হাইকোর্ট কর্তৃক রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন খারিজ করে দেওয়ায় যাঁরা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ, আমি তাঁদের আবেগাপ্লুত অবস্থান বুঝতে পারি, কিন্তু তাঁদের ভিন্ন ধরনের ফলের প্রত্যাশার যুক্তি উপলব্ধি করতে অপারগ। তাঁদের কারও কারও প্রতিক্রিয়া থেকে মনে হচ্ছে, হাইকোর্ট এমন কোনো রায় দিয়েছেন, যাতে করে বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। কিন্তু যা ঘটেছে তা হলো, স্থিতাবস্থা বহাল থেকেছে; কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। হাইকোর্ট রিট খারিজ করার আগের দিন বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্ক যা ছিল, এখনো তা-ই আছে; ২৮ বছর ধরে বিরাজমান স্থিতাবস্থা স্মরণ করিয়ে দেওয়া ছাড়া এই সিদ্ধান্তের আর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
যদিও এই রিট আবেদন করা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে এবং এ বিষয়ে হাইকোর্টের রুল জারি হয়েছিল ২০১১ সালে, এই বছরের (২০১৬) ৮ মার্চের আগে সুনির্দিষ্টভাবে এই রিট অনেকের কাছে ছিল অজ্ঞাত বিষয়। রিটের পক্ষের আইনজীবীদের অনুরোধেই বিষয়টি আবার সচল হয় এবং ২০১১ সালে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগের যে আদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা আদালত প্রত্যাহার করে নেন।এবং শেষ পর্যন্ত এই রিটের নিষ্পত্তি হয়।
১৯৮৮ সালে ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ যখন অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন, সে সময় যাঁরা রাজপথে দাঁড়িয়ে ‘যার ধর্ম তার কাছে, রাষ্ট্রের কী বলার আছে’—এই স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন, গ্রীষ্মকালের ছুটিতে ঢাকায় থাকার সুবাদে, তাঁদের সহযাত্রী হওয়ার, তাঁদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলানোর সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এ কথা বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই যে সেই সময়ে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নেতারা এর বিরোধিতা করেছিলেন। যে সংসদে এই বিলে সম্মতি দেওয়া হয়, সেই সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এই সংশোধনী বাতিল করবে।’ বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘সংবিধানের এই সংশোধনী জাতিকে বিভক্ত করবে, এই সংশোধনী গ্রহণযোগ্য নয়।’ অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য হচ্ছে এই যে জামায়াতে ইসলামীও এই বিলের বিরোধিতা করেছিল এবং একে ‘ভণ্ডামি’ বলে বর্ণনা করেছিল। এই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত ছিল না যে রাষ্ট্রধর্মের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মচর্চার কোনো যোগাযোগ নেই, এটি একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ।
রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের প্রথম সুযোগ আসে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদে। বাংলাদেশের ইতিহাসের বিরল ঘটনার সাক্ষী সেই সংসদ, যেখানে সরকার ও বিরোধী দল একত্রে সংবিধানের দুটি সংশোধনী বিল পাস করেছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ১৫টি সংশোধনীর মধ্যে একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীরা সম্মিলিতভাবে পাস করেছে। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন এবং কার্যত প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণের প্রশ্নে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ঐকমত্যের অভাব হয়নি; কিন্তু না ক্ষমতাসীন দল, না বিরোধী দল পাঁচ বছরে এই সংশোধনী বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছিল—সম্ভবত একেও একধরনের ঐকমত্য বলে বিবেচনা করা যায়। সপ্তম জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন দল ভিন্ন, কিন্তু এই বিষয়ে ভূমিকা ভিন্ন হয়নি। এরপর থেকে যে তিনটি সংসদ বহাল থেকেছে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতাই ছিল এবং আছে, তা নয়, দুই-তৃতীয়াংশ বা তার চেয়ে বেশি তাদের করতলে থেকেছে। ফলে এই নিয়ে অন্য দলের মুখাপেক্ষী না হয়েও চাইলে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ এই সংশোধনী বাতিল করতে পারত। একইভাবে ২০০৮ সাল থেকে যারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সঙ্গী এবং ক্ষমতার অংশীদার, সেসব দলের নেতারা এই নিয়ে সংসদে সামান্য বাক্যব্যয় করেছেন, প্রাইভেট মেম্বার বিল এনেছেন—এমন কথা শোনা যায়নি।
পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে ২০০৫ সালে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল যখন ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দেন, তখন সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছিল যে এতে করে ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনর্জীবিত হলো। এই বিষয়ে হাইকোর্টের মতামতও তা-ই ছিল। ফলে আমরা বলতেই পারি যে রাষ্ট্রধর্মসংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ২(ক) বাংলাদেশের সংবিধান থেকে তখন অপসৃত হয়। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম-বিষয়ক অনুচ্ছেদটি যুক্ত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম স্বীকৃত হয়েছে। যদিও এই ধারা সুস্পষ্টভাবেই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ৮ অনুচ্ছেদ, যেখানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বলা হয়েছে, ১২ অনুচ্ছেদ, যেখানে ‘রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান…বিলোপ’-এর কথা আছে, এবং অনুচ্ছেদ ২৮(১), যেখানে ধর্মনির্বিশেষে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না বলে অঙ্গীকার করা হচ্ছে, তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব বিধান যে ক্ষমতাসীনদের সুচিন্তিত বিবেচনার ফসল, এটা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি মনে রাখা দরকার, ক্ষমতাসীনেরা জেনে-বুঝেই রাষ্ট্রধর্ম পুনর্বহাল করেন এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধের বিষয়টি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনর্বহাল করেননি। এই ইতিহাসের অবতারণা এই কারণে যে আজকে যাঁরা রাষ্ট্রধর্ম-বিষয়ক রিট আবেদন বাতিলের কারণে ক্ষুব্ধ, তাঁরা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ে এ বিষয়ে কী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা নিজেরাই তা স্মরণ করতে পারবেন।
এই রিট আবেদন নাকচের আগে ও পরে যাঁরা রাষ্ট্রধর্ম রক্ষার কথা বলেছেন, তাঁদের একটি অন্যতম যুক্তি হচ্ছে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম, সেই হিসেবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলা সংগত। রাষ্ট্র একটি নিষ্প্রাণ সত্তা, তার আলাদা ধর্ম থাকতে পারার বিবেচনা যেকোনো ধর্মের মৌল বাণীর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, ইসলামের ক্ষেত্রেও তা সমপরিমাণে সত্য। ইসলাম ধর্ম সবার সমতায় বিশ্বাসী বলে যদি আপনি মনে করেন, তবে কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্র বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের এমন আইন বা নীতি আপনি সমর্থন করতে পারেন না, যা ওই সমতার ধারণার বিরুদ্ধে। ইসলাম ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের ইতিহাসের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট যে মুসলিম সমাজে রাষ্ট্রধর্ম বা তার তুলনীয় ব্যবস্থা ব্যতিক্রমী ঘটনা, সাধারণ সূত্র নয়। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা বা কানুন-উ-উসমানির ছিল তিনটি অংশ—শরিয়া, কানুন (যাতে সমাজে প্রচলিত আইন, যাকে বলা হতো অর্ফ) ও মিল্লেত। এগুলোর সংমিশ্রণে রাষ্ট্র পরিচালনা প্রমাণ করে যে বিশেষ একটি ধর্মের আধিপত্য অটোমান সাম্রাজ্যে ছিল না।
আবদুল্লাহি আহমেদ আন-নাইম তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ইসলাম অ্যান্ড দ্য সেক্যুলার স্টেট: নেগোশিয়েটিং দ্য ফিউচার অব শরিয়া গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে সেক্যুলার রাষ্ট্রের ধারণা কেবল ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, সেটি মুসলিম জনগোষ্ঠী ও ইসলামপন্থীদের জন্যই দরকার—এমনকি যখন তাঁরা সংখ্যাগুরু তখনো। যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে এই রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে সরব, তাঁদের এও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি ও জোরে একটি বিশেষ ধর্মকে সব নাগরিকের স্বতন্ত্র সমান অধিকারের ওপরে স্থাপন করার অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আপনার অন্যান্য অধিকার, এমনকি আপনার ব্যক্তিগত ধর্মচর্চার ওপরে হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা আপনি নিজেই তৈরি করছেন। নাগরিকের সমতার ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আপনি নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করতে পারেন না। নাগরিকের সমতার দৃষ্টিকোণ থেকে যাঁরা রাষ্ট্রধর্মের প্রশ্নকে বিবেচনা করতে চান এবং চান যে রাষ্ট্রধর্ম অপসৃত হোক, তাঁরা নিশ্চয় বুঝতে পারেন যে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে কেবল একটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে তাঁদের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জবাবদিহির সংস্কৃতির দাবি না তুলে এবং আইনের শাসনের প্রশ্নকে মোকাবিলা না করে নাগরিকের সমতার কথা বলার মধ্যে একধরনের নৈতিক অসারতা সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য। তার অর্থ কি এই যে ধর্মের ভিত্তিতে অসমতার এ ব্যবস্থা মেনে নিতে হবে? অবশ্যই নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্মের ভিত্তিতে বিরাজমান বৈষম্য দূর করার প্রচেষ্টা একটি রাজনৈতিক সংগ্রাম। সেখানে একদিকে মদিনা সনদের আলোকে দেশ পরিচালনার প্রতিশ্রুতি, নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে ইসলাম বা যেকোনো ধর্মকে ব্যবহার করার অঙ্গীকার, শিক্ষার পূর্ণতার আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে ধর্মকে বিবেচনার প্রশ্নকে এড়িয়ে কেবল রাষ্ট্রধর্ম থাকা না-থাকাকে বিবেচনা করা যাবে না। ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের এসব দিক নিয়ে প্রশ্ন না তুলে, তার বিরুদ্ধে আদর্শিক সংগ্রাম পরিচালনা না করে, আদালতের কাছ থেকে সমাধান আশা করা একধরনের অদূরদর্শিতা বলেই আমার ধারণা।
আদর্শের সংগ্রামকে আদালতের কাঠগড়ায় তুলে দেওয়ার মধ্যে রাজনৈতিক সুবিধা রয়েছে, কিন্তু এর বেশি কিছু নেই। সেই রাজনৈতিক সুবিধা লাভের চেষ্টার চেয়ে আরও বেশি জরুরি হচ্ছে রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্ক বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে সমতার ভিত্তিতে নির্ভয়ে সবার অংশগ্রহণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত থাকবে।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ৩১ মার্চ ২০১৬