ঢাকার আশকোনা এলাকায় জঙ্গি আস্তানা বলে কথিত একটি বাড়িতে (২৪ ডিসেম্বর ২০১৬) নিরাপত্তা অভিযানের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা দুই কারণে আমাদের মনোযোগ দাবি করে। প্রথমত, কিছু সংবাদমাধ্যমের হিসাবমতে, এটি প্রায় এক বছরের ব্যবধানে একটি আত্মঘাতী হামলার ঘটনা; দ্বিতীয়ত, এক বিবেচনায় প্রায় ১০ বছর পর আবারও কোনো নারীর প্রত্যক্ষভাবে জঙ্গি হামলার সঙ্গে জড়িত হওয়ার ঘটনা ঘটল। এ দুটি বিষয়ই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের প্রকৃতি ও তার প্রভাব বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে এই ঘটনা জঙ্গিবাদ মোকাবিলার কৌশল প্রশ্নে চলমান আলোচনার দিকে মনোযোগ দেওয়ার তাগিদ দিচ্ছে।
সর্বশেষ আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটেছিল ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে। সেই হামলায় হতাহতের সংখ্যা ছিল কম এবং কর্তৃপক্ষ একে আত্মঘাতী হামলা বলে বর্ণনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, যদিও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে সেইভাবেই বর্ণনা করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের হামলার প্রেক্ষাপট ছিল এর আগের চার মাসে ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের ওপর কমপক্ষে ১৯টি হামলার ঘটনা, যাতে বিদেশি নাগরিকেরা নিহত হন। এর মধ্যে ছিল তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের ওপর এবং দেশের একটি নৌ স্থাপনার ভেতরে মসজিদে হামলা। প্রতিটি হামলা আগের হামলা থেকে কেবল ভিন্নই ছিল তা নয়, একই সঙ্গে তা আগের হামলার তুলনায় তীব্র ছিল এবং প্রকৃতিগত পরিবর্তনের ধারণাও দিয়েছিল।
তারই ধারাবাহিকতায় আমরা ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা প্রত্যক্ষ করেছি। ওই হামলায় মোট ২৯ জন নিহত হন, যার মধ্যে হামলাকারী ৫ জনও ছিলেন। ওই হামলার পর শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার চেষ্টায় মারা যান চারজন, যাঁদের মধ্যে একজন সন্দেহভাজন হামলাকারী। এসব হামলার ধরন স্পষ্টতই আত্মঘাতী, শোলাকিয়ার ঘটনা থেকে মনে হয়, হামলাকারীর লক্ষ্য ছিল আত্মঘাতী হামলা; কিন্তু তা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরে বা সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্য করে কৌশল হিসেবে আত্মঘাতী হামলার কোনো উদাহরণ ছিল না।
বাংলাদেশে প্রথম আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে ২০০৫ সালে। সে সময় চারটি আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে—১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে আদালতের কাছে বিচারকদের ওপর, ২৯ নভেম্বর গাজীপুর ও চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণে এবং ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ের সামনে। জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ১৭ আগস্ট সারা দেশে বোমা বিস্ফোরণের পর তাদের অব্যাহত হামলার অংশ হিসেবেই এসব আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিল। এতে দুজন বিচারকসহ কমপক্ষে ৩৪ জন মারা যান। ২০০৬ সালের ১৩ মার্চ জেএমবি নেতা মোল্লা ওমরকে আটকের উদ্দেশ্যে অভিযানের সময় দুই সন্তান নিয়ে ওমরের স্ত্রী সাইদা নাঈম সুমাইয়া আত্মঘাতী হলেও তাঁর লক্ষ্য হামলা ছিল না।
