March 19, 2024

হেফাজতে ইসলামের আধাত্মিক এবং সাংগঠনিক নেতা আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন আল হাইয়াতুল উলা লিল জামিয়াতুল কওমিয়ার পক্ষ থেকে আয়োজিত শোকরানা মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা’র উপস্থিতি ও সংবর্ধনা গ্রহণ বিষয়ে গণমাধ্যমে এবং সামাজিক মাধ্যমে যে আলোচনা চলছে তাতে অনেকেই বেদনা, ক্ষোভ এবং আশাহত মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এই মনোভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং সেক্যুলার বলে দাবিদারদের এক বিরাট অংশ আছেন; আবার এই সব বিষয়ে সরব বলে পরিচিত অনেকেই এক ধরণের নিরবতা পালন করছেন। এদের এই সব ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সুর ক্ষেত্রবিশেষে হাহাকারের মতোই শোনাচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন লেখক-সাংবাদিকের বর্ননায় রোববার (৪ নভেম্বর ২০১৮) যা ঘটেছে তা হল, “শোকরানা মাহফিলে’ যোগ দিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ঝাণ্ডাবাহী, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কাণ্ডারী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা” (স্বকৃত নোমান, অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, লাইমলাইট, ৪ নভেম্বর ২০১৮)। এই ধরণের মনোভাবের প্রকাশ আরো আছে। ইতিমধ্যে বিবিসি বাংলা’র পক্ষ থেকে এই বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদন অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে যেখানে এই মতাবলম্বীদের ভাষ্য রয়েছে এবং এর মধ্যে একজন সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষকের বিশ্লেষণও রয়েছে। ‘কেন এমন হল’ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টার প্রেক্ষাপটে চারটি প্রসঙ্গ উত্থাপনের তাগিদ অনুভব করেছি।

আওয়ামী লীগের আদর্শিক রূপান্তর
যারা হেফাজত-আওয়ামী লীগের সখ্য নিয়ে ব্যথিত বা ক্ষুব্ধ তাঁদের বক্তব্য এবং প্রতিক্রিয়া থেকে এমন ধারনাই জন্মায় যে ঘটনাটি যেন অকস্মাৎ ঘটেছে এবং তাঁরা এই রকম কিছু এমনকি অনুমানও করতে পারছিলেন না। এই ধরণের বিস্ময়ের কারনেই প্রশ্ন করা দরকার হচ্ছে তাঁরা কী আদৌ বাংলাদেশের রাজনীতির ওপরে ঘণিষ্ঠভাবে নজর রাখছিলেন নাকি ঘটমান বিষয়ে তাঁরা স্বেচ্ছায় বিস্মৃত হওয়াকেই সঠিক বলে মনে করেছেন? স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিকে জাগ্রত করলেই এটা স্পষ্ট হয় যে, ধর্ম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, বিশেষত তুলনামূলক রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের বিষয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের অবস্থান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দলের নীতি নির্ধারকদের ২০১৪ সাল থেকেই দেয়া বক্তব্যেই আছে। ২০১৪ সালের ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, ‘মদিনা সনদ ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণের নির্দেশনা অনুসারে দেশ পরিচালনা করা হবে। এই সরকার পবিত্র কোরআন এবং সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করবে না’ (প্রথম আলো, ২২ মার্চ, ২০১৪)। প্রধানমন্ত্রীর প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়, ২০১৫ সালের মে মাসে জানান যে, নিহত ব্লগার এবং এথিস্ট বলে পরিচিত অভিজিৎ রায়ের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা সম্ভব নয় (ঢাকা ট্রিবিঊন, ১১ মে ২০১৫)। ঐ বছরের ৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী বলেন যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত তাঁর সরকার সহ্য করবেন না (ডেইলি স্টার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। এর পরের ঘটনাবলীর অন্যতম হচ্ছে কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি (২০১৭), হেফাজতের অনুরোধে নির্বাহী আদেশে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন (২০১৭), সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণ (২০১৭)। কিন্ত আপনি যদি আরেকটু পেছনে যান তবে আপনার মনে পড়বে ২০০৬ সালে খেলাফত মজলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ৫ দফা চুক্তির প্রসঙ্গ। এই পাঁচ দফা পরবর্তীতে ভিন্নভাবে হেফাজতের ১৩ দফার মধ্যেও সন্নিবেশিত হয়েছে। এই চুক্তিতে ছিলো – ১. পবিত্র কুরআন সুন্নাহ ও শরিয়ত বিরোধী কোন আইন প্রণয়ন করা হবে না। ২. কওমী মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। ৩. নিম্নবর্ণিত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা হবে – ক. হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী; খ. সনদ প্রাপ্ত হক্কানী আলেমগণ ফতোয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। সনদ বিহীন কোন ব্যক্তি ফতোয়া প্রদান করতে পারবে না; গ. নবী-রাসুল ও সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা ও কুৎসা রটনা করা দণ্ডনীয় অপরাধ।’

