ডিসেম্বর 14, 2025
trump__clinton-2-701x482

This post has already been read 21 times!

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রধান দুই দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে প্রথম বিতর্ক শেষ হয়েছে। ডেমোক্রেটিক প্রার্থী সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন এবং রিপাবলিকান প্রার্থী আবাসন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যকার নব্বই মিনিটের এই বিতর্কে স্পষ্টতই হিলারী ক্লিনটন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ভালো করেছেন। সহজ ভাষায় বললে – এই বিতর্কে হিলারীই জয়ী হয়েছেন। অনুমান করা হচ্ছে যে এই বিতর্কের মোট দর্শক ছিলেন ১০ কোটি। সেই অর্থে ইদানিংকালের যে কোনো বড় ধরণের টেলিভিশন অনুষ্ঠানের তুলনায় এটি অনেক বেশি দর্শক আকর্ষন করেছে। সিএনএনের দর্শকদের ৬২ শতাংশ মনে করেন হিলারী জিতেছেন, অন্যদিকে ২৭ শতাংশ মনে করেন ট্রাম্প জিতেছেন। এই ধারণা অন্য চ্যানেলের দর্শকদেরও। বিশ্লেষকরাও একমত।
আগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনগুলোর সময়ে বিতর্কের যে ধরণের কাঠামো থাকে এই প্রথম বিতর্কে তা ছিলো না – এবার প্রার্থীরা সরাসরি পরস্পরের বক্তব্য খন্ডন করেছেন। ফলে এই বিতর্কে দুই প্রার্থীরই বক্তব্য দেয়ার এবং তাঁদের পক্ষেই বিষয় নিয়ন্ত্রন করার সুযোগ বেশি হয়েছে; মডারেটর সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন কিন্ত তারপরে বিষয় অনেকটাই দুই বক্তার হাতেই চলে গেছে। এতে করে বিত র্কের মধ্যে উত্তেজনা থাকলেও সবেচেয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে এমন দাবি করা যাবে না। আলোচিত হয় নি অনেক বিষয়ই, যেমন অভিবাসীদের বিশেষত অনিবন্ধিত অভিবাসীদের প্রসঙ্গ, একেবারেই উঠে আসেনি; যদিও ট্রাম্প তাঁর নি র্বাচনী প্রচারণার গোরা থেকেই এদের প্রতি এক ধরণের বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো আপত্তিকর মন্তব্য করে আসছেন। মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিষয়ে ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রসঙ্গ হিলারী উত্থাপন করলেও তা এসেছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। সারা পৃথিবীর জন্যে এক বড় হুমকি হচ্ছে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ কিন্ত সে বিষয়ও থেকেছে অনালোচিত।

এই বিতর্কে হিলারির বিজয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর প্রস্ততি। বিশেষ করে পররাষ্ট্র এবং নিরাপত্তা প্রশ্নে তিনি যে ট্রাম্পের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ এবং তাঁর ধারণা যে সুস্পষ্ট সেটা সহজেই বোঝা গেছে। তদুপরি, ট্রাম্পকে কথার ফাঁদে ফেলে খানিকটা নাস্তানাবুদ করতে পেরেছেন হিলারী। ট্রাম্পের অসহিষ্ণু মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে একাধিক বার। অনন্ত তিনবার ট্রাম্প হিলারী ক্লিনটনের বক্তব্যে বাধা দিয়ে নিজেই বক্তব্য অব্যহত রেখেছেন, কম পক্ষে চব্বিশ বার তিনি হিলারীর বক্তব্যের মধ্যে কথা বলে বাধা সৃষ্টি করেছেন; হিলারী কখনোই ট্রাম্পের কাছ থেকে কার্যত ফ্লোর নিয়ে নেন নি, সামান্য বাধা দিয়েছেন পাঁচ বার। এই সবই হিলারির জন্যে সুসংবাদ। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে বিতর্কে তাঁর বিজয় নি র্বচানের বিজয়ে সাহায্য করবে কি না। অন্যভাবে বললে, নির্বাচনের ফলাফল কিংবা জনমতকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে এই সব টেলিভিশন বিতর্কের ভূমিকা কতটুকু? আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে প্রথম বিতর্কে বিজয়ী হওয়ায় হিলারী শিবির কি খানিকটা আশ্বস্ত হতে পারেন?