এক দশকের বেশি সময় পর ২০১৫ সালে দেশে আবার পরিকল্পিত আত্মঘাতী হামলা সংঘটিত হলেও সেই সময়ে এই নিয়ে আলাপ-আলোচনায় আগের সেই উদ্বেগ সহজে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়নি। কারণ, তত দিনে আরও বিভিন্ন ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছিল এবং এ ধরনের হামলা ‘অভাবনীয়’ মনে হয়নি। কিন্তু ১ জুলাইয়ের পর সমাজের ভেতরে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন ঘটেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব জঙ্গির সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের বিষয়টি স্বীকার না করা হলেও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। কেউ কেউ এমন দাবিও করেন, জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে। গত ছয় মাসে র্যাব ও পুলিশ বড় ধরনের ছয়টি অভিযান পরিচালনা করেছে, যাতে মোট ২৮ জন নিহত হয়েছেন। এসব হামলায় সরকারের পক্ষে থেকে জঙ্গি সংগঠনের প্রধান বা শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি, যাঁকে বাংলাদেশে আইএসের প্রধান বলে মনে করা হচ্ছিল, সেই তামিম চৌধুরীও আছেন। এসব অভিযানের কোনো কোনোটির কৌশল নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সাধারণ জনগণের মধ্যে জঙ্গিবাদকে প্রত্যাখ্যান করার এবং তা মোকাবিলা করার ব্যাপারে ভিন্নমত নেই।
এই পটভূমিকায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা অভিযানের প্রয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। যেসব ক্ষেত্রে বিকল্পের অবকাশ নেই, সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনী নিশ্চয়ই শক্তি প্রয়োগ করবে এবং জঙ্গিদের সামরিকভাবেই মোকাবিলা করবে। আশকোনায় সেই ঘটনাই ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে জঙ্গিবাদের মোকাবিলা কেবল নিরাপত্তা অভিযানের মধ্যে সীমিত নয়, থাকতে পারে না। সেই বিবেচনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য পদক্ষেপের দিকেও সবার মনোযোগ দেওয়া দরকার। বিগত বছরগুলোতে এবং ২০১৬ সালেও একাধিকবার জঙ্গি অভিযোগে আটক ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন, এমনকি স্থানীয় থানার রেকর্ডও আটক ব্যক্তিদের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অভিযোগ আছে, এসব ব্যক্তিকে আগেই আটক করা হয়েছে এবং তাঁদের দীর্ঘদিন আইনবহির্ভূতভাবে আটক রাখা হয়েছে, তাঁদের অনেকেই নিজেদের নিরপরাধ বলে দাবি করেছেন। ১ জুলাইয়ের পর দেশে ‘নিখোঁজ’ তরুণদের অনুসন্ধানের প্রশ্ন উঠেছিল; কেননা, গুলশানের হামলায় জড়িত ব্যক্তিরা এবং তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই আগে থেকে ‘নিখোঁজ’ ছিলেন। কিন্তু এই আলোচনা বেশি দূর অগ্রসর হয়নি, তার একটি কারণ হচ্ছে যে ‘নিখোঁজ’ এবং ‘আটক’ তরুণদের মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টা হয়নি। সম্প্রতি আবারও তরুণদের নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে, নিখোঁজ হওয়ার মানেই জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেওয়া নয় এটা সত্য, তেমনি এটাও বিবেচ্য যে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলা সম্ভব হয়নি যে আইনবহির্ভূতভাবে কেউ ‘আটক’ নেই। ফলে সরকার ‘জঙ্গিবিরোধী অভিযানে’ যে সাফল্য দেখাচ্ছে এবং দাবি করছে, তা দীর্ঘ মেয়াদে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় যথেষ্ট কি না, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। উল্লেখ করা দরকার, ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের তালিকায় নারীরা আছেন কি না, সেটা নিয়েও খুব আলোচনা চোখে পড়েনি।
সাম্প্রতিক এই আত্মঘাতী হামলা প্রসঙ্গে আমাদের যে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা দরকার তার অন্যতম হচ্ছে, বৈশ্বিকভাবে আত্মঘাতী হামলার সংখ্যা এবং আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় আইএস এখন পিছু হটছে; ইরাকের যে অংশ তাদের দখলে ছিল, তা ক্রমাগতভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে আইএসের শক্তি দুর্বল হচ্ছে। কিন্তু আইএসের জঙ্গি যোদ্ধারা এখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায়, তুরস্কে এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে হামলা বৃদ্ধির উৎস হচ্ছে এসব জঙ্গি। তদুপরি সাংগঠনিকভাবে জড়িত নন কিন্তু আইএসের আদর্শে অনুপ্রাণিত ব্যক্তিরাই এ ধরনের হামলা চালাচ্ছেন। তাঁদের