আপনি যদি আরো পেছনে যান তবে দেখবেন যে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর থেকেই আওয়ামী লীগ ইসলামের প্রসঙ্গটি তাঁদের দলীয় প্রচারণায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। যেমন ১৯৯০ সালের নির্বাচনের পোস্টারে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানুর রহিম’ বা ‘আল্লাহু আকবর’ লেখা হতো না, কিন্ত ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পোস্টারে তা কেন্দ্রিয়ভাবেই যুক্ত করা হয়। এগুলো আওয়ামী লীগের আদর্শিক অবস্থানের প্রমাণ। যে কোনো রাজনৈতিক দলেরই আদর্শিক পরিবর্তন ঘটতে পারে ও ঘটে, আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগে পরিবর্তনের ইতিহাস সুবিদিত।

কেন এই পরিবর্তন তা অবশ্যই বিশ্লেষণ দাবি করে; ১৯৯১-২০০৪ সালের পরিবর্তন বিষয়ে আমার ব্যাখ্যা আমি তুলে ধরেছি আমার গ্রন্থ, গড উইলিং – দ্য পলিটিক্স অব ইসলামইজম ইন বাংলোদেশ, (২০০৪, পৃষ্ঠা ৪০-৪১)-এ। পরের সময়ের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে পরে আসি। কিন্ত আওয়ামী লীগের সমর্থকদের একাংশ এই সব পদক্ষেপকে আদর্শিক অবস্থানের বদল না বলে কেবল কৌশল ভেবেছেন এই কারণে যে, তা তাঁদের জন্যে স্বস্তিদায়ক। তাতে করে তাঁদেরকে একটি মধ্য-দক্ষিনপন্থী দলকে সমর্থন করার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় না; তাঁদের বিবেচনায় সেক্যুলার ও উদার (লিবারেল) পরিচয় বহাল রাখা যায়। এই ধরণের লোকদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য হচ্ছে আপনি যে আওয়ামী লীগকে প্রত্যাশা করেন এবং যে আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে উপস্থিত তাঁর মধ্যে ফারাক তৈরি হয়েছে। সে দায় আওয়ামী লীগের নয়, আপনাদের। আওয়ামী লীগের এই পরিবর্তন ইতিবাচক না নেতিবাচক সেটা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্ত আওয়ামী লীগের এই আদর্শিক পরিবর্তনকে অস্বীকার করে যে আওয়ামী লীগের কথা আপনি ভাবেন তা আপনার কল্পনামাত্র। এই ধরণের একটি দলকে আপনি সমর্থন করতে চান কিনা সেটা আপনার সিদ্ধান্ত। কিন্ত আওয়ামী লীগ জানে যে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেনীর কথিত সে্ক্যুলাররা এই দলের প্রতি তাঁদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে।

