অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যা ঘটছে তাকে কেউ কেউ ‘গণহত্যা’ বলে বর্ণনা করছেন। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও মানবাধিকারকর্মী চন্দ্র মুজাফফরের নেতৃত্বাধীন সংগঠন ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট ফর এ জাস্ট ওয়ার্ল্ড’ (জাস্ট)-সহ ১৮টি সংগঠন ২৮ নভেম্বর রোমে অবস্থিত পারমান্যান্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করেছে যেন তাঁরা রাষ্ট্রীয় অপরাধ ও গণহত্যার আলোকে মিয়ানমারের পরিস্থিতি বিবেচনা করেন। আল-জাজিরা টেলিভিশন এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও এ ধরনের প্রমাণ হাজির করেছে, যাতে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক বাহিনীর অভিযানকে গণহত্যা বলে চিহ্নিত করা যায়। লন্ডনের দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট-এর এক প্রতিবেদনে লন্ডনের কুইন মেরি কলেজের গবেষকদের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে মিয়ানমারের প্রভাবশালী নেত্রী অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের ওপরে সামরিক বাহিনীর নির্যাতন বিষয়ে নীরব থাকার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যাকে বৈধতা দিচ্ছেন এবং সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপরে অত্যাচারকে স্থায়ী রূপ দিচ্ছেন। যাঁরা মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ বলতে এখনো রাজি নন, তাঁরাও স্বীকার করেন যে একে ‘জাতিগত নিধন’ বলতেই হবে। জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা পর্যন্ত একে ‘জাতিগত নিধন’ বলেই চিহ্নিত করেছেন। কিন্ত বিস্ময়করভাবে আন্তর্জাতিক সমাজ, এমনকি জাতিসংঘও এই বিষয়ে এক ধরণের নিরবতাই পালন করছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর এই অভিযানের সূত্রপাত ৯ অক্টোবর সীমান্তে সেনাবাহিনীর চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের পরিকল্পিত ও সংগঠিত হামলার জবাব হিসেবে। সেনাবাহিনী নির্বিচারে বেসামরিক রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, একটি অংশ দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছে। তাদের অনেকে ইতিমধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, আরও অনেকে চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের মতো এই আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। এ নিয়ে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে খবর বেরোচ্ছে, সরকারের সিদ্ধান্ত ও করণীয় বিষয়ে দেশের ভেতরেও বিতর্ক হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম অসহায় রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষার এই প্রচেষ্টাকে ‘অনুপ্রবেশ’ বলে বর্ণনা করছে। সরকারের এই অবস্থান ও গণমাধ্যমের এই মনোভঙ্গি কতটা সঠিক? যেসব যুক্তিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ ফিরিয়ে দিচ্ছে, তাই বা কতটা ইতিবাচক? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমাদের বোঝা দরকার যে সাম্প্রতিক কালে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণ কী।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ইতিহাস দীর্ঘ। দেশটিতে আরও অনেক সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার এবং তারা দীর্ঘদিন ধরেই মিয়ানমারের বিভিন্ন সময়ের সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন করে আসছে। প্রধানত মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যেমন ১৯৪৬ সালে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করে, তেমনি প্রধানত খ্রিষ্টান ধর্মানুসারী কারেন জনগোষ্ঠী ১৯৪৯ সাল থেকে সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে। তাই, রোহিঙ্গাদের গত দুই দশকের বিদ্রোহকে বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি মূল্যায়নের চেষ্টা করলে এবং তাকে অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন থেকে একেবারেই আলাদা করে বিবেচনা করলে সামগ্রিক চিত্রটি বোঝা যাবে না। গত ৫০ বছরে মিয়ানমারের এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে উত্থান-পতন ঘটেছে, নেতৃত্ব এবং