নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া, বাতিল প্রার্থীদের অনেকের আপিলের সাফল্য এবং বিভিন্ন দল ও জোটের আংশিক হলেও চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর এ কথা বলা যায় যে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন এক অর্থে অংশগ্রহণমূলক হবে। ২০১৪ সালের বিতর্কিত এবং একপক্ষীয় দশম জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে গত প্রায় পাঁচ বছরে নির্বাচন সম্পর্কে সব আলোচনায় বারবার বলা হয়েছে যে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। রাজনীতির বিশ্লেষক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সবার বক্তব্যের অন্যতম বিষয় ছিল, যেন ২০১৪ সালের মতো আরেকটা নির্বাচন না হয়, বিরোধী দলের উপস্থিতিহীন নির্বাচন কেউই চাননি। গত কয়েক বছরে অনেকেই বিরোধী দলগুলোর, বিশেষত বিএনপির সমালোচনা করেছেন যে ২০১৪ সালে তাঁদের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। অনেকে এমনও বলেছেন, ওই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চাইছিল বিএনপি যেন নির্বাচনে না অংশ নেয়-বিএনপি সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে তাকে বাস্তবতায় পরিণত করেছে।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছিলেন যে তিনি এবং তাঁর দল চান সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তারপরও এ বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে কারও কারও মধ্যে সংশয় ছিল। বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ এমন ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি না হলেও নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য যা করা দরকার, তা করতে সরকার আগ্রহী নয়। ফলে এমন একটি আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেবে না অথবা অংশ নিতে পারবে না। বিএনপির পক্ষ থেকে একই সঙ্গে দুই ধরনের বার্তাই দেওয়া হচ্ছিল। অক্টোবরের মাঝামাঝি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতিষ্ঠা, ফ্রন্টে বিএনপির যোগদান, বিভিন্ন ধরনের বাধাবিপত্তি ও কার্যত অসমতল মাঠ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে থাকার ব্যাপারে ফ্রন্টের অঙ্গীকার এবং অন্যান্য দল ও জোটের ইতিবাচক সিদ্ধান্তের কারণে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের পথে দেশ এগিয়েছে। দৈব-দুর্বিপাক বা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব না ঘটলে ৩০ ডিসেম্বর সব দলের অংশগ্রহণেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
পাঁচ বছর ধরে যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে, এখন তার পূর্বশর্ত পূরণ হয়েছে মাত্র। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রধান দিক হচ্ছে ভোটারদের অংশগ্রহণ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে কেবল যে দলগুলোই অনুপস্থিত ছিল তা নয়, ভোটাররাও ছিলেন অনুপস্থিত। বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের ডাক এবং নিরাপত্তার অভাব-এর কারণ ছিল দুই-ই। মোট আসনের অর্ধেকের বেশি আসনে যে ভোটারদের কেন্দ্রেই যেতে হয়নি, তা আইনের চোখে যা-ই হোক, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চয়ই নয়।
সত্যিকার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর্ব শুরু হবে আগামীকাল, কমিশনের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পরে। ভোটারদের কাছে এটা প্রতীয়মান হতে হবে যে এই নির্বাচনে তারাই সবচেয়ে বড় অংশীদার। সাজানো কোনো ঘটনা ঘটছে না। এই নির্বাচন কমিশনের আমলেই স্থানীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ সত্ত্বেও সেগুলো সাজানো খেলার অভিযোগ থেকে মুক্তি পায়নি।
ভোটারদের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে চাইলে নির্বাচনের প্রচারাভিযানের সূচনায়ই দরকার হবে ভোটারদের মনে নিরাপত্তার ব্যাপারে আস্থা তৈরি করা। বিরোধী দলের অনেক প্রার্থী প্রচারাভিযানে কতটা অংশ নিতে পারবেন, নির্বাচন কমিশনের আচরণের কারণে তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তা নির্বাপিত হবে।
ভোটাররা যদি লক্ষ করেন যে বিরোধী দলের প্রার্থীদেরই নিরাপত্তা নেই, প্রচারাভিযানের সুযোগ নেই, গণমাধ্যমের প্রচার একদেশদর্শী এবং এসব নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তাহলে তাঁদের আস্থা গড়ে উঠবে না। তাঁরা বুঝতে পারবেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা বাতুলতামাত্র। এই ধারণার জন্য ভোটারদের নির্বাচনের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার হবে না। কমিশনের কার্যকলাপ, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের আচরণ এবং প্রশাসনের পদক্ষেপই ভোটারদের মনে এ ধারণা গড়ে তুলবে। ভোটাররা ভোট দিতে না পারলে যত দলই অংশগ্রহণ করুক না কেন, সেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলে গণ্য হবে না।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত, ৯ ডিসেম্বর ২০১৮