‘আওয়ামী লীগের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই’
আওয়ামী লীগের যে সব সমর্থক এখন ‘ক্ষোভ’ দেখাচ্ছেন তারাও যে শেষ পর্যন্ত দলকে সমর্থনের একটা যুক্তি খুঁজে পাবেন সেটা বোঝার জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডীন এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক সাদেকা হালিমের বক্তব্যই যথেষ্ট – “বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক বা ধর্মনিরপেক্ষতার রেটিংএ এখনো আওয়ামী লীগই এগিয়ে আছে। যারা অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল বা ধর্মনিরপেক্ষ – তাদের বেছে নেবার মত দল খুব সীমিত, তাদের কাছে আওয়ামী লীগই এখনো শেষ ভরসা” (বিবিসি অনলাইন, ‘আওয়ামী লীগ – হেফাজত মৈত্রী: সেকুলার সমর্থকরা কী ভাবছেন?’ ৪ নভেম্বর ২০১৮)। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে তরুণ ব্লগারদের গ্রেপ্তার, গণজাগরণ মঞ্চ বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ এবং মঞ্চ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শের পর এই ধরণের অভিমানী কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ‘আওয়ামী লীগের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই’ শিরোনামে যে নিবন্ধটি লিখেছিলাম তাঁর মোদ্দা কথাটাই ছিলো এই যে, আওয়ামী লীগের এই সমর্থকদের হারানোর ভয় নেই (‘আওয়ামী লীগের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই’, প্রথম আলো ৫ এপ্রিল ২০১৪)। সেই সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন আওয়ামী লীগ এখন দুই নৌকায় পা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের শরিকদের একজন রাশেদ খান মেনন বলেছিলেন, এতে করে ‘আমও যাবে, ছালাও যাবে’। যদিও ২০১৪ সালের তুলনায় রাজনৈতিক অবস্থার বদল ঘটেছে এবং এখন আর কেউ ‘আগানী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে মাশুল গুনতে হবে’ বলেন না তথাপি এটাই সত্য যে তাঁরা কোনো না কোনো ভাবেই একটা যৌক্তিকতা তৈরি করতে সক্ষম হবেন কেননা এই সমর্থকদের স্বার্থ এই দলের ক্ষমতাসীন থাকার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। যে সব বুদ্ধিজীবী এবং সিভিল সোসাইটির সদস্য দলকে প্রশ্নাতীতভাবে সমর্থন যুগিয়ে এসেছে তাঁদের জন্যে ‘পরাজয়ের মুল্য’ (কস্ট অফ ডিফিট) অনেক বেশি (এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখতে পারেন, ২০১৩ সালে মার্কিন কংগ্রেসের শুনানীতে দেয়া আমার বক্তব্যের লিখিত ভাষ্য, পৃষ্ঠা। ৮)। দ্বিতীয়ত তাঁরা জানেন যে এই গোষ্ঠীর সমর্থন থাকা না থাকাকে এখন আর লীগের ধর্তব্যের বিষয় নয়। নির্বাচনে জেতার জন্যে যখন ভোটেরই দরকার হয় না সেখানে এই নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কারণ নেই।

হেফাজতের ভোটের হিসেব-নিকেশ
একটা সখ্যের আরেক ব্যাখ্যা হচ্ছে আওয়ামী লীগ হেফাজতের ভোট চায়। শহরের মধ্যবিত্তরা এই বলে নিজেদের বোঝাতে চাইছেন যে, হেফাজতের হাতে প্রচুর ভোট আছে বলেই এই পদক্ষেপ। আসলেই কী তাই? সংখ্যার হিসেবে কী তাই দাঁড়ায়? অনেকেই বলেন যে শেষ প র্যন্ত হেফাজত আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেনা, অথচ আওয়ামী লীগ তাঁদের দুধকলা দিয়ে পুষছে। এই ব্যাখ্যার পেছনে কী তথ্য আছে সেটা কেউ এখনও জানান নি। কিন্ত এটা ঠিক যে আগামী নি র্বাচনে হেফাজত একটা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। সেটা হচ্ছে ভোট কেন্দ্রে উপস্থিতি দেখানো। যদি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হয় তবে ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি দেখানোর সাংগঠনিক ক্ষমতা অনেক রাজনৈতিক দলের চেয়ে হেফাজতের বেশি। এমনকি ১৪ দলের অধিকাংশ শরীক, সম্ভবত বাকি ১৩ দলের চেয়ে বেশি ক্ষমতা হেফাজতের আছে। আওয়ামী লীগের জন্যে ২০১৮ সালে সেটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচনা করতে হবে। ফলে হিসেবটা ভোটের নয়, মোবিলাইজেশনের ক্ষমতা।

আওয়ামী লীগ কেন দ্রুত বদলে গেছে?
১৯৯১ সালে থেকে আওয়ামী লীগের পরিবর্তনের সূচনা হলেও এই পরির্তনের গতি ছিলো অত্যন্ত শ্লথ। ২০০৬ সাল পর্যন্ত শম্বুক গতিতেই এই বদল ঘটছে। কিন্ত ২০১৩ সালের পরে সেই গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বিভিন্ন কারণ আছে, তাঁর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আমি উল্লেখ করতে চাই (এর কিছু দিক নিয়ে আমার আগের আলোচনা দেখুন, ‘কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির পেছনে বড় রাজনীতি’, ডয়েচে ভেলে, ২৪ এপ্রিল ২০১৭)।

