November 23, 2024

একজন মানুষের জঙ্গি হয়ে ওঠার কারণ ও প্রক্রিয়া নিয়ে বিশ্বব্যাপী নানা গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে। এর রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক যেমন রয়েছে, তেমনি ব্যক্তির মনোজাগতিক অবস্থাও বিবেচ্য। তরুণদের জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হওয়ার এই বৈশ্বিক সমস্যা বাংলাদেশেও গুরুতর আকার ধারণ করেছে। বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের তরুণদের জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হওয়া বা র‍্যাডিক্যালাইজেশনের প্রক্রিয়া নিয়ে আমার লেখা চার পর্বের বিশ্লেষণী প্রবন্ধ প্রথম আলো পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। কথকতার পাঠকদের জন্য চার পর্বের লেখা একত্রে প্রকাশ করা হলো।

১। কেউ রাতারাতি জঙ্গি হয়ে ওঠে না

কেন একজন ব্যক্তি জঙ্গি হয়ে ওঠে? কোনো ব্যক্তির জঙ্গি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি কী? যখনই জঙ্গি তৎপরতার খবর পাওয়া যায়, যখনই কোনো জঙ্গি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়, তখনই সাধারণ মানুষের মনে এসব প্রশ্ন জাগে। তাঁরা বুঝতে চান ঠিক কীভাবে একজন ব্যক্তি জঙ্গি হয়ে উঠেছে। তার পেছনে কী ধরনের ঘটনা বা প্রবণতা কাজ করেছে। নীতিনির্ধারক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সন্ত্রাসবাদ দমনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা তো অবশ্যই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরাও এ বিষয়ে কমবেশি সব সময়ই চিন্তাভাবনা করেন। তাঁরা সবাই এর একটা সন্তোষজনক উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করেন। বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনের উপস্থিতি দীর্ঘদিন হলেও পদ্ধতিগতভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে, এমন উদাহরণ সহজে দেখা যায় না।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদবিষয়ক আলোচনা ও গবেষণা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বর্ণনামূলক বা এ বিষয়ে জনসাধারণের মনোভাববিষয়ক জরিপভিত্তিক। কিন্তু গত এক মাসে সবাই কোনো না কোনোভাবে এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন, সেটা একান্ত চিন্তায় কিংবা অন্যদের সঙ্গে আলোচনায়। জঙ্গি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার প্রশ্নটি এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণ আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। বাংলাদেশের সমাজে জঙ্গিদের বিষয়ে যেমন একটি পূর্বধারণা ছিল, তেমনি এই জঙ্গি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া নিয়েও একটা পূর্বধারণা আসন গেঁড়ে বসেছিল। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে আমরা যা জানতে পেরেছি তার সঙ্গে এই ধারণার অসংগতিই এখন এ বিষয়ে উৎসাহ তৈরির একটি অন্যতম কারণ। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে এসব বিষয়ে উৎসাহ তৈরি হয়েছে এবং আমরা এ রকম একটি অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি—এটা মেনে নেওয়া সত্ত্বেও এটাকে একার্থে ইতিবাচক বলেই বিবেচনা করা যায়। দেশে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা, এর বিস্তার রোধ এবং ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করা জরুরি।

জঙ্গি হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতে আমাদের কয়েকটা বিষয় মনে রাখতে হবে। প্রথমত, এটি একটি প্রক্রিয়া; অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি অকস্মাৎ জঙ্গি হয়ে ওঠে না। দ্বিতীয়ত, এটি একটি প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়; অর্থাৎ এই পর্যায়ে যাওয়ার অনেক আগেই এর সূচনা হয় এবং বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে ওই ব্যক্তিকে যেতে হয়। তৃতীয়ত, এই প্রক্রিয়া একরৈখিক নয়; অর্থাৎ একবার এই প্রক্রিয়ার অংশীদার হলে সেখান থেকে ফেরার পথ নেই বা যে প্রক্রিয়া জঙ্গি তৈরি করে, সেই পথের সব অংশগ্রহণকারীই যে শেষ পর্যন্ত জঙ্গি হবেন তা পূর্বনির্ধারিত নয়। এই প্রক্রিয়াকে আমরা বলতে পারি র‍্যডিকালাইজেশন।

র্যাডিকালাইজেশন হচ্ছে এমন এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি এমন ধরনের আদর্শ ও বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচিত হন যা তাঁকে মধ্যপন্থী, মূলধারার চিন্তাধারা থেকে চরমপন্থী চিন্তার দিকে সরে যেতে সাহায্য করে। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে র্যাডিকালাইজেশনের ধারণার দুটো দিক আছে। একটি হচ্ছে সহিংস র‍্যডিকালাইজেশনের পথ; যে ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য সহিংসতাকে কেবল যৌক্তিক বলে বিবেচনা করা হয় না, সহিংসতাকেই প্রধান এবং একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নিয়ে সেভাবেই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এই পথ অবশ্যই গণতান্ত্রিক রাজনীতি এবং নাগরিকের নিরাপত্তার জন্য প্রত্যক্ষ হুমকি।

অন্যটি বৃহত্তর অর্থে র‍্যডিকালাইজেশন; সমাজ ও রাজনীতিতে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন এবং তাতে অংশগ্রহণ করা। এ ধরনের র্যাডিকালাইজেশন সমাজে দীর্ঘ মেয়াদে প্রচলিত গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হলেও তা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি নয় এবং এই প্রবণতাকে সহিংস র্যাডিকালাইজেশনের সঙ্গে এক কাতারে বিবেচনা করা সঠিক নয়। ফলে এটা মনে রাখতে হবে যে র্যা ডিকাল মানুষ মাত্রই জঙ্গি নন। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা র্যা ডিকালাইজেশন বলতে সহিংস র্যা ডিকালিজমকেই বোঝাব। সহিংস র্যাডিকাল পথের সবাই যে ব্যক্তি হিসেবে সহিংসতার পথ বেছে নিয়ে জঙ্গি হবেনই, এমনও বলা যায় না।

