যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কি কখনোই এ কথা বলেছিলেন যে সিরিয়ার সরকারের জন্য এটা হলো ‘রেড লাইন’ এবং এই লাইন অতিক্রম করলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ? সাম্প্রতিক কালের মন্তব্যগুলো বাদ দিলে, এই মাস খানেক আগে পর্যন্ত তাঁর বক্তব্য ছিল অস্পষ্ট। রাসায়নিক অস্ত্র এবং সিরিয়ার সরকারের প্রসঙ্গটি প্রথমবারের মতো উল্লেখিত হয়েছিল ২০ আগস্ট ২০১২ সালে হোয়াইট হাউসের এক সংবাদ সম্মেলনে। ওবামা তখন বলেছিলেন যে ‘আমরা আসাদ সরকারের কাছে এবং আর যাঁরা যাঁরা মাঠে আছেন, তাঁদেরও এটা স্পষ্ট করে বলেছি যে আমাদের জন্য রেড লাইন হলো যখন আমরা দেখব যে কিছু রাসায়নিক অস্ত্র নাড়াচাড়া করা হচ্ছে অথবা ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট সে সময়ে ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করার জন্য কোনো রকম পরিণতির কথা বলেননি কিংবা বলেননি যে এ ধরনের কিছু ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করবে। তিনি বলেছিলেন, এই রকম হলে সেটা আমার হিসাব বদলে দেবে; ওবামার ভাষায়, ‘দ্যাট উড চেঞ্জ মাই ক্যালকুলাস, দ্যাট উড চেঞ্জ মাই ইকুয়েশন’।
কিন্তু গণমাধ্যম এবং সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের কাছে সেটাই হয়ে দাঁড়াল ওবামার দেওয়া ‘রেড লাইন’।
নিঃসন্দেহে প্রেসিডেন্ট ওবামা সেই সময় বাশার আল-আসাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে চাইছিলেন কিন্তু বাশার আল-আসাদ ওবামার এই চাপকে ‘ধাপ্পা’ বলে মনে করেছেন এবং তা ধরে ফেলেছেন বলেই মনে করেছেন। কিন্তু সেখান থেকে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই জটিল হয়ে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা নিজে বলুন অথবা না বলুন, রেড লাইনের আলটিমেটামকে এখন তাঁর নিজের বলেই মেনে নিতে হয়েছে, সেই পথেই অবস্থা এগোচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট ওবামা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করেই বলেছেন যে তিনি সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে জন্য তিনি কংগ্রেসের অনুমোদন চেয়েছেন। কংগ্রেস বসবে ৯ সেপ্টেম্বর। তারপরে বিভিন্ন কমিটির শুনানির পর এ বিষয়ে ভোট হবে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সিরিয়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার অনুমোদন না দেওয়ার পর কংগ্রেসের কাছে অনুমোদন চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অনেকের ধারণা যে প্রেসিডেন্ট সম্ভবত এ কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওবামার রাজনৈতিক উপদেষ্টারাও খানিকটা বিস্মিত যে প্রেসিডেন্ট গোড়াতে এ রকম মনোভাব না দেখালেও এখন সেই পথেই হাঁটলেন। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কংগ্রেসের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা প্রেসিডেন্টের আছে কি না, এই নিয়ে ভিন্নমত আছে; কিন্তু এ কথাই সত্য যে এর আগে পাঁচটি সামরিক অভিযানের জন্য প্রেসিডেন্টরা—রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট—কংগ্রেসের অনুমোদন নেননি। এর অধিকাংশই হলো যুক্তরাষ্ট্রের একক সামরিক অভিযান। কিন্তু ওবামা অতীতে এককভাবে সেনা অভিযানের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়ে এসেছেন। সিনেটর এবং প্রেসিডেন্ট প্রার্থী থাকা অবস্থায় জাতিসংঘের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো ধরনের সেনা অভিযানের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। এ অবস্থানই লিবিয়ায় ২০১১ সালের সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে গাইডলাইন হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু এখন সিরিয়ার ব্যাপারে সে রকম আন্তর্জাতিক সমর্থনের আশা খুবই কম; যদিও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত বদলাবে না এমন মনে করার কারণ নেই। জাতিসংঘের পরিদর্শকদের রিপোর্টের পর আবারও ভোট হবে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটা যুদ্ধের ব্যাপারে, যা কারোরই উৎসাহ নেই, তা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই।