প্রথমত ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে হেফাজতের উত্থান এবং সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শন থেকে লীগের নেতারা, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, উপলব্ধি করেছেন যে ইসলামপন্থীদের মধ্যে এই শক্তিকে অগ্রাহ্য করা রাজনৈতিকভাবে প্রজ্ঞার কাজ হবে না। ক্রমবর্ধমান নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেনীর কাছে রক্ষণশীল, গ্রাম-নির্ভর কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইসলামপন্থিদের কোনও গ্রহণযোগ্যতা থাকবেনা ফলে এই দুই শ্রেনীর মধ্যে এমন ঐক্য গড়ে উঠবেনা যা সরাসরি ক্ষমতার জন্যে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে, কিন্ত আওয়ামী লীগের ইসলাম-পছন্দের বিষয়টি সহজেই দেখানো যাবে। মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশে গত এক-দেড় দশকে যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে তাদের মধ্যে দৃশ্যমানভাবে ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুভূতিশীল হবার প্রবণতা লক্ষণীয় (এই বিষয়ে আমার আলোচনা দেখুন, বাংলাদেশের রাজনীতি, বিকাশমান মধ্যবিত্ত এবং কয়েকটি প্রশ্ন, প্রতিচিন্তা, বর্ষ ৭, সংখ্যা ৩, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৭, পৃষ্ঠা ৯-৩৬)৷ ফলে এই ধরণের পদক্ষেপ একাধিকভাবে দলের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে।

দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের সমাজে ইসলামের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইসলাম সবসময়ই এক ধরণের ভূমিকা রেখেছে। কিন্ত গত কয়েক দশকে সমাজ জীবনে ইসলামের দৃশ্যমান উপস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারণ যেমন রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম ধর্মের প্রতি পক্ষপাত, তেমনি তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের মানস গঠনে বড় ধরণের পরিবর্তন (বিস্তারিত আলোচনার জন্যে দেখুন, আমার গ্রন্থ, লিভড ইসলাম এ্যান্ড ইসলামইজম ইন বাংলাদেশ, ২০১৭, পৃষ্ঠা ৫৫-৭৮)। রাজনীতিতে ইসলামী দলের আবেদনের চেয়ে সামাজিকক্ষেত্রে ইসলামী সংগঠনের প্রসার ও প্রভাব তার অন্যতম কারণ, এই সময়ে একটি ইসলামী জনপরিমণ্ডলও গড়ে উঠেছে (দেখুন, বাংলাদেশে ইসলামপন্থী জনপরিমণ্ডল, প্রতিচিন্তা, বর্ষ ৫, সংখ্যা ১, জানুয়ারি-মার্চ ২০১৫, পৃষ্ঠা ৯-৩৬)। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে এগূল এক বৃত্তচক্রের মতো কাজ করেছে। গত এক দশকে যে এই প্রক্রিয়া আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছে।

তৃতীয়ত নৈতিক বৈধতার সংকট। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে দলের শাসনের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করায় দুটি আদর্শ – উন্নয়ন এবং ইসলামপন্থার মোকাবেলা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াতে ইসলামীকে কার্যত নিষিদ্ধ দলে পরিণত করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দল এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে তারা ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন৷ অন্যদিকে সরকার বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্ত ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর এই আদর্শের আবেদন ফুরিয়ে আসে। ফলে তাঁদেরকে যে নৈতিক বৈধতার সংকটের মোকাবেলা করতে হয়েছে সেখানে ধর্মের আবেদনের দিকে এবং তাঁর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সখ্য গড়াই স্বাভাবিক। যখনই কোনো ক্ষমতাসীন দল নৈতিক ও সাংবিধানিক বৈধতার সংকটে পড়েছে; জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এরশাদের সরকারও ১৯৭৮ এবং ১৯৮৮ সালে একই পথ অনুসরণ করেছে (এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখুন ২০০৩ সালে আমার প্রকাশিত গবেষনা প্রবন্ধ । এই ধরণের উদাহরন সারা পৃথিবীতেই দেখা যায়। পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে আমি অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করেছি (গড উইলিং – দ্য পলিটিক্স অব ইসলামইজম ইন বাংলাদেশ, ২০০৪, পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪১); এ ছাড়া জেসমিন লর্চ সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষনা প্রবন্ধে অন্যান্য দেশের উদাহরণ এবং এই বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার বিভিন্ন সূত্র নির্দেশ করেছেন, ইসলামাইজেশন বাই রুলিং সেক্যুলার পার্টি- দ্য কেইস অব বাংলাদেশ, পলিটিক্স এ্যান্ড রিলিজিয়ন, অনলাইন ভাষ্য: )।

শেষ কথা নয়
হেফাজত-আওয়ামী লীগের সখ্যের যে উদাহরণ ৪ নভেম্বরের শোকরানা সমাবেশে দৃশ্যমান হয়েছে সেই নিয়ে আলোচনার শেষ কথা বলার সুযোগ নেই। এই লেখায় কেবল কয়েকটি দিকের প্রতি মনোযোগ আকর্ষন করার চেষ্টা করা হয়েছে।

ইলিনয়, ৫ নভেম্বর ২০১৮, ০১:৩৫

Leave a Reply