আদর্শিক অবস্থানে পরিবর্তন ঘটেছে; অনেক সংগঠনের মৃত্যু ঘটেছে, তৈরি হয়েছে নতুন সংগঠন। কিন্তু দেশটিতে কমপক্ষে পাঁচটি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বা অঞ্চল স্বায়ত্তশাসন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক-জাতিগত পরিচয় রক্ষার জন্য সশস্ত্র লড়াই করছে। এরা হচ্ছে কাচিন জনগোষ্ঠী (যাদের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারের ১৭ বছরের যুদ্ধবিরতির অবসান ঘটে ২০১১ সালে) কায়েহ রাজ্য, শান রাজ্য, কারেন রাজ্য এবং আরাকানের রোহিঙ্গারা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে একাধিক বিদ্রোহী সশস্ত্র বাহিনী।
মিয়ানমারের সেনাশাসকেরা ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে প্রায় দুই বছর ধরে ১৫টি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে আটটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে ২০১৫ সালের অক্টোবরে শান্তিচুক্তি করে, সাতটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। সেই সময়ে সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেয়নি; তাদের কার্যত উপেক্ষা করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তই বহাল রাখা হয়। এই শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সু চির সরকার এ বছরের আগস্ট মাসে একটি শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে, সেখানে ১৮টি বিদ্রোহী সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। কিন্তু ৩ সেপ্টেম্বরে যখন এই সম্মেলন শেষ হয়, তখন দেখা যায় কোনো রকম মতৈক্য হয়নি। কারণ, সেনাবাহিনী যেকোনো ধরনের ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে ২০০৮ সালের সংবিধানকে অক্ষুণ্ন রাখার ওপরে জোর দেয়, যেখানে সেনাবাহিনীর অসীম ক্ষমতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। এই সম্মেলনের পরে মিয়ানমার-বিষয়ক বিশ্লেষকেরা সুস্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে আলোচনা সবার অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় যেসব জাতিগোষ্ঠীকে বাদ দেওয়া হচ্ছে তাদের আরও বেশি কঠোর পথেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এবং এতে করে দেশে অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হলো। শুধু তা-ই নয়, এই শান্তি প্রক্রিয়া চলাকালেও সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকে। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গত সপ্তাহেও বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হয়েছে।
গত বছর যখন সেনাশাসনের অবসান ঘটে এবং ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ও তার নেত্রী অং সান সু চি ক্ষমতায় আসেন, তখন অনেকেই আশা করেছিলেন যে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অবসান ঘটবে। কিন্তু সু চি ও তাঁর সরকার রোহিঙ্গা শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহারের আগ্রহ দেখায়নি। তদুপরি তাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান অব্যাহত থাকে। তবে এটাও ঠিক যে এ বছরের আগস্ট মাসে সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে নয় সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা কমিশন গঠন করা হয়, যাতে তিনজন আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিও রাখা হয়, যারা রাখাইন রাজ্যের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে। এই উপদেষ্টা পরিষদের কাজ উপলক্ষে কফি আনান একবার মিয়ানমার সফর করলেও রোহিঙ্গাদের চলাচলের ওপরে আরোপিত বাধানিষেধ তোলা হয়নি, সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। তদুপরি মিয়ানমারের উগ্রপন্থী বৌদ্ধ দল ও গোষ্ঠীগুলো এই কমিশনের প্রবল বিরোধিতা করে আসছে।