সহিংস র‍্যডিকালাইজেশন বিষয়ে গত কয়েক দশকে সারা পৃথিবীতে, বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোতে, ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। যদিও র্যা ডিকালাইজেশনের প্রশ্নটি নতুন নয়, তথাপি এ বিষয়ে ২০০১ সালের পরে গবেষণার সংখ্যা বেড়েছে এবং দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। সহিংস উগ্রপন্থা বা ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম নিঃসন্দেহে এককভাবে কোনো অঞ্চলের বা বিশেষ কোনো ধর্মের ক্ষেত্রে সীমিত নয়। এ বিষয়ে আলোচনা ও গবেষণার সূত্রপাত হয়েছিল গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এবং তা ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রশ্নকে ঘিরে তৈরি হয়নি (দেখুন আমার লেখা, ‘কোন পরিস্থিতি জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটায়’, প্রথম আলো ৭ অক্টোবর, ২০১৫)। কিন্তু ২০০১ সালের পরে এসব আলোচনা ও গবেষণায় যেটা প্রাধান্য পেয়েছে তা হচ্ছে ইসলামপন্থী উগ্র সহিংস সংগঠনগুলোর উত্থান এবং বিস্তার, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর প্রতি আকর্ষণের বিষয়। এদিকটি আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ২০১৪ সালে আইএসের নাটকীয় উত্থান এবং বিভিন্ন দেশ থেকে তরুণ-তরুণীদের আইএসে যোগ দেওয়ার পরে। শুধু তা-ই নয়, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে অন্যান্য দেশেও সমাজের ভেতরে র্যাডিকালাইজেশনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এযাবৎ র‍্যডিকালাইজেশন-বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যনির্ভর আলোচনাগুলোতে মোটা দাগে দুটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। একটি হচ্ছে র্যাডিকালাইজেশনের কারণ এবং অন্যটি র্যা ডিকালাইজেশনের প্রক্রিয়া। এই দুইয়ের মধ্যে যে একটি গভীর সম্পর্ক আছে সেটা অনস্বীকার্য। দুই ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই যে গবেষকেরা চেষ্টা করছেন কতকগুলো সাধারণ প্রবণতা বা স্তর চিহ্নিত করতে। কারণ হিসেবে প্রবণতাগুলোকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোর সাহায্য নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে উগ্র সহিংস পন্থা, জঙ্গিবাদ, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী তৎপরতা ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দেশ বা সংগঠনভিত্তিক যেসব কেস স্টাডি হয়েছে তার সারসংকলন করেই এসব সাধারণ প্রবণতার তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। র‍্যডিকালাইজেশন প্রক্রিয়া-বিষয়ক বেশির ভাগ কেস স্টাডি পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর, বিশেষত তরুণদের, র্যাডিকালাইজেশনের পথ বোঝার আগ্রহ থেকেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে ক্রমান্বয়ে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করা হয়েছে।
এই পটভূমিকায় সহিংস র্যা ডিকালাইজেশনের কারণ এবং সহিংস র্যাডিকালাইজেশনের প্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করতে চাইলে কেবল বর্ণনামূলক প্রতিবেদনের দিকে মনোনিবেশ করলে হবে না। আমাদের আলোচনা শুরু করতে হবে এই প্রপঞ্চের সাধারণ প্রবণতাগুলো নিয়ে; তার সঙ্গে বিরাজমান ঘটনাপ্রবাহের মিল-অমিলগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে।

২। যেসব কারণে কেউ জঙ্গি হয়

কোনো ব্যক্তির জঙ্গি হয়ে ওঠার ঘটনা যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়, সেই প্রক্রিয়াকে র‍্যাডিক্যালাইজেশন বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়ার কারণ কী, সে বিষয়ে গত কয়েক দশকে পরিচালিত গবেষণার আলোকে যে তত্ত্বগুলো গড়ে উঠেছে, তাকে আমরা মোটা দাগে দুই ভাগ করতে পারি। প্রথমত, যেগুলো সমাজে বিরাজমান কতিপয় অবস্থা ও প্রবণতাকে প্রধান বলে মনে করে; দ্বিতীয়ত, যেগুলো রাজনীতিকেই প্রধান উপাদান বলে মনে করে। যাঁরা মনে করেন যে সামাজিক দিকটি প্রধান, তাঁদের মতে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগতভাবে বা গোষ্ঠীগতভাবে রিলেটিভ ডিপ্রাইভেশন বা আপেক্ষিক বঞ্চনার অভিজ্ঞতা বা বোধ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ বা উপাদান। আপেক্ষিক বঞ্চনা হচ্ছে যখন একজন ব্যক্তি নিজের জীবনে বা তাঁর চারপাশের সমাজে এমনকি বৈশ্বিকভাবে যে সমাজের অংশ বলে নিজেকে মনে করেন, তার প্রতি অসম আচরণ দেখতে পান। তিনি যখন অন্যদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করেন এবং দেখতে পান যে অন্যরা তুলনামূলকভাবে ভালো আছেন, তখন তাঁর ভেতরে একধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

