবে ২০২৫ সালে। এই দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনার তৃতীয়, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তরে সাফল্য অর্জন করা গেছে।
গত বছর চুক্তি করার সময় কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে ইরান তার প্রতিশ্রুতি পালনে আন্তরিক নয় এবং সে কারণে ইরান প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হবে। যাঁরা ইরানের সঙ্গে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর টানাপোড়েন বহাল রাখতে চান, তাঁরা চাইছিলেন যে ইরান ব্যর্থ হোক। অন্যপক্ষে যাঁরা পশ্চিমা দেশগুলোর আন্তরিকতা বিষয়ে সন্দিহান থাকেন এবং এ ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি, তাঁরা বলছিলেন যে পশ্চিমারা একটা অজুহাত খাড়া করে ইরানের ওপরে চড়াও হবে। এখন পর্যন্ত দুই পক্ষের এই লোকদের আশঙ্কা সত্য হয়নি। ইরান তার আন্তরিকতা প্রমাণ করেছে এবং পশ্চিমারা কথা ভঙ্গ করেনি। সেটা সম্ভব হয়েছে; কেননা, দুই পক্ষই জানে যে এই চুক্তি বাস্তবায়ন উভয়ের জন্যই লাভজনক। ইরানের সঙ্গে এই চুক্তির বিরোধীদের মধ্যে শক্তিশালী আঞ্চলিক দেশও ছিল এবং আছে। ইসরায়েল ও সৌদি আরব সুস্পষ্টভাবেই বলে এসেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের, বিশেষত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অত্যুৎসাহের কারণে চুক্তি হয়েছে এবং তা মোটেই ভালো হয়নি। এই অঞ্চলের আরও অনেক দেশ এই মতের সমর্থক। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রিপাবলিকান পার্টি এবং দল-নির্বিশেষে দক্ষিণপন্থীরা এর বিরুদ্ধে। এত কিছু সত্ত্বেও এতটা পথ যে অগ্রসর হওয়া গেছে, সেটা নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। এক অর্থে এটি কেবল ইরানের জন্যই একটা ঐতিহাসিক দিন তা নয়, এই চুক্তি ও অগ্রগতি প্রমাণ করে যে সংঘাত, সহিংসতা ও যুদ্ধের বাইরে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর করা সম্ভব, উভয় পক্ষের আন্তরিকতা থাকলে আলোচনার মাধ্যমে পথ বের করা যায়।
ইরানের অভ্যন্তরীণ শাসনকাঠামোর গণতন্ত্রহীনতা এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাববলয় বিস্তারের জন্য গৃহীত অনুসৃত নীতি ও কৌশল বিষয়ে জোর আপত্তি সত্ত্বেও এটা স্বীকার করতে হবে যে ইরানের রাজনীতিবিদেরা এই চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে এবং এ পর্যন্ত তা বাস্তবায়নের পথে প্রাজ্ঞতা দেখিয়েছেন। গত কয়েক বছরে দেশের অর্থনীতিতে সংকট, প্রবৃদ্ধি হ্রাস, বেকারত্ব বৃদ্ধি, সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া—এসব তাঁদের বিবেচনায় ছিল, সেটা আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু সেগুলোর বাইরেও আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাঁদের অবস্থান শক্তিশালী করা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির চেষ্টা যে কাজ করেছে, সেটা দুর্নিরীক্ষ্য নয়। ইরান ইতিমধ্যে তার আশপাশে একাধিক সংঘাতে জড়িয়ে আছে; সেই সময় নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকা, তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বহন করা ইরানের জন্য ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ইরানের নেতারা সেই দিকটি বিস্মৃত হননি।
অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলো যে কেবল অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি দেশের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র যাওয়ার পথ বন্ধ করার জন্যই এই চুক্তির বাস্তবায়নে আন্তরিক থেকেছে, তা নয়। আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইরানের শক্তি ও প্রভাব অস্বীকারের উপায় নেই। তার হাতে পারমাণবিক অস্ত্রের সম্ভাবনা যে পশ্চিমাদের মিত্র দেশ ইসরায়েল ও সৌদি আরবের স্বার্থের অনুকূলে নয়, সেটাও ইরানকে নিরস্ত্র করার একটা অন্যতম কারণ বলে আমরা ধরে নিতে পারি। অর্থনৈতিক বিবেচনা, বিশেষত বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও বেশি গতিশীলতা আনার জন্য ইরানে বিনিয়োগ ও ইরানের ভোক্তাদের কাছে পণ্য পৌঁছানো—দুই-ই দরকার। ইউরোপের অর্থনীতিকে চাঙা করে তুলতে দরকার স্বল্পমূল্যে তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করা। বিশ্ববাজারে স্বল্পমূল্যে তেল সরবরাহের তাগিদের একটা রাজনৈতিক দিকও আছে। এতে করে রাশিয়ার রপ্তানি করা তেলের দামও কমবে এবং তা রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। কিন্তু স্বল্পমূল্যে তেল সরবরাহ তেল কোম্পানিগুলোর জন্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য, সেটা আমরা আগামী কয়েক মাসে দেখতে পাব। এসব বিবেচনার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক অবস্থা, বিশেষত আঞ্চলিক সংঘাতগুলোর ফলে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেটা নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় যে ছিল এবং আছে, তা–ও অনুমেয়।
গত বছর পরমাণু শক্তি বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি ঘটছে। এখন আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার পক্ষ থেকে দেওয়া প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পারস্পরিক আস্থা বাড়বে বলে অনুমান করা যায়। এতে করে এ দুই দেশের পক্ষে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজের সুযোগ তৈরি হবে। অন্যদিকে এই ঘনিষ্ঠতার সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের আঞ্চলিক মিত্রদের দূরত্ব, এমনকি টানাপোড়েন তৈরি করবে বলে আশঙ্কা করা যায়।
গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। সেই পরিবর্তন কোনো সুস্পষ্ট রূপ নিয়েছে—এমন বলা যাবে না; পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলমান বলাই যথাযথ। আঞ্চলিক যুদ্ধগুলো সেই পরিবর্তনেরই প্রমাণ, আইএসের উত্থানও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গেই যুক্ত। এর সঙ্গে এই নতুন বাস্তবতা যুক্ত হলো। তার প্রতিক্রিয়া আমাদের সবার মনোযোগ দাবি করে; কেননা, এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া কোনোটাই কেবল ওই অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
থাম্বনেইল ছবির সূত্র: লিঙ্ক