বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে- এ নিয়ে দ্বিমত করার কম জনকেই পাওয়া যাবে। চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব-ক্ষমতা এখন প্রশ্নাতীত। দিনে দিনে যেন শতফুল প্রস্ফুটিত হচ্ছে। এটা আকস্মিকভাবে হয়নি। অষ্টাদশ শতাব্দীতেই চীন বিশ্বের বৃহত্তর অর্থনীতি ছিল। অবিভক্ত ভারতবর্ষ ছিল দ্বিতীয় স্থানে। সে সময়ে ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলা বা বেঙ্গল ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশ বা অঞ্চল। এই বাংলার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক কয়েক শতাব্দী পুরনো। চীনের অ্যাডমিরাল জ্যাং হে বড় ধরনের নৌবহর নিয়ে এসেছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরে। এ দেশটিকে বলা হয় সিভিলাইজেশনাল কান্ট্রি। তারা তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেছে। অনেকে বলেন চীনের উত্থান ঘটেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি লোকসংখ্যার দেশটির অর্থনৈতিক ক্ষমতার পুনরুত্থান ঘটেছে। বাংলা সেটা পারেনি। এর একটি কারণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। আমাদের ভূখণ্ড অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে আছে। আমরা পুনরুত্থানের অপেক্ষায় রয়েছি।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে- সেটা হচ্ছে চীনের দর্শন। এ দেশটি দ্বন্দ্ব-বিরোধকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে পারে। কারও সঙ্গে কোনো বিষয়ে বিরোধ বা দ্বন্দ্ব দেখা দিলে তার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অন্য সব ইস্যু তারা ঝুলিয়ে রাখে না। বরং দেখে ভারসাম্য বজায় রাখার মতো পরিস্থিতি রয়েছে কি-না। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের ১৯৭১ সালে মতভিন্নতা ছিল। ভারতের সঙ্গে তাদের সীমান্ত নিয়ে সমস্যা রয়েছে। কিন্তু কোনো দেশের সঙ্গেই অথনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে তাদের সমস্যা হয়নি। তারা অর্থনীতি ও রাজনীতিকে এক করে দেখে না। আমরা চীনের নেতা দেং শিয়াও পিংয়ের বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করতে পারি- ‘বিড়াল সাদা না কালো সেটা বড় নয়। সে ইঁদুর ধরতে পারে কি-না, সেটাই দেখতে হবে।’ তারা দেখে থাকে- কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সম্পর্ক এগিয়ে যাবে। রাজনীতিতে সমস্যা থাকলে তারা অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগ দেয়। এতেও অগ্রগতি না হলে খেলাধুলায় সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চেষ্টা করে। ভারত ও চীন নিজেদের বাণিজ্য সম্পর্ক যে বিপুলভাবে বাড়াতে পেরেছে, তার পেছনে এ কৌশল কাজ করেছে। বর্তমানে দুই দেশের বাণিজ্য বছরে ৮০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চীনের রফতানিই সিংহভাগ। ভারতের রফতানি সে তুলনায় অনেক কম।
তিন দশক আগে চীনের একজন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু ২০১৬ সালের চীন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার সক্ষমতা, প্রভাব তখনকার তুলনায় অনেক অনেক বেশি। চীনের বর্তমান নেতা শি জিনপিং ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুটের’ যে নীতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন তার শক্তি এখানেই। তিনি অতীতের স্থল ও জলপথের সিল্করুট পুনরুদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়েছেন। অর্থাৎ স্থল ও সমুদ্র উভয় পথেই চাই সংযোগ। বাংলাদেশ বহু শতাব্দী ধরেই এই দুই রুটে চীনের সঙ্গে যুক্ত। শুধু বাংলাদেশ নয়, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট নীতি অনুসরণ করে ইতিমধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার প্রায় ৭০ দেশের সঙ্গে চীন নিজেদের যুক্ত করেছে।
একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতেও তারা মনোযোগী হয়েছে। ২০০৫ সালে তাদের মোট রফতানির ৭.১ শতাংশ ছিল দক্ষিণ এশিয়ায়। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশে। ২০১০ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের বাণিজ্য ছিল ৭০ বিলিয়ন ডলারের। ২০১৫ সালে তা দ্বিগুণের বেশি হয়_ ১৫০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য এ সময়ে বিপুলভাবে বেড়েছে। এখন চীন থেকেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে। এক সময়ে এ স্থান ছিল ভারতের।
গত এক দশকে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত যে পরিবর্তন ঘটেছে তার কারণে বড় ধরনের বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশকে ঘোষণা করার তাই সঙ্গত কারণ রয়েছে। এর আওতায় বাংলাদেশ ও চীনের সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ে প্রতি বছর আলোচনা-পর্যালোচনা হবে। লক্ষ্য থাকবে সম্পর্ককে এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে নিয়ে যাওয়ার।
চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের সময়ে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি-সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। অন্য দেশগুলো বিষয়টিকে কীভাবে দেখবে, সেটা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বিশেষভাবে বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কথা। আমার ধারণা, এ দুটি দেশের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে না। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলি। চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। অর্থনৈতিক সম্পর্ক তো অবিশ্বাস্য। যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণ দৈনন্দিন জীবনে যা কিছু ব্যবহার করে, তার বড় অংশ যায় চীন থেকে। চীন যে ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানি করে, যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশে তা তৈরি করতে পারবে না। অনেকে মজা করে বলেন, বিভিন্ন দেশে ক্ষোভে-রোষে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পুড়লে বেশি লাভ হয় চীনের। কারণ এ পতাকা রফতানি হয় চীন থেকে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব চুক্তি সই হয়েছে তাতে নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত নেই। এখন যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থনৈতিক ক্ষমতা তা অতীতের তুলনায় দুর্বল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তারা ইউরোপের পুনর্গঠনে মার্শাল প্ল্যান তৈরি করেছিল এবং তার বাস্তবায়নে অর্থ জোগায়। এখন চীন ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট নীতি নিয়েছে এবং সেটাকেই বিশেষজ্ঞরা তুলনা করছেন মার্শাল প্ল্যানের সঙ্গে। চীনের বিনিয়োগের বড় অংশ ব্যয় হবে বাংলাদেশে অবকাঠামো সুবিধা সৃষ্টির জন্য। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।
ভারতই বা কেন উদ্বিগ্ন হবে? ত্রিশ বছর আগে চীনের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক ছিল তাতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন দুটি দেশ বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করছে। আগেই বলেছি, বাণিজ্যকে চীন অন্যান্য ইস্যু থেকে পৃথক করতে জানে। বাংলাদেশে তারা যে বিনিয়োগ করতে চাইছে, ভারতের সে সক্ষমতা নেই। তার নিজের দেশের অনেক রাজ্য রয়েছে, যেখানে অবকাঠামো সুবিধা অনুন্নত। দারিদ্র্য ব্যাপক। বাংলাদেশকে বড় ধরনের সহায়তা দেওয়ার আগে তাকে নিজ দেশের অনুন্নত এলাকাগুলোর কথা ভাবতে হয়। তা ছাড়া, এটাও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে চীন যে বিপুল বিনিয়োগ করতে চাইছে তা বাস্তবায়িত হলে ভারতেরও লাভ। তারা নিজেরাও এশিয়ার এ অঞ্চলের সঙ্গে কানেকটিভিটি বাড়াতে চাইছে। আমার ধারণা, ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে বৈরিতার সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে তারা যেমন লাভবান হবে, এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাকিস্তান সম্পর্কেও একই কথা। দুটি দেশ নিরাপত্তা জোরদারে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে, তা কাজে লাগানো যাবে আর্থসামাজিক উন্নয়নে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের যে বিরোধ দশকের পর দশক ধরে চলছে, তাতে লাভ বেশি চীনের। তারা জানে দুইশ’ বছর আগেও চীনের অর্থনৈতিক ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষের ক্ষমতা। এ অঞ্চল ঐক্যবদ্ধ থাকলে চীনের মতোই পুনরুত্থান ঘটবে তাদের অর্থনীতির। এখন চীনের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ। এসব দেশের উন্নয়নেও চীন প্রধান পার্টনার। ভারত যদি চীনের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে দরকষাকষি করতে চায়, তাহলে তাকে মনোযোগ দিতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার প্রতি। শুধু নিজ দেশ নিয়ে নয়, বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল এ দেশটিকে ভাবতে হবে গোটা দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে। কেবল এভাবেই তারা নিরাপত্তার জন্য ব্যয় করা অর্থের বড় অংশ স্থানান্তর করতে পারবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য।
বাংলাদেশে চীন যে ৩৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চাইছে, সেটা কি বাস্তবসম্মত- এমন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় মনে রাখতে হবে। এক, দক্ষতা বাড়ানো। চীনের জনশক্তির সঙ্গে সমানতালে চলতে জানতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের উন্নয়নে যে মার্শাল প্ল্যান তৈরি করেছিল তা সফল হওয়ার পেছনে বড় কারণ ছিল ইউরোপের দক্ষ জনশক্তি। তাদের ১০০ শতাংশ নারী-পুরুষের ছিল শিক্ষা। চীন নিজ দেশেও এ বিষয়টির প্রতি বিপ্লব জয়যুক্ত হওয়ার পর থেকে মনোযোগ দিয়েছে। আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ চীনের কাছে নিশ্চয়তা পেয়েছে যে, তাদের পণ্যের অর্ডার চীন সময়মতো পূরণ করতে পারবে এবং মানও মিলবে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। দ্বিতীয়ত, আমাদের নজর দিতে হবে সুশাসনের প্রতি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কারণেই পণ্য উৎপাদন কিংবা রফতানির কাজে বিঘ্ন ঘটতে দেওয়া যাবে না। তৃতীয়ত যে বিষয়টির কথা বলব তা ইতিবাচক। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ইস্যুতে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দল সহমত পোষণ করে। দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তুলতে এটা গুরুত্বপূর্ণ।
দৈনিক সমকাল, ১৬ অক্টোবর ২০১৬
বছরে ৮০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য কে সদিচ্ছা থাকলেই ডাবলে রূপান্তরিত করা সম্ভব।
এখন বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্বকে যদি আরেক ধাপ উপরে না নিয়ে যেতে পারি তবে অর্থনৈতিক ভাবে আমরা কোনভাবেই স্থিতিশীল হতে পারবো না বলে আমি বিশ্বাস করি।