পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ইরানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমাজের ২০১৫ সালে সম্পাদিত চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার ঘোষণা করেছেন, তার পেছনে তিনি এবং তাঁর প্রশাসনের কর্মকর্তারা যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন, তা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, এই সব যুক্তি আসলে সত্যের অপলাপমাত্র; সহজ ভাষায় বললে সর্বৈব মিথ্যাচার। কেননা, গত তিন বছরে এই চুক্তির আওতায় ইরান তার যা করণীয়, তা-ই করেছে, ইরানের দিক থেকে এই চুক্তির বরখেলাপের কোনো প্রমাণ নেই। পরমাণুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন তা বলেছে, তেমনি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনেও তা-ই আছে। এই চুক্তি এখন যদি সম্পূর্ণ ভেস্তে যায় এবং ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে অগ্রসর হয়, তার দায় ইরানের নয়, এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই চুক্তিকে ‘একপক্ষীয়’ ও ‘সবচেয়ে বাজে’ বলে বারবার বলার পেছনে যে খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন তা হচ্ছে, চুক্তির অন্তর্ভুক্ত ‘সানসেট প্রভিশন’, অর্থাৎ ইরানের ওপর আরোপিত কিছু কিছু বাধানিষেধ নির্দিষ্ট সময়ের পর অবসিত হবে বলে যেসব বিধান রাখা হয়েছে, সেটি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানের সময় থেকেই ট্রাম্প বলে আসছিলেন, চুক্তিতে এই সব ব্যবস্থা থাকার ফলে ইরান কেবল বিধানগুলো অকার্যকর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে এবং একসময় আবারও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারবে। ইরান অবশ্য সব সময়ই বলে এসেছে যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি তার লক্ষ্য নয়।
২০১৫ সালে চুক্তি হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েল এবং এই চুক্তির বিরোধীরা এই সব বিধানের কঠোর সমালোচনা করে এসেছে। কিন্তু যাঁরা চুক্তির বিস্তারিত পাঠ করেছেন এবং পারমাণবিক অস্ত্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, তাঁরা বলেছেন যে এই আশঙ্কা অবাস্তব। কেননা, ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম থাকবে না, ওই মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মতো সুযোগও থাকবে না। এমনকি সমস্ত বিধানের অবসানের পর ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইলে কমপক্ষে এক বছর লাগবে। তদুপরি এমনকি এই সব বিধানের অবসানের পরও ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিদর্শন এবং পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকবে।
এই চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য দেশগুলো, যেমন ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেন বলে আসছে যে এই চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য তারা ভবিষ্যতে ইরানের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী। সেই আলোচনা কেবল চুক্তি বহাল রেখে এবং উভয় পক্ষ তাদের করণীয় সম্পাদন করলেই সম্ভব। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণবিষয়ক যেকোনো চুক্তির ইতিহাস হচ্ছে তা কখনোই প্রথম দফায় স্থায়ী এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য স্বাক্ষরিত হয় না। এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র নিরোধ চুক্তিও ১৯৭০ সালে ২৫ বছরের জন্য বাস্তবায়ন করা হয়েছিল, ১৯৯৫ সালে তাকে স্থায়ী রূপ দেওয়া হয়। ইরানের সঙ্গে এই চুক্তিতে আছে যে ২০৩১ সালের মধ্যে ইরান চুক্তির কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে একটি যৌথ কমিশন গঠিত হবে এবং ওই কমিশন সমাধান করতে না পারলে তাহলে এই বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ হস্তক্ষেপ করবে।
ফলে ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে যা বলা হচ্ছে তা কারণ নয়, সেই সবের সমাধান চুক্তির ভেতরে এবং বাইরে ভালোভাবেই ছিল; এগুলো উপলক্ষ মাত্র। তাহলে কারণ কী? এর সবচেয়ে সহজ উত্তর হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। অর্থাৎ ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় যেহেতু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি মধ্যবর্তী নির্বাচনের বছরে তা পূরণ করে তাঁর সমর্থকদের খুশি করলেন। কিন্তু জনমত জরিপের তথ্য এই বক্তব্যকে সমর্থন করে না। গত সপ্তাহে প্রকাশিত জনমত জরিপে দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশ মার্কিন এর চুক্তি বহাল রাখার পক্ষে, এর বিরুদ্ধে মাত্র ২৬ শতাংশ। রিপাবলিকানদের মধ্যেও ৪৬ শতাংশই পক্ষে। যদিও আমি জানি যে ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকেরা ‘ট্রাম্প কথা রাখেন’ বলে এই সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করবেন, কিন্তু সেটা আমার কাছে খুব গ্রহণযোগ্য কারণ বলে মনে হয় না।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের কারণ না হলেও একটা ব্যাখ্যা হচ্ছে, তাঁর পূর্বসূরি বারাক ওবামার যেকোনো ধরনের সাফল্য তাঁর অপছন্দ। যে কারণে ওবামার হাতে করা সব ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনলেন। এটা তাঁর আচরণের একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা। তবে এই ব্যাখ্যার সঙ্গে এটা যুক্ত করা দরকার যে এ থেকে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার প্রতি ট্রাম্পের অনাস্থা আবারও প্রমাণিত হলো। ‘আমেরিকা প্রথম’ স্লোগান এখন পরিণত ‘আমেরিকা একা’তে।
