ডিসেম্বর 3, 2025
Responsibility_

সূত্রঃ http://business.financialpost.com/2013/04/29/bangladesh-factory-collapse-loblaw/

This post has already been read 8 times!

পাঁচটি প্রতিষ্ঠান পাঁচ হাজার প্রতিষ্ঠানের কত ভাগ? আমার চেয়ে অংক যারা ভালো জানেন তাঁরা নিশ্চয় সেটা সহজেই বের করতে পারবেন। কিন্ত কোনো কোনো প্রেক্ষাপটে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানই যে পাঁচ হাজারের ভাগ্য নির্ধারন করতে পারে সেটা অংক করে বোঝানো যাবেনা। সাভারের রানা প্লাজার ভেঙ্গে পড়া পাঁচটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান এখন সেই অবস্থানে উপস্থিত হয়েছে। গত কয়েক দিনে বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া, প্রভাবশালী অনেকের টেলিফোন, ই-মেইল থেকে সে বিষয়ে আমি প্রায় নিশ্চিত যে অবস্থাটা সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে; কিন্ত বাংলাদেশের সরকার, ক্ষমতাসীন দল, সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মহলের একাংশ, বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং সরকার –সমর্থকের ফেসবুক পোস্টিং থেকে মনে হয় না তাঁরা তা বুঝতে পারছেন। একটি ভবনে অবস্থিত পাঁচটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের হাজার শ্রমিককে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে হয়েছে; মৃতের সংখ্যা এ যাবত সরকারী হিসেবে ৪১১, উদ্ধার করা হয়েছে ২৪৩৭ জনকে। কত জন নিখোঁজ তাঁর কোনো গ্রহণযোগ্য হিসাব নেই; দেশের সেনা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে এই সংখ্যা ১৪৯।

ঘটনার ভয়াবহতা নিঃসন্দেহে অকল্পনীয়, দক্ষিণ এশিয়ায় ১৯৮৪ সালের ভোপালের গ্যাস ‘দুর্ঘটনার’ পর এটাই সবচেয়ে বড় ঘটনা যেখানে এত মানুষ এতটা মর্মান্তিকভাবে প্রাণ দিয়েছেন। এ সবই সবাইকে নাড়া দিয়েছে। এসব তৈরি পোশাক যে সব দেশে রপ্তানি হয় সেখানকার ক্রেতারা এখন প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা কী করতে পারেন। সর্বত্রই প্রশ্ন হল এই ভয়াবহ ঘটনার দায় কার? যারা এই পোশাক তৈরির ব্যবসা করেন তাঁরা তো এর দায় এড়াতে পারবেন না সেটা স্পষ্ট, যে বিদেশী কোম্পানিরা কম দামে কেনার জন্যে এই খাতের ওপরে চাপ রেখেছিলেন তাঁরাও এর জন্যে দায়ী। এ সবের পাশাপাশি যে বিষয়টি এখন সারা দুনিয়ার সামনে এসে হাজির হয়েছে তাহলো রানা প্লাজাকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের শ্রমিকদের ব্যাপারে দায়িত্বহীনতা। উপুর্যুপরি দুর্ঘটনার পরেও যে কারো টনক নড়েনি সেটা অনেকের কাছেই এই সব মৃত্যুর পর বড় বিষয় হয়ে উঠেছে। বিদেশিদের অনেকের কাছেই গত কয়েক দিনে একটা প্রশ্ন শুনতে হয়েছে যে আর কত ফ্যাক্টরি আছে যা তাজরীন ফ্যাশন হতে বা রানা প্লাজা হতে অপেক্ষা করছে। অনেকে মুখ ফুটে বলেন নি, কিন্ত যারা খোঁজ খবর নিয়েছেন তাঁদের চোখেমুখে প্রশ্ন দেখছি বাংলাদেশে রাজনীতিবিদের আশ্রয়ে আর কত জন সোহেল রানা আছে, কতজন মুরাদ জং আছে, আর কত সরকারী কর্মকর্তা কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন। দেশে যারা আছেন তাঁদের জন্যে এইগুলো কোনো নতুন বিষয় নয়। বাংলাদেশের ভেতরে কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বলেন যে ‘কোথায় নাই দুর্নীতি?, যারা আজকে এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সে সব দেশে দুর্নীতি নাই? তাঁদের ওখানে দুর্ঘটনায় মানুষ মরে না?’ এ সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে অথবা না পেয়ে অনেকেই বুক ফুলিয়ে চলতে পারেন কিন্ত তাতে করে এখনকার অবস্থার হেরফের হবেনা।