যুক্তরাষ্ট্র এবং সারা দুনিয়াজুড়েই যেকোনো ধরনের সামরিক অভিযান নিয়ে আছে অস্বস্তি। ইরাকযুদ্ধের দীর্ঘ ছায়া এখন সর্বত্র। ইরাকযুদ্ধের আগে যুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে মিথ্যা ও ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল, সে স্মৃতি কেউই ভুলে যাননি। আবারও কি সেই ঘটনাই ঘটছে? এ প্রশ্নও সবার মনেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সব ধরনের নিশ্চয়তা সত্ত্বেও অনেকেই, সম্ভবত বেশির ভাগ মানুষই এখনো সন্তুষ্ট নন। তাঁদের সন্তুষ্ট করা খুব সহজ হবে না।
‘আসন্ন যুদ্ধের’ আইনগত দিক নিয়ে গণমাধ্যম এবং অন্যত্র আলোচনা হচ্ছে। যাঁরা এই যুদ্ধের যৌক্তিকতা খোঁজার চেষ্টা করছেন, তাঁরা ১৯৯৯ সালের কসোভোযুদ্ধের উদাহরণ দিচ্ছেন। একজন ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনজীবী এবং লেখক জেওফ্রি রবার্টসন (যাঁর একটি বইয়ের নাম, ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউমিনিটি এ স্ট্রাগল ফর গ্লোবাল জাস্টিস) বলছেন যে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ থেকে কাউকে নিরস্ত করতে, তা বন্ধ করতে বা তার জন্য কাউকে শাস্তি দিতে কখনোই নিরাপত্তা কাউন্সিলের অনুমোদনসূচক প্রস্তাবের দরকার হয়নি। অন্যরা ‘আর২পি’ বলে পরিচিত জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি ব্যবস্থার কথা বলছে যে বিষয়ে একটি দলিলে সব সরকার সম্মতি দিয়েছে। ২০০৫ সালে ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট’ (সুরক্ষার দায়িত্ব) নামের এই ডকুমেন্ট কোনো আইনি ব্যবস্থা নয়, একে বলা হয় আদর্শ। যাতে চার ধরনের অপরাধের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে, তা হলো—গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং ‘এথনিক ক্লিন্সিং’ বা জাতিগত নির্মূলকরণ। এগুলোকে একত্রে বলা হয়েছে মাস এট্রোসিটি ক্রাইম বা ব্যাপক নৃশংস অপরাধ। মোট কথায় এসব পরিস্থিতি থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা সব রাষ্ট্রের দায়িত্ব; কিন্তু রাষ্ট্র তাতে ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক সমাজ তা নীরবে দেখতে পারে না, তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যাঁরা আর২পির কথা বলছেন, তাঁদের যুক্তি হলো যদি সিরিয়ার সরকার তার নিজের জনগণের ওপর ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে থাকে, তবে তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রসমূহের দায়িত্ব হচ্ছে সুস্পষ্ট আইনের বিধান না থাকলেও সুরক্ষার দায়িত্ব, যা জাতিসংঘের সদস্যরা অনুমোদন করেছেন, তার আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া। দারফুরে জাতিসংঘের মিশনের কথা তাঁরা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করছেন।
কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ‘আর২পি’ করা হয়েছিল কি না, তা নিয়ে অনেকের মনেই রয়েছে সংশয়। পল হাইনবেকার, জাতিসংঘে কানাডার দূত হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ২০০০-এর প্রথম দশকের গোড়ায় এই ধারণার প্রবক্তা এবং উদ্যোক্তাদের একজন। সম্প্রতি গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘আর২পি’র ভিত্তিতে একটি কোয়ালিশন যদি ব্যবস্থা নেয়, তবে সেটা অনেকের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটাতে পারে, এমনকি তা যদি নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াও হয়। হাইনবেকার মনে করেন না যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনের কোনো সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তাঁর ধারণা, যদি যুক্তরাষ্ট্র সময় নিয়ে হলেও কোনো রকম কোয়ালিশন তৈরি না করে ব্যবস্থা নেয়, তবে তা ভুল হবে।