এই ভালো থাকাটা হতে পারে বৈষয়িক, হতে পারে সাংস্কৃতিক, হতে পারে সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে। সমাজে এসব বিষয়ে পার্থক্য থাকাটাই যথেষ্ট নয়। কেননা, যেকোনো যুক্তিসম্পন্ন মানুষই জানেন যে পার্থক্য থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই পার্থক্যকে যখন অন্যায় ও অন্যায্য বলে মনে হয়, তখনই এই পার্থক্যের বিষয়টি মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এই আপেক্ষিক বঞ্চনার বোধ তৈরি হয় যখন একজন ব্যক্তি দেখেন যে অতীতে যেসব অধিকার তিনি ভোগ করে এসেছেন তা সীমিত হচ্ছে বা অন্যরা এখন তাঁর চেয়ে বেশি অধিকার ভোগ করছেন। ইউরোপের মুসলিম সমাজের মধ্যে, এমনকি দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের ভেতরেও, এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা গেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সমাজে একীভূত হওয়ার বা ইন্টিগ্রেশনের অভাব। তাঁরা মনে করেন যে সমাজকাঠামো ও বিরাজমান ব্যবস্থা তাঁকে ও তাঁর সম্প্রদায়কে আলাদা করে রাখছে এবং বঞ্চিত করছে। বাস্তবে বিরাজমান পরিস্থিতিই তাঁদের এই ধারণার জন্ম দেয়।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, ইউরোপের বাইরে এই তত্ত্বের কার্যকারিতা আছে কি না। ইউরোপের অভিজ্ঞতার আলোকে ‘একীভূত’ করার প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দিলে আমরা তার প্রত্যক্ষ কার্যকারিতা দেখতে পাব না, বিশেষত যেখানে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যেই র‍্যাডিক্যালাইজেশনের কারণ আমরা বুঝতে চেষ্টা করছি। কিন্তু মনে রাখা দরকার, যেকোনো সমাজে যখন একজন ব্যক্তি, যদি নিজেও এই সুবিধাভোগী হন, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারেন যে সমাজের একাংশের ওপরে অন্যায্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাঁর এই সুবিধা বহাল থাকছে, তখন তাঁর মধ্যেও আপেক্ষিক বঞ্চনার ধারণা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তরুণদের একটা বড় অংশ যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও জঙ্গি হয়ে উঠেছে, তার একটা কারণ এই আপেক্ষিক বঞ্চনা বলে আমার ধারণা। এ ক্ষেত্রে ‘বঞ্চনা’কে কেবল যাঁরা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, তাঁদের অবস্থান থেকে দেখলে বোঝা যাবে না। কোনো ব্যক্তি তাঁর চারপাশে বিরাজমান ব্যবস্থাকে অন্যায্য মনে করছেন কি না, সেটা বিবেচনায় নেওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে একটি অন্যতম দিক হচ্ছে তাঁর আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন। অর্থাৎ, ব্যক্তি হিসেবে তিনি নিজেকে কোনো পরিচয়ের অংশীদার ভাবছেন; তিনি এই সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবছেন কি না। বিচ্ছিন্নতাবোধের গভীরতা, বৈষম্যবোধের তীব্রতা এবং সে বিষয়ে ক্ষোভের মাত্রা র‍্যাডিক্যালাইজেশনের সম্ভাবনা তৈরি করে। এখানে সম্ভাবনা কথাটি আমাদের বিশেষভাবে নজরে রাখতে হবে। কেননা, এখনো এটা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত নয় যে এই বোধই র‍্যাডিক্যালাইজেশনের জন্য যথেষ্ট।

ইউরোপে তরুণদের র‍্যাডিক্যালাইজেশনের জন্য রাজনৈতিক কারণের দিকে যাঁরা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন, তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে অসন্তোষ ও ক্ষোভ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা একে সামাজিক-মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলেও চিহ্নিত করতে পারি; যার অর্থ হচ্ছে, নৈরাশ্য থেকে সৃষ্ট আগ্রাসী মনোভঙ্গি বা অপমানবোধ থেকে প্রতিহিংসাপরায়ণতা হচ্ছে র‍্যাডিক্যালাইজেশনের কারণ। এই বিবেচনায় পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতি একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ইউরোপের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই ধারণা প্রবল যে মধ্যপ্রাচ্যে বা অন্যত্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপরে নির্যাতন আসলে তাঁদের ওপরই নির্যাতনের একটি রূপ। এর সপক্ষে ইউরোপ, বিশেষত ব্রিটেনে পরিচালিত জরিপে যথেষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু এটাকে কেবল ইউরোপের বিষয় বলে ভাবার সুযোগ নেই। বিভিন্ন দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এ ধারণা প্রবল।

এ কথা অনস্বীকার্য যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতি, জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারের ‘ওয়ার অন টেরর’ এবং গত দেড় দশকের বিভিন্ন যুদ্ধ প্রমাণ করে যে পশ্চিমা দেশগুলো একধরনের দুমুখো নীতি বা ডবল স্ট্যান্ডার্ড প্রয়োগ করে এসেছে এবং অন্যায়ভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এই ক্ষোভ যে কেবল পশ্চিমা দেশের বিরুদ্ধেই প্রযুক্ত, তা নয়। যখন সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার ওই ধরনের নীতির সমর্থক হয় কিংবা ওই ধরনের নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ সীমিত হয়ে আসে কিংবা মনে হয় যে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা এ ধরনের শক্তি দ্বারা সমর্থিত কিংবা সমাজে এ বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিবাদ তৈরি হচ্ছে না, তখন তা–ও সমাজের একাংশের ভেতরে উগ্রপন্থার প্রতি আকর্ষণ তৈরি করে। পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেওয়া বা সেই লক্ষ্যে নিজ অবস্থান থেকেই সেই যুদ্ধে শরিক হওয়াকে তাঁরা সঠিক বিবেচনা করে থাকেন। সমাজে র‍্যাডিক্যালাইজেশনের জন্য এগুলো ইতিবাচক উপাদান বলেই বিবেচনা করা উচিত। এ ধরনের মনোভাব কেবল দূরের ঘটনাপ্রবাহের জন্যই কার্যকর থাকে তা নয়, বরং আঞ্চলিক ঘটনাপ্রবাহও কোনো ব্যক্তিকে প্রভাবিত করে। কাশ্মীরের ঘটনা প্রবাহকে এভাবে বিবেচনা করার দৃষ্টিভঙ্গি মোটেই বিরল নয়। রাজনৈতিক অসন্তোষ ও ক্ষোভ নিজ দেশের ভেতরে বিরাজমান রাজনীতি থেকেও উদ্ভূত হয়। নাগরিকের অধিকার সীমিত হয়ে এলে ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশের পথ হিসেবে উগ্রপন্থা অবলম্বনের উদাহরণ মোটেই নতুন ঘটনা নয়।

অসন্তোষ ও ক্ষোভ থাকলেই তা সহিংস ইসলামপন্থী র‍্যাডিক্যালাইজেশনের পরিণতি লাভ করবে এমন নয়, এ ধরনের মনোভাবের কারণে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের রাজনীতিতে (যেমন উগ্র বামপন্থী বা অহিংস ইসলামপন্থী) যোগদানের উদাহরণও রয়েছে। যেখানে মূলধারার রাজনীতির মধ্যেই এই ক্ষোভ প্রকাশের উপায় আছে, সেখানে সেই পথ গ্রহণই স্বাভাবিক। কিন্তু তার অনুপস্থিতি ভিন্ন অবস্থার সুযোগ তৈরি করে।

সাধারণত কোনো ব্যক্তিকে সহিংসতার পথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রথমত, ব্যক্তিজীবনের কোনো সংকট বা ঘটনা যা অনুঘটক (বা ক্যাটালিস্ট) হিসেবে কাজ করে। এই সংকট বা ঘটনা যে ওই ব্যক্তির নিজের জীবনেই ঘটতে হবে তা নয়, তাঁর পরিবারে, অন্যের জীবনে বা সমাজে সংঘটিত কোনো ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করাও অনুঘটকের কাজ করতে পারে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে সামাজিক নেটওয়ার্ক।

মার্ক সেইজম্যানের ২০০৪ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ আন্ডারস্ট্যান্ডিং টেরর নেটওয়ার্কস, ব্রিটেনের আল-মুহাজেরুন বিষয়ে কুইনটন উকটরোউইজের ২০০৫ গবেষণাগ্রন্থ র‍্যাডিক্যাল ইসলাম রাইজিং মুসলিম এক্সট্রিমিজম ইন দ্য ওয়েস্ট এবং পল গিলের ২০০৮ সালে প্রকাশিত গবেষণা ‘সুইসাইড বোম্বার প্যাথওয়েজ অ্যামাং ইসলামিক মিলিট্যান্টস’সহ অনেক গবেষণায়ই দেখা যাচ্ছে যে সহিংস র‍্যাডিক্যালাইজেশনের ক্ষেত্রে, বিশেষত একজন ব্যক্তির সহিংসতায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে গ্রুপ বা গোষ্ঠী, সামাজিক সম্পর্ক, যোগাযোগ ও বন্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব গবেষণায় স্পষ্ট যে র‍্যাডিক্যালাইজেশন যেমন ঘটে সুসংগঠিত সন্ত্রাসী সংগঠনের পক্ষ থেকে সদস্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে, তেমনি ঘটে বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের স্বপ্রণোদিত গোষ্ঠী তৈরির মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ঘটনার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।

বাংলাদেশে গত কয়েক সপ্তাহে নিহত ও নিখোঁজ জঙ্গিদের মধ্যে সম্পর্কের যেসব তথ্য আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার মধ্যেও এই নেটওয়ার্কের ইঙ্গিত রয়েছে। তাঁরা নিজেরাই পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত বলে বা পরিচিত হয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সংগঠিত হয়েছিলেন, নাকি আইসিসের মতো জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হওয়ার পরে তাঁদের মধ্যে গোষ্ঠীগত সামাজিকীকরণ, গোষ্ঠীগত বন্ধন তৈরি হয়েছিল, সেটা এখন আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা দরকার। পূর্বপরিচিত বন্ধুগোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের র‍্যাডিক্যালাইজেশনের ঘটনা আমরা অন্যত্রও লক্ষ করেছি।

ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যে ছয়জন তরুণ সিরিয়ায় আইসিসের পক্ষে যোগদান করেন, তাঁরা পোর্টসমাউথ শহরে একত্রেই জীবন যাপন করতেন। সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে ‘আল-ব্রিটানি ব্রিগেড বাংলাদেশি ব্যাড বয়েজ’ নামে যাঁরা পরিচিত হয়েছিলেন, তাঁরা ব্রিটেনে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বা ধর্মচর্চার জন্য পরিচিত ছিলেন না। মাসুদ চৌধুরী (৩১), মুহাম্মদ মেহেদি হাসান (১৯), মামুনুর মুহাম্মদ রশিদ (২৪), মুহাম্মদ হামিদুর রহমান (২৫), আসাদুজ্জামান (২৫) ২০১৩ সালের অক্টোবরে একত্রে তাঁদেরই আরেক বন্ধু ইফতেখার জামানের অনুপ্রেরণায় সিরিয়ায় যুদ্ধে শরিক হওয়ার জন্য ব্রিটেন ত্যাগ করেন। এঁদের মধ্যে দুই সন্তানের জনক মাসুদ চৌধুরী দেশে ফিরে এলে আটক হয়ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে চার বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। বাকিরা সিরিয়ায় প্রাণ হারিয়েছেন। এঁদের মধ্যে ইফতেখার জামান ও আসাদুজ্জামান আত্মীয়, কিন্তু তাঁরা সবাই বন্ধু। কোনো গ্রুপের ক্ষেত্রেই বন্ধু বা সহমর্মীদের চাপ একই ধরনের আচরণে উৎসাহী করে থাকে। কেননা, এর ব্যত্যয় ঘটলে একজন গোষ্ঠীচ্যুত হতে পারেন।