এই পটভূমিকায়ই ৯ অক্টোবরের ঘটনা ঘটে। অন্যান্য অঞ্চলে বিদ্রোহীদের হামলার পরে সেনা অভিযানের ক্ষেত্রে যতটা কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয় তার চেয়েও বেশি মাত্রায় কঠোরভাবে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপরে তাদের অভিযান শুরু করে। চলমান সামরিক অভিযানের আশু কারণ যা-ই হোক, তার আকার ও প্রকৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে একে আনুপাতিক প্রতিক্রিয়া বলা যাবে না। বরং এটা রোহিঙ্গাদের নির্মূল করার রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ। ১৯৭৭-৭৮ ও ১৯৯১-৯২ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যেভাবে অভিযান চালানো হয়েছিল এবং ২০১২ সালে যেভাবে তাদের ওপরে হামলা হয়েছে এখনকার ঘটনাবলি এক অর্থে তা থেকে ভিন্ন নয়। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ১৯৮২ সালে যে নাগরিকত্ব আইন হয়েছে তার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় যে নীতি তারই প্রতিফলন হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দফায় দফায় জাতিগত নিধন অভিযান। এবারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযানের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তা সংঘটিত হচ্ছে বেসামরিক নির্বাচিত সরকারের সময় এবং তার বৈধতা তৈরি করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে।
সামরিক বাহিনীর এই নির্বিচার অভিযানের সময়ে অং সান সু চির নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত কয়েক দিনে বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভকারীরা সু চির এই ভূমিকায় বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সু চি ও তাঁর দল নিজেদের আশু রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিচ্ছে বলেই তাদের পক্ষে কোনো রকম পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই রাজনৈতিক বিবেচনার প্রথম দিক হচ্ছে সেনাবাহিনী। সু চি ও তাঁর দল ক্ষমতায় এসেছে ২০০৮ সালের সাংবিধানিক ব্যবস্থার অধীনে, সেখানে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব সুস্পষ্ট। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করা, বা তাকে মোকাবিলা করার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, এনএলডি সে পথে পা বাড়ায়নি। নির্বাচিত সরকার মাত্রই যে সবার অংশগ্রহণমূলক হয় না এবং তার জবাবদিহির ব্যবস্থা যদি প্রাতিষ্ঠানিক না হয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়, তবে তার পরিণতি কী হয়, মিয়ানমারের সরকার তার উদাহরণ। সু চি সরকারের দ্বিতীয় বিবেচনা হচ্ছে জনপ্রিয়তা রক্ষা করা। মিয়ানমারে একধরনের অসহিষ্ণু বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রসার ঘটেছে। উগ্রপন্থীরাই আধিপত্য তৈরি করেছে, যারা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে একধরনের উসকানি দিয়ে আসছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ সব সময়ই শত্রু তৈরি করে, এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটছে। কিন্তু তার বিপরীতে অংশগ্রহণমূলক কোনো আদর্শিক অবস্থান না থাকায় এনএলডি ও সু চি তাদের হাতেই আটকা পড়েছেন। এ অবস্থার অবসান কীভাবে হবে বা আদৌ হবে কি না, সে প্রশ্ন ভিন্ন।
ইতিমধ্যে রোহিঙ্গারা নির্যাতনের মুখে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে।
২
কয়েক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাচারের মুখে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। প্রথমে তাদের সংখ্যা কম ছিল, কিন্তু ক্রমেই তা বেড়েছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের গ্রহণ করতে অনাগ্রহী এবং আমাদের সীমান্তরক্ষীরা তাদের ঠেলে দিচ্ছেন নাফ নদীতে। ২০১২ সালেও বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সমাজের অনুরোধ উপেক্ষা করে শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে অসম্মতি জানায়। বাংলাদেশ যেহেতু শরণার্থী-বিষয়ক ১৯৫১ সালের কনভেনশন বা ১৯৬৭ সালের প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি এবং জাতীয়ভাবে শরণার্থী-বিষয়ক কোনো আইন তৈরি করেনি, সেহেতু শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এই যুক্তিতেই বাংলাদেশ তার অবস্থান তৈরি করেছে। ২০১২ সালের মতো এখনো এটা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বলা হচ্ছে যে আন্তর্জাতিক সমাজের অনুরোধে কর্ণপাত করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আক্ষরিকভাবে বিবেচনা করলে এটা ঠিক।
কিন্তু স্মরণ করা দরকার যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী। মানবাধিকার সনদে এটা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভিন্ন দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করার এবং সে দেশের আশ্রয়ে থাকার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। এ ছাড়া ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত প্রস্তাবেও আশ্রয় প্রার্থনার প্রশ্নে বলা হয়েছে যে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো দেশে অত্যাচারের মুখোমুখি হবেন এমন আশঙ্কা থাকে, তবে ওই ব্যক্তিকে বাধ্যতামূলকভাবে বা বিতাড়নের মাধ্যমে কেবল সে দেশে পাঠানো যাবে না, এমনকি তাঁকে সীমান্তে প্রত্যাখ্যানও (রিজেকশন অ্যাট দ্য ফ্রন্টিয়ার) করা যাবে না। এই সব বিষয় যদিও বলা হয়েছে আশ্রয় প্রার্থনা বা অ্যাসাইলামের প্রশ্নে, তবু মর্মবস্তুর দিক থেকে বিবেচনা করলে এগুলো শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও সমভাবেই প্রযোজ্য। একইভাবে আমরা স্মরণ করতে পারি যে ১৯৮৪ সালের নিপীড়ন ও নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি প্রদানবিরোধী কনভেনশনে (কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার অ্যান্ড আদার ক্রুয়েল ইনহিউম্যান অর ডিগ্রেডিং ট্রিটমেন্ট অর পানিশমেন্ট) বলা হয়েছে, যদি এ কথা বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট কারণ থাকে যে কোনো ব্যক্তিকে অন্য কোনো দেশে পাঠালে তার অত্যাচারের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আছে, তবে কোনো দেশ ওই ব্যক্তিকে বিতাড়ন, প্রত্যর্পণ, ফেরত পাঠানো বা তাকে প্রবেশে বাধা দিতে পারবে না।
বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালেই এই কনভেনশনে সম্মতি দিয়েছে। ফলে আইনগত দিক থেকে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের কোনো রকম বাধ্যবাধকতা নেই বলে যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে এই আন্তর্জাতিক সনদগুলো, যার প্রতি বাংলাদেশ সমর্থন ও আস্থা প্রকাশ করেছে, সেসব বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ আছে তার অসংগতির দিকও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। এর বাইরে মানবিক দিক ও নৈতিক অবস্থান থেকেও শরণার্থীদের প্রশ্নটি বিবেচনা করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কার্যত তিনটি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘটিত সেনা অভিযান সেখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে যুক্ত, ফলে আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া, যাতে করে এই ধরনের পরিস্থিতির সূচনা না হয়। দ্বিতীয়ত, অতীতে বাংলাদেশ যে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে তার একটি অংশ এখনো বাংলাদেশেই আছে। তৃতীয় যুক্তিটি জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কার্যকলাপে যুক্ত হয়েছে এ কথা ঠিক। কিন্তু যেসব অসহায় রোহিঙ্গা বাধ্য হয়ে শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে, তাদের সবাইকে কি এই অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায়?
বাংলাদেশ সরকারের এসব যুক্তি যদি সব দেশই ব্যবহার করে, তবে সারা পৃথিবীর যে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে, তাদের কোথায় আশ্রয় হবে? যে এক কোটি মানুষের কোনো দেশই নেই, তাদের সামনে কী পথ খোলা থাকবে? গত বছর সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকে সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে যখন লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে ইউরোপের পথে পা বাড়িয়েছিল, সমুদ্রে ডুবে মারা যাচ্ছিল, তখন যাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবেশী দেশগুলোর সমালোচনা করেছিলেন, তাঁরাই যখন নিজ দেশের দরজা বন্ধের পক্ষে যুক্তি দেন, তখন বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। শরণার্থী ও অভিবাসীদের সবাইকে নিরাপত্তা ঝুঁকি বলে বর্ণনা করার প্রবণতা আমরা ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশের সরকার-সমর্থকেরা তাদের সমালোচনা করতে পিছপা হন না, কিন্তু একই ভাষায় কথা বলা এবং আচরণ করার ক্ষেত্রে তাঁরা যে পিছিয়ে নেই সেটা কি তাঁরা বুঝতে পারেন?