এই সিদ্ধান্তের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ইসরায়েল, বিশেষ করে ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থীদের খুশি করা, তাদের অনুকূলে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিকে সাজিয়ে তোলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের সমর্থক যুদ্ধংদেহী দক্ষিণপন্থীদের যে অসামান্য প্রভাব রয়েছে, এটি তা আবারও প্রমাণ করল। কিন্তু শুধু ইসরায়েল নয়, এই সিদ্ধান্তের প্রতি সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থন প্রমাণ করে যে এর কারণ মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে মোকাবিলা করার জন্য যে অলিখিত জোট গড়ে উঠেছে, এই সিদ্ধান্ত তাদের প্রভাবেই ঘটেছে। তাদের লক্ষ্য যে এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নয়, তা বলা বাহুল্য মাত্র। গোটা অঞ্চলে বিরাজমান সংঘাতময় পরিস্থিতিকে আরও বেশি জটিল করে ইরানকে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলা, ইরানের সঙ্গে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের প্রক্সি যুদ্ধ চলছে ইয়েমেনে ও সিরিয়ায়। ইসরায়েলের ক্ষমতাসীনেরা চান যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষভাবে এই যুদ্ধে যুক্ত করে ফেলতে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রত্যাহার অন্য যেকোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের মতো নয়। এই সিদ্ধান্ত আরেকটি বড় আকারের যুদ্ধের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলল।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের আরেকটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা আছে, যাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, তা হচ্ছে, তাঁর ধারণা যে একধরনের আগ্রাসী আচরণ করলে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আরও বেশি ছাড় আদায় করতে পারেন। ট্রাম্প তাঁর বক্তৃতায় সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য আলোচনা এবং উত্তর কোরিয়ার নমনীয়তাকে ট্রাম্প সেভাবেই বিবেচনা করেন বলে তাঁর ধারণা, ইরানের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটবে। কিন্তু এই দুই দেশের ভেতরে পার্থক্য কেবল তার দুই অঞ্চলে তা নয়, দুই অঞ্চলের রাজনীতির ডাইনামিকস একেবারেই ভিন্ন। তার গতিপ্রকৃতিও ভিন্ন হতে বাধ্য। তদুপরি ইরানের সঙ্গে এই আচরণের পর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার ওপর তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে; উত্তর কোরিয়া মনেই করতে পারে যে ট্রাম্প প্রশাসন খুব নির্ভরযোগ্য নয়।
ট্রাম্পের ঘোষণায় কেবল এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের কথাই নেই, বলা হয়েছে যে অবিলম্বে ইরানের ওপর আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাগুলো আরোপ করা হবে। যে নিষেধাজ্ঞার কথা ট্রাম্প বলছেন, সেগুলো হচ্ছে তেলশিল্পের সঙ্গে যুক্ত সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞা। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা সরাসরি ইরানের ওপর প্রযুক্ত হয় না, সেগুলো প্রযুক্ত হয় যারা ইরানের তেল ব্যবসার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখবে, সেই ধরনের আন্তর্জাতিক কোম্পানি ও ব্যাংকের ওপর। কেউ যদি মার্কিনদের এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, তবে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। ট্রাম্প এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ইউরোপের বাণিজ্য সংস্থা ও ব্যাংকগুলো। যেহেতু বাকি ইউরোপের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের সঙ্গে থাকছে না, এখন তাদের সামনে প্রশ্ন দাঁড়াবে, তারা কি যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাজারের বদলে ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য করবে কি না। এই প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর আমাদের জানা নেই। কিন্তু এটি বোধগম্য যে এর প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের পর ইরানের সামনে কী কী বিকল্প আছে, সেটাও দেখার বিষয়। প্রথম বিকল্প হচ্ছে ইউরোপ, রাশিয়া ও চীন যদি এই চুক্তি বহাল রাখতে পারে এবং আগের ঐকমত্যের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমিকভাবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি পালন করে, তবে তাদের সঙ্গেই এই চুক্তি বহাল রাখা। দ্বিতীয় বিকল্প হচ্ছে, এই চুক্তি থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে অগ্রসর হওয়া। দ্বিতীয় বিকল্পের পথ সহজ নয় এবং প্রথম বিকল্পের সবটাই ইরানের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। তবে এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় যে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে ইরানের যে কট্টরপন্থীরা এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিল, তাদের অবস্থান শক্তিশালী হবে। ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানির জন্য এটা মোটেই সুসংবাদ নয়।
১০ মে ২০১৮