রাজনৈতিক যোগাযোগ বিশেষত নির্বাচন ও জনমত নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাঁরা প্রথম প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। জেমস স্টিমসন ১৯৬৬ সালে থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিতর্কের প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে যদি নির্বাচন খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হয় তবে ভোটারদের ওপরে বিতর্কের প্রভাব খুব সামান্যই, প্রায় নেই বললেই চলে (টাইডস অব কনসেন্ট, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪)। তিনি দেখান যে কেবল ১৯৬০, ১৯৮০ এবং ২০০০ সালে বিতর্ক জনমতে সামান্য পরিবর্তন ঘটেছিলো। কিন্ত তা ফলাফলের জন্যে গুরুত্বপূর্ন বলে তিনি মনে করেন নি। এই বিষয়ে সবচেয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন রবার্ট এরিকসন ও ক্রিস্টোফার ওয়েজিয়েন। তাঁরা ১৯৫২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিতর্কের আগের এবং পরের জনমত জরিপের মধ্যে তুলনা করে দেখিয়েছেন যে ১৯৭৬ সালের নির্বাচন ছাড়া বিতর্কের পরে জনমতে কোনো প্রার্থীর সমর্থনে বড় ধরণের কোনো ধ্বস নামেনি, কারো সমর্থনে বড় ধরণের বৃদ্ধি ঘটেনি; যে সব পরিবর্তন ঘটেছে তার প্রাভাব স্থায়ী হয় নি। কিন্ত আমরা জানি যে, ১৯৭৬ সালকে ব্যতিক্রম হিসেবেই নিতে হবে কেননা সেখানে দেশের অর্থনীতি, তেল সংকট, ইরানে জিম্মি সংকট ইত্যাদি অনেক বিষয় প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। অবন্য যে সব ক্ষেত্রে যে সামান্য পরিবর্তন ঘটেছে তা ঘটেছে বিতর্কের পরপরই এবং এরিকসন এবং ওয়েজিয়েন সেই পরিবর্তনকে বলেছেন ‘ভঙ্গুর’ (দি টাইমলাইন অব প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন, শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১২)। থমাস হলব্রুকের লেখা বইয়ে দেখা যায় যে, ১৯৯২ সালের দ্বিতীয় বিতর্কে আপাতদৃষ্টে জর্জ বুশ ভালো না করলেও তাঁর জনমতে মাত্র দুই পয়েন্ট ক্ষতি হয়েছিলো (ডু কেম্পেইনস মেটার?, সেইজ পাবলিকেশন্স, ১৯৯৬)। অন্য দিকে ২০১২ সালে প্রথম বিতর্কে রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রামনি প্রেসিডেন্ট ওবামার চেয়ে ভালো করেছিলেন এবং রামনি’র সমর্থনও বেড়েছিল; কিন্ত সেই নির্বাচনের ফলাফল আমাদের জানা আছে।

ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার সেন্টার ফর পলিটিক্স –এর গবেষক ল্যারি সাবাতো, কাইল কন্ডিক ও জেফরি স্কেলি তাঁদের গবেষণায় দেখান যে বিতর্কের আগে ও পরে জনমতের পার্থক্য আসলে সামান্যই এবং তার প্রভাব খুব বেশি নয়। এরিকসন এবং ওয়েজিনের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ল্যারি সাবাতো ও তাঁর সহকর্মীরা দেখান যে, জনমতে যে সামান্য বদল ঘটে তা ঘটে সাধারণত প্রথম বিতর্কের পরে। যেমন ১৯৯৬ সালে ডেমোক্রেট প্রার্থীর প্রতি সমর্থন কমেছিলো তিন দশমিক তিন পয়েন্ট, অর্থাৎ রিপাবলিকান প্রার্থী এগিয়েছিলেন ঐটুকুই। ২০০৪ সালে রিপাবলিকান প্রার্থীর বিপরীতে ছয় দশমিক দুই পয়েন্ট এগিয়েছিলেন ডেমোক্রেট প্রার্থী – কিন্ত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন রিপাবালিকান প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশ। এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ এই যে, যদি কোনো প্রার্থী বিতর্কে ভালো না করেন তবে তাঁর সমর্থকদের মধ্যে আগ্রহের ও উদ্দীপনার অভাব ঘটে এবং তাঁরা সোৎসাহে জনমত জরিপে অংশ নেন না। কিন্ত এর ফলে ঐ প্রার্থীর সমর্থকরা তাঁকে ছেড়ে চলে যান না। গবেষকরা বলছেন যে আসলে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারনে বিতর্কের প্রভাব প্রধানত সমর্থকদের মধ্যে উদ্দীপনা তৈরিতে। বিতর্ক ভোটারদের মন বদলে সক্ষম হয় বলে এখনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্ত তাই বলে এর গুরুত্ব একেবারে নেই তা বলা যাবে না। এর প্রধান মুল্য হচ্ছে ভোটারদের নির্বাচনে উৎসাহিত করে রাখা। কিন্ত এটাও লক্ষনীয় যে, এই সব বিতর্কের দর্শকের পরিমাণ সংখ্যার দিক থেকে বাড়লেই মোট ভোটার-হবার-বয়সীদের মধ্যে তার ভাগ আসলে খুব বেশি নয়। ২০০৮ সালের উত্তেজনাকর নির্বাচনের সময়ও মোট ভোটার হবার বয়সীদের মধ্যে মাত্র ২৩ শতাংশ প্রথম বিতর্ক দেখেছিলেন। সেই তুলনায় ২০১২ সালে বেশি লোক এই বিতর্ক দেখেছিলো – ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। ১৯৮০ সালের নির্বাচনের সময় এই হার ছিলো ৫১ শতাংশ। আরো বিস্তারিত তথ্য হাতে এলে বোঝা যাবে যে এই বিতর্ক এই ধারাকে বদলাতে পেরেছে কীনা।