দায়িত্বহীনতার উদাহরণ বলে যেগুলো দেশের বাইরে বারবার প্রশ্নের আকারে হাজির হচ্ছে তা অনেক; দুটোর কথা উল্লেখ করিঃ প্রথমত ভবনের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মচারিদের ব্যাপারে যদি সতর্কতা অবলম্বন করা যায় তবে গার্মেন্টসের ব্যাপারে নেয়া হল না কেন? দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘের একটি প্রতিষ্ঠানের সাহায্যের প্রস্তাব বাংলাদেশ কেন প্রত্যাখান করলো? মনে রাখা দরকার যে এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য বাংলাদেশও। যারা এই বলে যুক্তি দিচ্ছেন যে বিদেশিরা কেবল ‘পরামর্শের’ প্রস্তাব দিয়েছিল তাঁরা খোঁজ নিলে দেখতেন তাঁদের কথাটা সত্য নয়। যারা বলছেন বিদেশিরা এলে বরং উদ্ধার কাজ ব্যাহত হত তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন যে বিদেশিরা ঢাকায় উপস্থিত হবার পরও সরকার চাইলে তাঁদের বলতে পারতো যে তাঁদের কাজে নিয়োজিত করার দরকার নেই।  সরকার আর কী কী করতে পারতো তাঁর তালিকা দীর্ঘ, কী কী বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সাহায্য চাওয়া যেতো তাঁর তালিকাও ছোট নয়। এরমধ্যে যারা বিদেশিদের এক হাত দেখিয়ে দেয়ার গৌরব দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা কি বিস্মৃত হয়েছেন যে এই শিল্প খাতটি বিদেশ-নির্ভর? রফতানি-নির্ভর একটা খাতে বিদেশিদের দেখিয়ে দেবো বলে আত্মপ্রসাদ পাওয়া যায়; কিন্ত তাঁর পরিণতি ভালো হবার সম্ভাবনা খুব আছে বলে মনে হয়না।

দেশের বাইরে এই প্রত্যাখানকে সরকারিভাবে কিভাবে দেখা হচ্ছে সেটা আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কর্মপরিবেশের উন্নয়নে উত্সাহ জোগাতে ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা ভাবছে বলে যে খবর বেরিয়েছে তাঁর মর্মার্থ বাংলাদেশের যাতে বুঝতে অসুবিধা না হয় তাঁর জন্যে এটাও  বলা হয়েছে যে এই ‘যথাযথ ব্যবস্থা’র আওতায় ইইউ’র বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত কোটা-সুবিধার বিষয়ও বিবেচনা করা হবে’। কিন্ত সরকারী প্রতিক্রিয়ার বাইরে সাধারণ লোকজন, নীতি-নির্ধারকদের কেউ কেউ যে বলছেন যেখানে শ্রমিকদের যে কেবল ন্যূনতম গুরুত্ব দেয়া হয়না তাই নয় তাঁদের মৃত্যুর পরও তাঁদের বিষয় গুরুত্বহীন সেখানকার পণ্য আনার দরকার কি? মনে রাখা দরকার, অমানবিক মৃত্যুর দায় কেউই নিতে চান না – নৈতিকতার বিবেচনায় এবং নিজের বিবেকের তাড়নায়।

গত কিছু দিন ধরে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাত একটা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো। অনেকের জানা আছে যে গত ২৮ মার্চ মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের (ইউএসটিআর) উপকমিটিতে প্রায় দুই ঘণ্টার শুনানি হয়েছিল বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বিষয়ে। শুনানির বিষয়ে ভালো করে জানেন এমন একজন ব্যক্তি ঐ শুনানির পরে আমাকে বলেছিলেন যে বাংলাদেশের দেয়া উত্তর ‘সন্তোষজনক ছিলনা’। দেশের শ্রমমান নিয়ে, বিশেষত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমমান নিয়ে  যুক্তরাষ্ট্র আরো ১৯টি প্রশ্নের জবাব চেয়েছিল এবং ২৭ এপ্রিলের মধ্যে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অঙ্গীকারও চেয়েছিল। বাংলাদেশ সেগুলো পাঠিয়েছে বলেই জানি। এ বিষয়ে ইউএসটিআর-এর সিদ্ধান্ত হবে এ মাসের শেষে। এই যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটলো এবং তাঁর পরে যে দায়িত্বহীনতা প্রদর্শিত হল তাঁর প্রভাব একেবারেই পড়বে না তা মনে করার কোন কারণে নেই।

উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নিখোঁজের সংখ্যা ঘোষণার পরই আমার কাছে একজন জানতে চেয়েছেন এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য। এখন মনে হয় বিদেশিদের উদ্বেগের তালিকায় আরেকটা বিষয় যুক্ত হল।

দেশে এত বড় একটা খাত, যেখানে ফ্যাক্টরির সংখ্যা পাঁচ হাজার, কেবল যে খারাপ প্রতিষ্ঠানই আছে তা নয়; সেটা হতেই পারেনা। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান নিশ্চয় তাঁদের দায়িত্ব বোঝেন এবং শ্রম মান বজায় রাখেন; কিন্ত সামগ্রিকভাবে এই নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে তাঁর কারণ আমরা জানি। ব্যতিক্রম দিয়ে সর্বব্যাপ্ত একটা অন্যায্য পরিস্থিতিকে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। কিন্ত তাঁর জন্যে দরকার দায়িত্ব গ্রহণ করা, অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করা, সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া, এবং সকলের সাহায্য নেয়া। তাঁর লক্ষণ দেখতে পাচ্ছিনা, বরং কী করে দায়সারা ভাবে আপাতত ‘ম্যানেজ’ করা যাবে তাই নিয়েই সংশ্লিষ্টদের মাথাব্যথা।

This post has already been read 8 times!

মন্তব্য করুন