২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লিখিত ভাষণের কথা এখানে স্মরণ যায়: ‘শরণার্থী সমস্যা পাশ কাটিয়ে না গিয়ে অভিবাসী ও শরণার্থীদের স্বদেশ ও গন্তব্য দুই জায়গাতেই সম্ভাবনাময় পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।’ (ভোয়া বাংলা, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬)। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেছিলেন, কী অপরাধ ছিল সাগরে ডুবে যাওয়া সিরিয়ার তিন বছর বয়সী নিষ্পাপ শিশু আইলান কুর্দির? এখন একই ধরনের প্রশ্ন উঠতে পারে রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থী শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের এক দিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আয়োজিত লিডার্স সামিট অন রিফিউজিস-এ বলেছিলেন, বিশ্বব্যাপী শরণার্থীদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আচরণ করতে হবে।
এসব বলার অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশের এই যুক্তিগুলোকে এককথায় নাকচ করে দেওয়া যায়। বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সমাজকে যুক্ত করতে চায়, তবে তা সহজতর হবে যদি এই শরণার্থীদের একাংশকে গ্রহণ করে এবং তাকে কেন্দ্র করেই চাপ সৃষ্টি করে। মিয়ানমার সরকার কফি আনানের নেতৃত্বে রাখাইন রাজ্য-বিষয়ক যে উপদেষ্টা কমিশন গঠন করেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারিভাবে আলোচনার দাবি তোলা দরকার। বাংলাদেশের পক্ষে এই চাপ সৃষ্টির অবকাশ অনেক বেশি থাকবে যদি সে শরণার্থীদের বিষয়ে যুক্ত থাকে। অতীতে যে শরণার্থীরা এসেছিল, তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়েছিল আন্তর্জাতিক সমাজের উদ্যোগে এবং জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কারণে। এবার কফি আনানের এই কমিশনের কারণে এর সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি। ফলে এই সমস্যাকে আন্তর্জাতিকীকরণের স্বার্থেই এখন থেকে শরণার্থীদের বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। কিন্তু শরণার্থীদের প্রতি মানবিক আচরণ না করে সেটা সম্ভব নয়। শরণার্থীদের বিষয়কে নিরাপত্তার প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত করার ধারণা কার্যত আত্মঘাতী। কেননা, এতে শরণার্থীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে ইতিবাচক নয়। কিন্তু এখন যা ঘটছে তা এই দৃষ্টিভঙ্গির বিবেচনায়ও সঠিক নয়। কেননা, বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও জীবন রক্ষার তাগিদে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পার হচ্ছে, তাদের একত্রে জায়গা দেওয়ার চেষ্টা না থাকলে তারা বাধ্য হয়েই সীমান্ত এলাকা থেকে সরে আসবে। আন্তর্জাতিকভাবে বা দ্বিপক্ষীয়ভাবে শরণার্থী প্রত্যাবাসনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে তখন মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করা এবং তাদের ফেরত পাঠানোর কোনো সুযোগ আর থাকবে না। যাঁরা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে চান, তাঁদের জন্য এই ব্যবস্থাই হচ্ছে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা।
সরকার এই বিপদগ্রস্ত শরণার্থীদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে দেখাতে চাইছে। সেটি অমানবিক হলেও সরকারের নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো কেন ‘শরণার্থী’ এবং ‘অনুপ্রবেশকারী’র মধ্যে পার্থক্যকে বিস্মৃত হয়েছে, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। অনুপ্রবেশকারী কথাটার মধ্যে একটি রাজনীতি সুস্পষ্ট; ওই ব্যক্তির কার্যকলাপকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ক্ষতিকারক বলে চিহ্নিত করাই এভাবে বর্ণনা করার লক্ষ্য। যেখানে গণমাধ্যমগুলো তাদের নিজেদের রিপোর্টেই জানাচ্ছে যে এই ব্যক্তিরা জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে দেশত্যাগ করছে। তাই তাদের এই ধরনের শব্দ ব্যবহার উদ্বেগজনক বলেই আমার ধারণা। এতে করে এই অসহায় মানুষের বিষয়ে সমাজে যে মনোভাব তৈরি হবে, তা ভবিষ্যতে বড় রকমের বিপদ ডেকে আনতে পারে।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ৩ ও ৪ ডিসেম্বর ২০১৬