এই সব বিতর্কের দর্শকদের বিষয়ে অন্য আরেকটি তথ্যও গুরুত্বপূর্ণ; তা হল এই সব বিতর্ক তরুণদের খুব বেশি আকর্ষন করতে পারেনা। যুক্তরাষ্ট্রে একটি শীর্ষস্থানীয় পাবলিক পলিসি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া’র এনেনবার্গ পাবলিক পলিসি সেন্টার। তাঁরা ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের সংস্কার বিষয়ক একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিলো (ডেমোক্রেটাইজিং দি ডিবেইটস, ২০১৫)। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, বিতর্কের দর্শকের যে সংখ্যা বেড়েছে তা বেড়েছে ৫০ থেকে ৬৫ বছর বয়সীদের মধ্যে। ২০১২ সালে ১৮ বছর বা তার কাছাকাছি বেশি বয়সীদের মধ্যে মাত্র কুড়ি শতাংশ মাত্র একটা বিতর্কের সামান্য অংশ দেখেছে; যদিও বিতর্কগুলো হয় ৯০ মিনিট এই বয়সের দর্শকেরা দেখেছে গড়ে মাত্র চল্লিশ মিনিট। ফলে তরুণ ভোটারদের কাছে এইসব বিতর্ক পৌছুতেই পারে কিনা সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। এবারের নির্বাচনে তরুণদের উতসাহের অভাবের প্রেক্ষাপটে এতা একটা বড় বিষয়। এই সব স্বত্বেও আমরা জানি যে, বিতর্ক মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটি অবিভাজ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ফলে সেই নিয়ে গণমাধ্যমের উৎসাহ রয়েছে এবং তা ভোটারদেরকে অন্তত ভোট দানে উৎসাহী করে বলেই ধারণা করা হয়, ফলাফলকে প্রভাবিত না করলেও ।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে এই বিতর্কের পরে হিলারী শিবিরে কি সামান্য স্বস্তি তৈরি হয়ে পারে? আপাতদৃষ্টে তা মনে হলেও প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্পের উত্থান হিলারী শিবিরে স্বস্তির কারণ হতে পারে না। রিপাবলিকান দলের প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ার সময়ে প্রথম দিকের বিতর্কগুলোর পরে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে কার্যত তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যত অত্যন্ত ছোটই হবে, কেননা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁর চেয়ে অনেক ভালো করেছে। কিন্ত বিস্ময়কর ভাবে ট্রাম্পের সমর্থকরা তাঁকে ছেড়ে যান নি, বিপরীতক্রমে তাঁর পক্ষে সমর্থন বেড়েছে। ফলে আমরা এক অভূতপূর্ব নির্বাচনের মুখোমুখি হয়েছি। ফলে প্রথম বিতর্কে বিজয়ী হলেও হিলারী শিবিরে স্বস্তি বা আত্মতৃপ্তির সময় এবং সুযোগ নেই। এই বি ত র্ক থেকে যদি হিলারী যদি কোনো ইতিবাচক কিছু পান তা হবে তাঁর সমর্থকদের উদ্দীপনা, এখন নির্বাচনের মাঠে সেই উদ্দীপনাকে কাজে লাগাতে হবে; অন্যথায় অনেক পরে বিশ্লেষকরা হিসেব করতে বসবেন – কেমন করে কী হল।

ইলিনয়, ২৭ সেপ্টেম্বর,০১:৩৪ মিনিট

This post has already been read 21 times!

মন্তব্য করুন