পরিবার থেকেও যে এ ধরনের প্রণোদনা তৈরি হয়, তার উদাহরণও রয়েছে। যেমন ব্রিটেনের লুটন শহরের বাসিন্দা বাংলাদেশি মুহাম্মদ আবদুল মান্নান তাঁর পরিবারের ১১ জন সদস্য নিয়ে ২০১৫ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশে আসেন এবং ফেরার পথে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় আইসিসের কথিত ইসলামিক স্টেটে চলে যান। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে নিখোঁজ রোকনউদ্দিন খন্দকার, নাইমা আখতারসহ তাঁর পরিবারের আরও তিন সদস্য সিরিয়ায় গেছেন বলে যে অনুমান, তা–ও এই একই ধারণা দেয় যে র‍্যাডিক্যালাইজেশন পরিবারের মধ্যেও ঘটে।

যেভাবেই ঘটুক না কেন, র‍্যাডিক্যালাইজেশন একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া; যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটার জন্য দরকার কিছু উপাদান।

৩। শুধু ধর্মের মধ্যে সমস্যা খোঁজা নয়

র‌্যাডিকালাইজেশন একটি রাজনৈতিক বিষয়। এটি কেবল ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতেই আছে, এমন মনে করার কারণ নেই। গত এক শ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে বিভিন্ন আদর্শভিত্তিক র‌্যাডিকালাইজেশনের ধারা ও প্রবণতা সহজেই চোখে পড়ে। যদিও এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ইসলামপন্থী রাজনীতির একটি ধারাই র‌্যাডিকালাইজেশনের প্রধান পথ হয়ে উঠেছে এবং উগ্র ইসলামপন্থীরা একে ধর্মীয় বাতাবরণে ঢেকে প্রচার করছে, তথাপি একে ইসলাম ধর্মের প্রকাশ মনে করলে বা এর উৎস ইসলাম ধর্মের মধ্যে অনুসন্ধানের চেষ্টা করলে তা উগ্রপন্থীদের যুক্তিকেই বৈধতা প্রদান করবে।

প্রকৃতপক্ষে সাধারণভাবে ইসলামপন্থী রাজনীতি ইসলাম ধর্মের একটি ব্যাখ্যা হাজির করে এবং তাকে রাজনৈতিক আদর্শে পরিণত করে। ‘ইসলামপন্থী’ বলার ক্ষেত্রে এটাও আমাদের মনে রাখা দরকার যে ইসলামপন্থী রাজনীতি কোনো একক ধারা নয়, এই রাজনীতির মধ্যে বিভিন্ন ধারা থাকে। এটা পৃথিবীর অন্যত্র যেমন সত্য, তেমনি সত্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। খুব সহজ করে দেখলে দেখা যাবে যে ইসলামপন্থী রাজনীতির বিভিন্ন ধারার মধ্যে এই বিষয়েও মতৈক্য নেই যে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে (বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির বিভিন্ন ধারাবিষয়ক আলোচনার জন্য দেখুন আমার গ্রন্থ হাউ ডিড উই এরাইভ হেয়ার?’ প্রথমা, ২০১৫, পৃষ্ঠা ৫১-৬৪)। ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের বিবেচনায় যেমন তেমনি বিশ্বাসের কতিপয় দিক থেকেও ইসলাম ধর্মের ভেতরে রয়েছে বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য কেবল শিয়া-সুন্নির পার্থক্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিভিন্ন ধরনের মাজহাব এবং মাসলাকের উপস্থিতি, হাদিসের বিভিন্ন ব্যাখ্যা, ইসলামি আইনের বিভিন্ন ব্যাখ্যা এই পার্থক্যের ও বৈচিত্র্যের সাক্ষ্য দেয়।

ইসলামের ইতিহাসে ধর্মতত্ত্ব এবং এ ধরনের ব্যাখ্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কের উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু উগ্র ইসলামপন্থীরা ধর্মীয় টেক্সটগুলোর সেই অংশকেই তাদের প্রচারণায় তুলে ধরে, যেগুলোকে তারা তাদের রাজনৈতিক আদর্শের এবং লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করে। যে কারণে ইসলামপন্থীদের কাছে তাদের রাজনীতিক দীক্ষাগুরু যেমন ইবনে তাইমিয়া, আবদুল ওয়াহাব, আবুল আলা মওদুদী, সাইয়েদ কুতুব, হাসান আল বান্না, আবদুল্লাহ ইউসুফ আজ্জম বা রুহুল্লাহ খোমেনির ব্যাখ্যাকেই গ্রহণযোগ্য মনে হয় এবং এই বিষয়ে বিতর্ককে তারা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে থামিয়ে দিতে চায়। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে ধর্মীয় গ্রন্থগুলো থেকে সহিংসতার বা উগ্রপন্থার ধারণা গ্রহণ অসম্ভব। এটি কেবল যে ইসলামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা-ও নয়। অন্যান্য ধর্ম যেমন খ্রিষ্টধর্ম বা ইহুদি ধর্মের ক্ষেত্রেও ধর্মগ্রন্থ বা তার ব্যাখ্যা থেকে একধরনের সহিংসতার ধারণা আহরণ করা যেতে পারে। কিন্তু তার পাশাপাশি সব ধর্মের মধ্যেই আবার সহনশীলতা ও সহানুভূতি বা সমবেদনার কথাও বলা হয়েছে। ফলে ধর্মের একক কোনো ব্যাখ্যাকেই চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করা ভুল হবে।

এ ধরনের আলোচনা অবশ্য ধর্মের সঙ্গে উগ্রপন্থার সম্পর্কের বিষয়টি একেবারে নিষ্পত্তি করে না। কেননা ব্রিটেনে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পরিচালিত জরিপে দেখা যায় যে যাঁরা মুসলিম পরিচয়কে প্রাধান্য দেন, তাঁদের মধ্যে সহিংসতা, আত্মঘাতী হামলা এবং ৯/১১-এর হামলার প্রতি সহানুভূতি বা সমর্থনের ঝোঁক আছে। এই প্রবণতা বাংলাদেশের জনসাধারণের একাংশের মধ্যেও আছে। ২০১১-১২ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টারের করা জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ২৬ শতাংশ মানুষ আত্মঘাতী বোমা হামলার সমর্থক। কিন্তু এসব সত্ত্বেও এমন কোনো গবেষণার ফল আমাদের হাতে নেই, যা থেকে বলা যেতে পারে যে ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশ্বাসগত আনুগত্যের কারণেই র‌্যাডিকালিজম তৈরি হয়। উপরন্তু আমরা ২০০৫ সালে প্রকাশিত মার্ক গৌল্ডের রচনার এই উপসংহারের সঙ্গে একমত হতে পারি যে ইসলামের প্রতি ধর্মীয় কমিটমেন্ট সহিংস র‌্যাডিকালাইজেশনের নির্ধারক উপাদান নয়, তার জন্য দরকার অন্যান্য বিষয়।

সেই অন্য উপাদানগুলোকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি: পারিপার্শ্বিক অবস্থাজনিত উপাদান, কৌশলগত উপাদান ও আদর্শিক উপাদান। এই বিভাজনের কাঠামো বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মার্থা ক্রেনশর ১৯৮১ সালে কম্পারেটিভ পলিটিকস জার্নালে সন্ত্রাসবাদ-সংক্রান্ত রচনা এবং এ বিষয়ে গবেষক ম্যাথুইউ ফ্রান্সিসের ২০১২ সালের আলোচনার আলোকে তৈরি। ক্রেনশ এবং ফ্রান্সিসের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে এই উপাদানগুলোর মধ্যে আবার উপবিভাগ রয়েছে। যেমন পারিপার্শ্বিক অবস্থাজনিত উপাদানের কিছু হচ্ছে পূর্বশর্ত আর কিছু এ ধরনের প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করে। কৌশলগত উপাদানকে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি হিসেবে ভাগ করা যায়। তৃতীয় উপাদান হচ্ছে আদর্শিক, যেগুলো হচ্ছে অপরিবর্তনীয়। আমরা যেহেতু ইসলামপন্থী র‌্যাডিকালাইজেশনের প্রতি মনোনিবেশ করেছি, সেহেতু আমি উদাহরণ হিসেবে তার কয়েকটি উল্লেখ করেছি, কিন্তু যেকোনো ধরনের র‌্যাডিকালাইজেশনের ক্ষেত্রেই যেসব উপাদান কাজ করে, সেগুলো তুলে ধরাই হচ্ছে আমার লক্ষ্য।

3

এই উপাদানগুলোর মধ্যে অনুকূল পরিবেশ হচ্ছে যেকোনো সমাজে র‌্যাডিকালাইজেশনের অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত। আমরা যদি অনুপ্রেরণামূলক অবস্থাকে অনুঘটক বলে বিবেচনা করি তবে র‌্যাডিকালাইজেশনের ট্রিগার বা সূচনাকারী বলে চিহ্নিত করতে হবে ত্বরান্বিতকরণের উপাদানগুলোকে। কিন্তু এগুলো তখনই ট্রিগারের কাজ করতে পারে, যখন পূর্বশর্তসমূহ পূরণ হয়েছে। ফলে র‌্যাডিকালাইজেশনের পথ বন্ধ করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে পারিপার্শ্বিক অবস্থাজনিত উপাদানগুলোকে মোকাবিলা করা। সেটা না করা গেলে ব্যক্তির সহিংস র‌্যাডিকালাইজেশনের পথ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। অন্যভাবে বললে তখন শুরু হয় ব্যক্তির র‌্যাডিকালাইজেশনের প্রক্রিয়া।

৪। জঙ্গি হয়ে ওঠার পর্যায় ও পটভূমি

একজন মানুষ কীভাবে জঙ্গি হয়ে ওঠে? কী প্রক্রিয়া তাকে জঙ্গিতে পরিণত করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গত কয়েক দশকে, বিশেষত গত দেড় দশকে, বিস্তর গবেষণা হয়েছে; অনেকগুলো মডেল প্রস্তাবিত ও আলোচিত হয়েছে। এসব মডেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে চারটি—ড্যানিশ গোয়েন্দা সংস্থার প্রস্তাবিত মডেল (পিইটি মডেল), নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের জন্য মিচেল ডি সিলবার ও অরবিন্দ ভাটের তৈরি করা মডেল (এনওয়াইপিডি মডেল), মার্ক সেইজম্যানের মডেল (‘একগুচ্ছ লোক’ মডেল) ও মনোবিজ্ঞানী ফাতালি মোঘাদ্দামের প্রস্তাবিত মডেল (স্টেয়ারকেস মডেল)। এর বাইরেও অনেক মডেল আছে, যা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং অবস্থা বোঝার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। আবার এসব মডেল বিষয়ে সমালোচনাও রয়েছে। এসব মডেলের আলোচনায় যেটা বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে তা হলো, কোনো ব্যক্তির জঙ্গি হয়ে ওঠা মানে হচ্ছে র‍্যাডিক্যালাইজেশন প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হওয়া, কিন্তু এই প্রক্রিয়ার সূচনায় থাকার অর্থ এই নয় যে, ওই ব্যক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবেই; বরং উল্টোটাই ঘটে—প্রতিটি স্তর থেকেই কিছু মানুষ ঝরে যায়।

পিইটি মডেলে র‍্যাডিক্যালাইজেশনকে চার স্তরে ভাগ করা হয়েছে। এর প্রথম স্তরে রয়েছে র‍্যাডিক্যাল চিন্তা গ্রহণে উৎসাহী একজনের সঙ্গে এমন কোনো ব্যক্তির যোগাযোগ ঘটে, যে র‍্যাডিক্যাল পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক সংগ্রহ করছে; দ্বিতীয় স্তরে উৎসাহী ব্যক্তির আচরণে ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটে, যার মধ্যে আছে তার ধর্মীয় আচরণে বদল এবং যোগাযোগের নতুন অভ্যাস (যেমন ইন্টারনেট ব্যবহারের) তৈরি হওয়া। তৃতীয় পর্যায়ে তার সামাজিক জীবন ক্রমশ সীমিত হয়ে আসে, যেখানে সে কেবল সমমনাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকে এবং বিপরীতক্রমে তার পরিবার ও পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। চতুর্থ স্তরে ওই ব্যক্তি নৈতিকতার প্রশ্নে একধরনের কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। এই চার স্তরের মডেলের ক্ষেত্রে স্তরগুলো একের পর এক ঘটে।