আমাদের অবশ্য এটা ভুলে যাওয়ার উপায় নেই যে জাতিসংঘের আদর্শের অনুসারে, আর২পি কেবল তখনই ব্যবহার করা যাবে, যখন যে হুমকির বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, ব্যবহূত শক্তিকে হতে হবে তার আনুপাতিক; যেন তার ওই হুমকির বিরুদ্ধে সাফল্যের সম্ভাবনা থাকে এবং যেন তার ভালোর চেয়ে খারাপ করার আশঙ্কা না থাকে। সিরিয়ার ক্ষেত্রে কেউই খারাপের চেয়ে ভালোর গ্যারান্টি দিতে পারবেন না। গৃহযুদ্ধের গোড়াতে এই যুক্তি যতটা গ্রহণযোগ্য হতো, আজকে তা ততটা হবে মনে হয় না। অন্য যেসব আইনি ব্যবস্থার কথা ভাবা হচ্ছে, তার মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ থেকে প্রস্তাব পাস করানো। কোরিয়াযুদ্ধের সময়ে এই ব্যবস্থার মাধ্যমেই জাতিসংঘ যুদ্ধে যুক্ত হয়। অনেকে বলছেন, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের ১৯২৫ সালের জেনেভা প্রটোকলের বরখেলাপের জন্য সিরিয়াকে অভিযুক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু এই চুক্তি যারা আগে বরখেলাপ করেছে, তাদের বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে? তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জ্ঞাতসারে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ইতিহাস সবার জানা।
আইনের বিষয় নিরসন হোক অথবা না হোক, আসন্ন যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে যে বহুবিধ অনিশ্চয়তা রয়েছে, তা এমনকি সরকারি মহলেও বলা হচ্ছে। যদিও সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন যে সীমিত, সংক্ষিপ্ত এবং সুনির্দিষ্ট আক্রমণ চালানো হবে। কিন্তু এই সীমিত আক্রমণের লক্ষ্য কী হবে? এ বিষয়ে কেউই, এমনকি প্রেসিডেন্ট নিজেও কিছু বলেননি। আসাদকে যদি কোনো রকম বার্তা পাঠানোই লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে আসাদ যে তার উল্টোটাই বুঝবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? ওবামা বলেছেন, এটা কেবল আসাদের জন্য নয়, যুক্তরাষ্ট্র দেখাতে চায় যে সে যা বলে তা করে। যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা যে হুমকি দেওয়ার পরে এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে অন্যরাও এটা অনুসরণ করবে। সম্ভবত এই বিষয়ে তারা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র পরিকল্পনা নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই হামলা চালালে সিরিয়া কীভাবে তার জবাব দেবে? সংঘাত শুরু হওয়ার পর তা কি রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্র-বহির্ভূত শক্তি বা নন-স্টেট অ্যাক্টরদের হাতে ছড়িয়ে পড়বে? কসোভো হামলার সময় রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া খুব বেশি শক্ত ছিল না বলে এবারও তা-ই হবে এমন মনে করার পেছনে যুক্তি কম। রাশিয়ায় সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবনতিশীল সম্পর্কের কথাও মাথায় রাখতে হবে। তার অর্থ কি এই যে এই যুদ্ধ সীমিত আকারে শুরু হলেও তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে? এসব কারণেই এই যুদ্ধ নিয়ে শঙ্কা বেশি।
কিন্তু পাশাপাশি এ কথা আমরা ভুলব কী করে যে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সিরিয়ার সাধারণ মানুষের প্রশ্ন। দুই বছর ধরে তাঁরা লড়াই করছেন, কমপক্ষে এক লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এখন তাঁদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে রাসায়নিক অস্ত্রের। গত বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক সমাজ তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। এখন যদি তাঁরা প্রশ্ন করেন যে শয়ে শয়ে শিশুর মৃত্যুর পরও কেন আন্তর্জাতিক সমাজ তাঁদের পাশে দাঁড়াল না, তার জবাব কে দেবে? যুক্তরাষ্ট্রের একক ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে আমরা যেমন তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি, তেমনি সিরিয়ার মানুষের ওই প্রশ্নের জবাব দাবি করাও আমাদের দায়িত্ব।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত