This post has already been read 14 times!
তৃতীয় পর্ব
বর্ণমালা উদ্ভাবন
‘স্লাভ-কুলে সিরিল ও মেথোডিয়াস’ (প্রথমাংশ)
বাইজেন্টাইন বা বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্যের রাজধানী প্রবলপ্রতাপান্বিত ও দুর্ধর্ষ কন্সটান্টিনোপল প্রথমে রোমের উত্তরসূরি এবং তার পর তার গৌরবের উত্তরাধিকারী ও শেষে খ্রিস্টসমাজ এবং সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে দেখা দিল। নিজেদের ‘অসভ্য বা বর্বর’ চালচলন বদলাতে ইচ্ছুক জাতিগুলো এবার কন্সটান্টিনোপলমুখী হলো।
নবম শতক পর্যন্ত প্রাচীন সভ্যতার প্রধান কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে স্লাভদের কোনো যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। ৮৬২ খ্রিস্টাব্দে একটি অপ্রত্যাশিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রভাবসঞ্চারী ঘটনা ঘটল: স্লাভ রাজ্য গ্রেট মোরাভিয়ার খ্রিস্টান শাসক রাস্টিস্লাভ বাইজেন্টীয় সম্রাট তৃতীয় মাইকেলকে বললেন, তিনি যেন কিছু খ্রিস্টান মিশনারি পাঠান, যাঁরা তাঁর জনগণকে স্লাভিক ভাষায় শিক্ষাদান করবেন এবং তাদের মধ্যে খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাস প্রচার করবেন (উল্লেখ্য, নবম শতকে সুবিশাল মোরাভীয় সাম্রাজ্য দালমেশিয়া থেকে পোল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অধুনা চেক রিপাবলিকের পূর্বে অবস্থিত একটি অঞ্চল মোরাভিয়া নামে পরিচিত)। মোরাভিয়ার ফ্র্যাঙ্কিশ যাজকরা লাতিন ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, যদিও জনসাধারণ সে ভাষা বুঝত না। এদিকে রাজপুত্র ইচ্ছে প্রকাশ করলেন গ্রিক, রোমক আর গথদের মতো তাঁর জনগণও পবিত্র বা ধর্মগ্রন্থগুলো তাদের নিজেদের ভাষাতেই অনূদিত অবস্থায় পাক। তাঁর এই ধর্মীয় বাসনার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল: ধর্মীয় মুক্তির মাধ্যমে ফ্র্যাঙ্কিশ সাম্রাজ্যের হাত থেকে স্লাভদের রাজনৈতিক মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন এই মোরাভীয় রাজপুত্র। স্পষ্ট করে বললে, রাস্টিস্লাভ জার্মান যাজকদের শিক্ষকতার হাত থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিলেন। এই যাজকরা শিক্ষা-দীক্ষার চাইতে কর্তৃত্ব আর মোরাভিয়ার নানা ব্যাপারে হস্তক্ষেপেই বেশি আগ্রহী ছিল।
তো এ কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কাজটি সম্পাদনের জন্য সম্রাট মাইকেল ও কন্সটান্টিনোপলের প্যাট্রিয়ার্ক ফোটিয়াসের কাছে সবচেয়ে যোগ্য ছিলেন সিরিল (আনুমানিক ৮২৭-৬৯ খ্রিস্টাব্দ) ও মেথোডিয়াস (আনুমানিক ৮২৫-৮৫ খ্রিস্টাব্দ) ভ্রাতৃদ্বয়। (প্যাট্রিয়ার্ক ফোটিয়াসের কাজ সম্পর্কে অষ্টম অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে বলা হবে; এবং বিভিন্ন স্লাভ, লাতিন ও গ্রিক কিংবদন্তিই সিরিল ও মেথোডিয়াসের জীবনীর প্রধান সূত্র। এসব কিংবদন্তির কোনোটিই সমস্যা বিরহিত নয়, আবার কোনোটিই সর্বজনগ্রাহ্য নয়। বেশির ভাগ পণ্ডিতই মনে করেন দুটো স্লাভ বা তথাকথিত প্যানোনীয় কিংবদন্তি— Vita Cyrilli এবং Vita Methodii— যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্বাসযোগ্য। এছাড়া একটি হ্রস্বতর লাতিন কিংবদন্তি— তথাকথিত Translatio S. Clementis— এসব কিংবদন্তির কিছু কিছু সত্য বলে সমর্থন করে। এছাড়া আছে বিভিন্ন পোপের উক্তি এবং ভ্যাটিকানের অন্যান্য নথিপত্র)। মেসিডোনিয়ার থেসালোনিকির স্থানীয় অধিবাসী এই দুই ভাই গ্রিকভাষী ছিলেন; এছাড়া সে অঞ্চলে প্রচলিত স্লাাভিক উপভাষাতেও চমত্কার দখল ছিল তাঁদের। মেথোডিয়াস মেসিডোনিয়ার একটি স্লাভিক প্রদেশের প্রধান সেনাপতি ছিলেন এবং ৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ও তাঁর ভাই ভলগা নদীর নিম্নাঞ্চলের খাজারদের (Khazars) মধ্যে একটি কূটনৈতিক মিশনে অংশ নিয়েছিলেন। সিরিল (যাঁর আসল নাম কন্সটান্টিন) ছিলেন কন্সটান্টিনোপলের সবচেয়ে বিখ্যাত পণ্ডিতদের অন্যতম। রাজদরবারে যথেষ্ট সমাদর ছিল তাঁর এবং একটি উন্নত মানসগঠনের অধিকারী ছিলেন তিনি। সে যুগের সবচেয়ে বড় মানবতাবাদী হিসেবে পরিচিত ফোটিয়াসসহ অন্য বিখ্যাত পণ্ডিতদের কঠোর তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভ করেছিলেন সিরিল। ডায়ালেক্টিক্সে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী দার্শনিক সিরিল ভাষার ব্যাপারেও ছিলেন দুর্দান্ত প্রতিভাসম্পন্ন; ভাষাতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্ব ছিল তাঁর বিশেষ আগ্রহের বিষয়। খাজারদের সঙ্গে থাকাকালীন বলা হয়ে থাকে, তিনি খুব দ্রুত হিব্রু, আরবি ও খাজার, যা কিনা একটি তুর্কি ভাষা, শিখে নিয়েছিলেন। আর সেখানেই তিনি গথিক সালটার (psalter, উপাসনায় ব্যবহূত বাইবেলের অন্তর্গত প্রার্থনা সংগীত) এবং উলফিলা অনূদিত গসপেল বা সুসমাচার আবিষ্কার করেন, এবং তা একজন স্থানীয় অধিবাসীর সহায়তায় বুঝে নেয়ার ব্যবস্থা করেন।
সিরিল ও মেথোডিয়াসের জীবনী অনুযায়ী, যে জীবনী লেখার কৃতিত্ব তাঁদের সঙ্গী ও শিষ্য ওহরিডের ক্লেমেন্টেকে দেয়া হয়ে থাকে এবং যাঁর সম্পর্কে পরে আরো কথা বলা হবে, সিরিল প্রথমেই জানতে চেয়েছিলেন মোরাভীয়দের কোনো লিখনরীতি আছে কিনা। তিনি বলেছিলেন, তা যদি না থাকে, তাহলে সেটা তো ‘জলের ওপর লেখার’ চেষ্টারই নামান্তর হবে এবং নিশ্চিতভাবেই তিনি একজন হেরেটিক বা ধর্মদ্রোহী বলে প্রতিপন্ন হবেন। তাঁকে বলা হলো, তিনি যদি এই লিখনরীতি আবিষ্কার করেন সেক্ষেত্রে সর্বশক্তিমান তাঁকে সাহায্য করবেন; কারণ ‘যারা ভক্তি ও বিশ্বাসভরে তাঁর কাছে কিছু প্রার্থনা করে, তিনি তাদের ফেরান না এবং যারা তাঁর দরজায় টোকা দেয়, তাদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করে দেন।’
কিন্তু সিরিল এমন একটা প্রশ্ন কেন করলেন? তাঁর জীবনীকার বা সন্তজীবনীকার (hagiographer) কেন এমন ইঙ্গিত করলেন যে, স্লাভদের জন্য বর্ণমালা আবিষ্কার ঈশ্বরের জন্য নিবেদিত কাজ? সে সময়, ‘সভ্য’ হওয়ার উচ্চাশা পোষণকারী যেকোনো জাতির প্রথম কাজ ছিল সেটার নিজস্ব লিখন পদ্ধতি বা ব্যবস্থা তৈরি করা। গথ এবং আর্মেনীয়রা এ ব্যাপারটির দুই ধ্রুপদী উদাহরণ। রোমক যাজকরা অবশ্য বিশ্বাস করতেন যে কেবল হিব্রু, গ্রিক আর লাতিনই প্রার্থনার সময় ব্যবহার করা যেতে পারে। সে সময়ের ভার্নাকুলার বা দেশজ ভাষা প্রাচীন স্লাভোনিকে পবিত্র টেক্সটগুলো অনুবাদ করে সিরিল হেরেটিক বা ধর্মদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত হতে চাননি, তাই তিনি সম্রাট ও প্যাট্রিয়াকের সুরক্ষা