এনওয়াইপিডি মডেলের প্রথম ধাপ হচ্ছে যেকোনো সাধারণ অবস্থা, যাকে বলা হয়েছে র‍্যাডিক্যালাইজেশন-পূর্ব অবস্থা। এই স্তরে ব্যক্তিটি হচ্ছে একেবারেই সাধারণ মানুষ, সাধারণ চাকরিতে নিয়োজিত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতীতে অপরাধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার কোনো ইতিহাস নেই। দ্বিতীয় স্তর, যাকে বলা হচ্ছে সচিহ্নিতকরণ স্তর, যে স্তরে ব্যক্তি ইসলামের সালাফি ধারা বিষয়ে অনুসন্ধানী হয়ে ওঠে, তার পুরোনো পরিচয় থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে এবং তার সমমনাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই পর্যায়ে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে কোনো সংকট কিংবা মানসিকভাবে নতুন ধারণা গ্রহণের প্রস্তুতি এবং ট্রিগার বা সূচনাকারী বিষয় হতে পারে সামাজিক (যেমন বঞ্চনা, বৈষম্য), রাজনৈতিক বা একেবারেই ব্যক্তিগত কোনো দিক। তৃতীয় স্তর হচ্ছে মতদীক্ষা স্তর (ইনডকট্রিনেশন)। এই স্তরে ব্যক্তি ক্রমাগতভাবে তার ধর্মবিশ্বাসকে শক্তিশালী করে, সালাফি মতাদর্শ গ্রহণ করে এবং এই উপসংহারে পৌঁছায় যে জঙ্গি কার্যক্রম ‘আবশ্যক’। চতুর্থ স্তরকে বলা হয়েছে, জিহাদীকরণ। এই স্তরে গ্রুপের সদস্যরা ‘জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য তাদের নিজ নিজ ব্যক্তিগত দায়িত্ব গ্রহণ’ করে এবং গ্রুপ প্রায়োগিক পরিকল্পনা বা অপারেশনের ছক আঁকা শুরু করে। এই মডেল বিষয়ে যেসব সমালোচনা আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এখানে ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে প্রক্রিয়াটি একমুখী এবং কনভেয়ার বেল্টের মতো।

পিইটি ও এনওয়াইপিডি মডেল দুইয়েরই প্রধান লক্ষ্য ছিল নিজ নিজ দেশে, অর্থাৎ ডেনমার্ক ও যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম তরুণদের র‍্যডিক্যালাইজেশনের পথরেখা কী তা বের করা। অন্যদিকে মার্ক সেইজম্যানের গবেষণার বিষয় বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী, বিশেষ করে আল-কায়েদার সাংগঠনিক বিস্তার। তাঁর গবেষণার নমুনা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা। তিনিও মনে করেন যে র‍্যাডিক্যালাইজেশন ঘটে চার স্তরে। প্রথম স্তরে হচ্ছে নৈতিক ক্ষোভ তৈরি হওয়া, যার উৎস হতে পারে মুসলিমদের ওপরে অত্যাচার ও নিপীড়ন। দ্বিতীয় স্তরে ঘটে বিশ্বের অবস্থার এক বিশেষ ধরনের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ, যেমন নৈতিকতার লঙ্ঘনকে মনে করা হয় ‘ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বলে। তৃতীয় স্তরে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ র‍্যাডিক্যাল চিন্তা নিয়ে সমমনাদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব আদর্শিক গোষ্ঠী ব্যক্তি বা অন্য গোষ্ঠীকে তাদের বিশ্বাস, আদর্শ ও কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে যুক্তি প্রদান করার মধ্য দিয়ে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। শেষ পর্যায়ে এসে গোষ্ঠীগত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের সচল করে তোলা হয়; এই শেষ পর্যায়ে বিভিন্ন রকম ইন্টারএক্টিভ মিডিয়ার মাধ্যমে (যেমন ইন্টারনেট ফোরাম ও চ্যাট রুম) তাদের সেই ক্ষোভকে সুনির্দিষ্ট আক্রমণে পরিণত করা হয়।

ফাতালি মোঘাদ্দামের প্রস্তাবিত স্টেয়ারকেস মডেলে প্রক্রিয়াটি হচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে একটি পাঁচতলা বাড়িতে ওঠার মতো। এর প্রতিটি তলার কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে। (তাঁর মডেলটি দেখতে নিচের ছবির মতন।)

4

মোঘাদ্দামের এই মডেলের সঙ্গে ডাচ গবেষক বি ডুজে এবং ডি উলফ প্রতিটি স্তরে কী ধরনের লক্ষণ দেখা যাবে, সেটার দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। এ আলোচনার আলোকে আমরা এই বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণগুলো চিহ্নিত করতে পারি। এই মডেলে নিচতলার সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে বঞ্চনা, বৈষম্য, অবিচার এবং ব্যক্তিগত অগ্রসরতার অভাবের বিষয়ে হতাশা। এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট একধরনের ব্যাখ্যার প্রতি পক্ষপাত, অনিশ্চয়তা, আত্মপরিচয়ের ওপর আক্রমণের অনুমান, ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে মতবিনিময়; এ অবস্থার দৃশ্যমান লক্ষণ হচ্ছে, এর ব্যাখ্যাসূচক আদর্শের বিষয়ে উৎসাহ, ইতিবাচক আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান এবং অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার প্রবণতা। প্রথম তলার বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে, এই অবস্থার অবসানের ব্যাপারে একাধারে আশাবাদ ও সাফল্যের অভাবে হতাশা, বিরাজমান পদ্ধতি ও ব্যবস্থার বৈধতা বিষয়ে সংশয়; এই অবস্থার দৃশ্যমান লক্ষণ হচ্ছে, চারপাশের পরিচিত গোষ্ঠীগুলোর ওপরে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এবং এই ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে আস্থার অবসান।