ব্যবহৃত কৌশল হচ্ছে আত্মঘাতী হামলা। শিকাগো প্রজেক্ট অন সিকিউরিটি অ্যান্ড টেররিজমের ডেটাবেইসের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে ২৩৪টি আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর পরের হিসাব পত্রিকাতেই পাওয়া যাবে। ডিসেম্বরের ১০-১২ তারিখেই চারটি দেশে হামলায় ১৪০ জন মারা যান, অধিকাংশ ছিল আত্মঘাতী হামলা। ওই ডেটাবেইসের তথ্য অনুযায়ী এ বছরের ১২ অক্টোবর পর্যন্ত নারী আত্মঘাতী হামলাকারী ছিলেন চারজন, এসব হামলায় নিহতের সংখ্যা ৪০, আহতের সংখ্যা ১৪১। ডিসেম্বরের ওই সব হামলার কমপক্ষে একটি চালিয়েছিলেন দুজন নারী আত্মঘাতী হামলাকারী, যাতে ৩১ জন মারা যান।
নারী আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার বিষয়ে আলোচনায় আমাদের মনে রাখা দরকার, এটি আসলে নতুন কোনো কৌশল নয় এবং তা ইসলামপন্থী জঙ্গিরাই ব্যবহার করেছে, তা নয়। ইউরাম সোওয়াটাজার এক গবেষণায় দেখান যে ১৯৮৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে ২২০টির বেশি হামলা চালিয়েছিলেন নারী আত্মঘাতীরা, যা মোট আত্মঘাতী হামলার ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে ৭৫টি ছিল শ্রীলঙ্কায়, ৬৭টি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনে, ৪৭টি রাশিয়া ও চেচনিয়ায়। সাম্প্রতিক কালে আত্মঘাতী হামলায় নারীদের অংশগ্রহণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পশ্চিম আফ্রিকায়। লং ওয়ার জার্নাল-এর সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২৩টি হামলা চালান নারীরা। এর মধ্যে অধিকাংশ ঘটে নাইজেরিয়ায় বোকো হারামের হয়ে।
আত্মঘাতী হামলার বিষয়ে আশঙ্কার অন্যতম কারণ, বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে আত্মঘাতী হামলা বিষয়ে একধরনের ইতিবাচক মনোভাবের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। আমার এই বক্তব্যের ভিত্তি হচ্ছে, ২০১৪ সালে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপের ফলাফল। ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ২৫ মে পর্যন্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৪টি দেশের ১৪ হাজার ২৪৪ জনের ওপর চালানো জরিপে অন্যান্য অনেক প্রশ্নের ভেতরে এই প্রশ্নও ছিল যে উত্তরদাতা আত্মঘাতী হামলা সমর্থন করেন কি না। প্রশ্ন করা হয়েছিল, ইসলামকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর আত্মঘাতী হামলা যৌক্তিক মনে করেন কি না। বাংলাদেশে এক হাজার জনকে মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উত্তর নেওয়া হয়েছে। তাঁদের ৪৭ শতাংশ মানুষ কমবেশি আত্মঘাতী বোমা হামলার পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ বলেছেন, মাঝেমধ্যে এর দরকার আছে এবং ১৪ শতাংশ বলেছেন, প্রায়ই এটা দরকার। আরও ১৪ শতাংশ বলেছেন, এটা দরকার একেবারে বিরল অবস্থায়। অন্যদিকে ৩৩ শতাংশ বলেছেন, কখনোই এটা সমর্থনযোগ্য নয়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপের ফলাফল থেকে দেশে বিরাজমান মানসিক গঠনের যে চেহারা পাওয়া যাচ্ছে, তার কারণে এবং বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলো আমাদের উদ্বিগ্ন করার জন্য যথেষ্ট বলেই ধারণা করি।
জঙ্গিবাদের মোকাবিলায় এ ধরনের মানসিকতার বিরুদ্ধেও সাফল্য তৈরি করতে হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব, যখন সমাজে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার পথ খোলা থাকবে। সমাজে ও রাজনীতিতে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি ও বিকাশের কারণ অনুসন্ধান এবং তার মোকাবিলার বিভিন্ন কৌশল বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছাড়া কেবল নিরাপত্তা অভিযানের মধ্য দিয়েই জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে, এমন উদাহরণ নেই।
প্রথম আলো’য় প্রকাশিত ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