চাইলেন এবং এক পর্যায়ে তাঁর কাজটির জন্য অনুমোদন লাভ করলেন (থেসালোনিকি অঞ্চলের প্রাচীন স্লাভিক উপভাষার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রাচীন চার্চ স্লাভোনিক বা প্রাচীন চার্চ স্লাভিকই আদি সাহিত্যিক স্লাভিক ভাষা। এ ভাষাটিই পরবর্তী চার্চ স্লাভোনিক ঐতিহ্য বা প্রথার ভিত্তি ছিল, প্রার্থনার সময় ব্যবহূত একটি ভাষা হিসেবে যা এখনো কিছু কিছু প্রাচ্যদেশীয় অর্থোডক্স এবং প্রাচ্যদেশীয় ক্যাথলিক গির্জায় ব্যবহার হয়ে থাকে)। তাঁর জীবনীকার তাঁকে এমনকি ঐশী অনুমোদনের ব্যবস্থা করে দিলেন: যেহেতু ঈশ্বর নিজেই সিরিলের কাছে স্লাভিক বর্ণমালা উন্মোচিত করেছেন, তাই তাঁকে ধর্মদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় না। লিখন এবং অনুবাদের ইতিহাসে যে এই প্রথমবারের মতো কোনো নতুন লিখনরীতিতে ঐশী উত্স আরোপ করা হলো তা নয়। সুমেরীয়, মিসরীয় ও চীনারা সবাই লেখাকে দেবতাদের উপহার বলে গণ্য করেছে। কিন্তু স্লাভিক ভাষার জন্য একটি লিখনরীতি উদ্ভাবন করার জন্য সিরিলকে আহ্বান জানানোর পেছনে সম্রাটের রাজনৈতিক বিবেচনাও কাজ করেছিল: ‘স্লাভিক জগতে কোনো তাত্পর্যপূর্ণ আগ্রাসন চালানোর আগে বাইজেন্টিয়াম এবং বাইজেন্টীয় চার্চকে স্লাভদের জন্য এমন একটি লিখনরীতি প্রদান করতে হবে, যা তাদের ভাষার সঙ্গে নিখুঁতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’ ৮৬২ খ্রিস্টাব্দে সিরিল যখন অনুবাদক, মিশনারি ও কূটনীতিক হিসেবে তাঁর কাজ সম্পন্ন করার জন্য একটি নতুন বর্ণমালা তৈরি শুরু করলেন, তখন রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় আবহ এমনই ছিল।
বলা হয়ে থাকে, সিরিল তথাকথিত ‘গ্লাগলিটিক’ (Glagolitic) বর্ণমালাও উদ্ভাবন করেছিলেন, যা এসেছে glagol থেকে প্রাচীন স্লাভোনিক ভাষায় যার মানে ‘উচ্চারণ’ বা ‘শব্দ’। গ্লাগলিটিক বর্ণমালার প্রকৃত উত্স অজ্ঞাত, কিন্তু এটা ধারণা করা হয় যে, এ লিখনরীতিটি স্লাভোনিকের মেসিডীয়-বালগেরীয় উপভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তা গঠিত হয়েছে গ্রিক ছোট হাতের অক্ষর বা নবম শতকের ছোট হাতের অক্ষরের গ্রিক টানা লেখার (cursive) নমুনার ওপর ভিত্তি করে; সেসঙ্গে কিছু লাতিন ও হিব্রু (বা, সামারিটান) চিহ্ন বা সেই সব চিহ্নের ওপর ভিত্তি করেও যেগুলো হয়তো সিরিল অ-গ্রিক ধ্বনি বোঝাতে ব্যবহার করে থাকবেন। আদি বর্ণমালাটির অক্ষরের সংখ্যা সঠিকভাবে জানা যায় না, তবে ধারণা করা হয় সেটি চল্লিশের কাছাকাছি হবে। আর এ বিষয়টি পরিষ্কার নয় যে, কেন এ লিখনরীতিটি একটি দক্ষিণ স্লাভোনিক উপভাষাকে ভিত্তি করে গঠিত হলো, যেখানে দক্ষিণ স্লাভোনিয়ার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অঞ্চল এবং ভাষার জন্য এটি তৈরি করার কথা ভাবা হচ্ছিল; তবে সেটার পক্ষে এ যুক্তিও দেখানো হয়েছে যে, নবম শতকে স্লাভোনিক ভাষাগুলো একটি আরেকটির আরো বেশি কাছাকাছি ছিল, আর তার ফলে নোটেশন বা ধ্বনিলিপির রীতিটি সেই ভাষাগোষ্ঠীর (linguistic group) সব সদস্যই আরো সহজে পরিগ্রহণ করতে পারত। (ক্রমশ)
পর্ব ২ পড়ুন এখানেঃ মেসরপ মাশতত্স ও আর্মেনীয় সংস্কৃতির বিকাশ
পর্ব ১ পড়ুন এখানেঃ ‘অনুবাদকবৃন্দ এবং বর্ণমালা আবিষ্কার’
This post has already been read 14 times!