দ্বিতীয় তলার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যেসব কারণে তার ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধানের বিষয়ে নিজের অপারগতার কারণে ওই ক্ষোভকে অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োগ করা, ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে আগ্রাসী ভাবের আধিক্য (যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘ডিসপ্লেসমেন্ট অব এগ্রেশন’); এর দৃশ্যমান লক্ষণ হচ্ছে র‍্যাডিক্যাল আদর্শের অনুসন্ধান। তৃতীয় তলার বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে, নিজের এত দিনের পরিচিত গোষ্ঠী, এমনকি পরিবারের ভেতরেও নিজের অবস্থান প্রশ্নে অনিশ্চয়তা, গোষ্ঠীতে নিজের বক্তব্যের যৌক্তিকতা প্রদানের চেষ্টা, রোলমডেল চিহ্নিতকরণ এবং তা থেকে শেখার চেষ্টা; এর দৃশ্যমান লক্ষণগুলো হচ্ছে, এত দিনের পরিচিত পরিবেশ ও গোষ্ঠী থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা, নতুন যে গোষ্ঠীতে যুক্ত হয়েছে বা হতে আগ্রহী, সেই গোষ্ঠীর সদস্যদের পোশাক-আশাক পরিধান, ক্ষেত্রবিশেষে নাম পরিবর্তন। এই পর্যায়েই ব্যক্তির জীবনে প্রত্যক্ষভাবে সন্ত্রাসী সংগঠনের ভূমিকা যুক্ত হয়, প্রশিক্ষণ এবং নৈতিক সংযুক্তির বিষয়টি সংঘটিত হয় এখানেই। একটি ‘আদর্শ সমাজ’ গঠনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেকোনো পথ অবলম্বনই যে যৌক্তিক, সে বিষয়ে ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। সাধারণত পরিবার, পরিচিত পরিবেশ, বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, নতুন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত করা, গোপনীয়তা অবলম্বনের শিক্ষা দেওয়া এবং ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটে এই পর্যায়ে।

চতুর্থ তলায় উপস্থিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তি সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ব্যক্তি ও সামাজিক পরিচয়ের মধ্যে মিশ্রণ এবং গোষ্ঠীতে কার্যকর ভূমিকার কারণে নিজের ভাবমূর্তিতে পরিবর্তন; দৃশ্যমান লক্ষণ হচ্ছে, ব্যক্তি এখন আর পরিচিত পরিসরে দৃশ্যমান থাকে না, ‘অবিশ্বাসী’দের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। এই স্তরে সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, গোপন জীবনে অভ্যস্ত হয় তারা, সাধারণত সদস্যরা একে অন্যের সঙ্গে একমত হতে চাপের মধ্যে থাকে এবং নেতৃত্বের প্রতি বাধ্যতা তৈরি হয়। পঞ্চম স্তর হচ্ছে, যেখানে ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে সহিংসতায় অংশ নেয়। এই স্তরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অপরাধ সংগঠন, বিশেষত নির্মমভাবে হত্যার বিরুদ্ধে যেসব মানবিক-মানসিক বাধা আছে, সেগুলো দূর করা, নিজের গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর পার্থক্যকে বড় করে দেখানো, আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুকে ‘শত্রু’ বলে চিহ্নিত করা, ‘শত্রুকে’ অমানবিক বস্তুতে পরিণত করা। সদস্যদের চিন্তা ও কথায় একই সঙ্গে পৃথিবীর অনিবার্য চূড়ান্ত ধ্বংস এবং ভবিষ্যতে একটি ন্যায়সংগত সমাজ প্রতিষ্ঠার বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া।

সহিংস র‍্যাডিক্যালাইজেশনের, বিশেষত ইসলামপন্থী সহিংস র‍্যাডিক্যালাইজেশনের প্রক্রিয়া এবং এর কারণবিষয়ক আগের আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট তা হলো, এ প্রপঞ্চটি পটভূমিকেন্দ্রিক। নিজ নিজ সমাজ ও দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার মধ্যেই এর উৎস খুঁজতে হবে। যদিও ব্যক্তিভেদে সহিংসতার প্রণোদনা হয় ভিন্ন এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি তাতে ভূমিকা রাখে; তা সত্ত্বেও এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কতিপয় পূর্বশর্তের উপস্থিতি ছাড়া, অনুকূল পরিবেশ ছাড়া সমাজের কোনো অংশের র‍্যাডিক্যালাইজেশন ঘটে না। কোন কারণগুলো র‍্যাডিক্যালাইজেশনকে সহিংসতার দিকে নিয়ে যাবে তার কোনো ক্রমতালিকা নেই, কিন্তু বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাদ দিয়ে এই প্রক্রিয়া বোঝা অসম্ভব। ভাবাদর্শ বা আইডিওলজি যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেটা অনস্বীকার্য; তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মতদীক্ষা বা ইনডকট্রিনেশন। নতুন প্রযুক্তি সেই পথকে সহজ করে দিয়েছে। জঙ্গি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক, পরিচয় ও গ্রুপের ভূমিকা অপরিসীম। একসময় র‍্যাডিক্যালাইজেশন প্রক্রিয়া বুঝতে মনে করা হতো যে সংগঠন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে। এখন দেখা যাচ্ছে যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সংগঠন খুঁজে বের করে যোগ দিচ্ছে।

প্রথম আলো’তে চার পর্বে প্রকাশিত। অগাষ্ট ৯-১২, ২০১৬।

Leave a Reply