April 16, 2024

http://www.dailypainters.com/paintings/244673/The-Good-People-Figurative-Abstract-Paintings-by-Texas-Artist-Laurei-Pace/Laurie-Justus-Pace

উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নাগরিক সমাজের ভুমিকা সর্বজনবিদিত। বিখ্যাত দার্শনিক জন রলস তাঁর থিওরি অব জাস্টিস গ্রন্থে বলেছেন আধুনিক উদার গণতন্ত্র কেবল শক্তিশালী নাগরিক সমাজের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত ও ভিত্তি লাভ করে। তিনি নাগরিক সমাজকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও কাঠামোর বাইরে একটি স্বেচ্ছাসেবি সংস্থা (ভলান্টারি এসোসিয়েশন) হিসেবে চিহ্নিত করেন। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় নাগরিক সমাজের এহেন গুরুত্ব সর্বজনবিদিত।

বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক উত্তরণ এখনও অসম্পূর্ণ। আমাদের পদচারণা এখনও গণতন্ত্রের ক্রান্তিকালের আবর্তে ঘূর্ণায়মান এবং এটিকে সুসংহত করার সার্বিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ থেকেও আমরা আজকের বাস্তবতায় বহুদূরে অবস্থান করছি। তথাপি, একটি তুলনামূলক নবীন গণতন্ত্র হিসেবে এদেশের গণতান্ত্রিক অবকাঠামোগুলো বিকাশমান পর্যায়ে রয়েছে এবং স্বাভাবিক বিবর্তন প্রক্রিয়ায়ই হোঁচট খেয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। নাগরিক সমাজও তেমনিভাবে এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপে বিকশিত হতে পারেনি।

কিন্তু নাগরিক সমাজের প্রকৃত স্বরূপটি কি? এটি কি রাষ্ট্রের অভিজাত ও উচ্চতর শ্রেণির ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সংগঠিত রূপ? না-কি তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও কাঠামোর আওতা বর্হিভূত বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি? এ প্রশ্নগুলোকে সামনে রেখেই বাংলাদেশে বিকাশমান নাগরিক সমাজ এখনও তার আত্মপরিচয়ের সন্ধান করে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে যে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ প্রায়শই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা ও অভিজাত শ্রেণির আধিক্যে নিজের গণমূখী চরিত্র ও পরিচয় গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।

যেখানে নাগরিক সমাজের সাথে রাজনৈতিক দল, মতাদর্শের মতভিন্নতা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের সাথে রাজনৈতিক দল, পক্ষগুলোর বিস্তর অমিল পরিলক্ষিত হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক পক্ষগুলোর উপর কার্যকর চাপ প্রয়োগেও অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে বলা চলে। নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক পক্ষগুলোর এহেন বিপরীতমূখী অবস্থান ও অকার্যকর সম্পর্ককে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, হয় রাজনৈতিক পক্ষগুলো আদৌ জনগণের ব্যাপক অংশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না এবং নাগরিক সমাজ সে জায়গাটিতে আপোষহীন অবস্থানে থাকায় একটি বিপরীতমূখী দ্বান্ধিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র পরিচালনাকালীন সুশাসন প্রদানে ব্যর্থতা ও দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ থাকলেও জনগণ ব্যাপকভাবে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে এরূপটিও দৃশ্যমান নয়। দ্বিতীয়ত, আরেকটি হতে পারে যে, রাজনৈতিক পক্ষগুলোর প্রয়োজনীয় গণভিত্তি রয়েছে কিন্তু নাগরিক সমাজ নগর ও প্রান্তিকের মধ্যে কার্যকর সংযোগ গড়ে তুলতে পারেনি বিধায় রাজনৈতিক দলগুলোর উপর ফলপ্রসূ চাপ প্রয়োগে ব্যর্থ হচ্ছে।

আমার বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর গ্রহণযোগ্যতার পারদ নি¤œমূখী হলেও তৃণমূল পর্যায়ে নাগরিক সমাজের প্রায় অনুপস্থিতি জনগণকে এখনও ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক দল-নির্ভর করে রেখেছে। তৃণমূলে নাগরিক উদ্যোগের ঘাটতি সুশাসনের দাবীর পক্ষে জনগণকে জোরালোভাবে সংগঠিত করতে পারছে না, যার ফলে রাজনৈতিক দুর্বত্তপনা ও পৃষ্ঠপোষকতার কাঠামো (patron-clientelism) জনগণকে আরও বেশি করে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর নির্ভরশীল করে তুলছে।

সুশাসনের পক্ষে তৃণমূলে কেন পর্যাপ্ত নাগরিক উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে তার পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি রয়েছে। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয়, এর কারণ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক। প্রথমত, রাজনৈতিকভাবে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে জনগণের শাসনের স্বরূপ কি তা ঐতিহাসিকভাবেই সুস্পষ্ট নয়। শত-শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসন, তারও পূর্বে রাজা-মহারাজাদের শাসন – সব মিলিয়ে এ অঞ্চলের গণতান্ত্রিক চর্চা তুলনামূলক বিচারে অত্যন্ত নবীন। দ্বিতীয়ত, দারিদ্র-পীড়িত গ্রাম-বাংলায় একসাথে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপক আকারে অর্থের সরবরাহ সেভাবে কখনই ঘটেনি (যারা বঙ্গের সোনালী অর্থনীতির সময়ের কথা বলেন তারা মূলত জোতদার, জমিদার প্রভৃতি শ্রেণির আর্থিক স্বচ্ছলতাকেই নির্দেশ করেন। যদিও প্রাচীন বঙ্গে মানুষের অভাব সে অর্থে ছিল না, কিন্তু ব্যাপকসংখ্যক মানুষের হাতে পুঁজির সরবরাহও ছিল না)। কিন্তু বর্তমানে অত্যন্ত দ্রুত ও বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে আভ্যন্তরীণ ও প্রবাসী রেমিটেন্সের কল্যাণে তৃণমূলে ইতিহাসের যেকোন সময়ের চেয়ে অর্থের যোগান বা সরবরাহ বেড়েছে যা গ্রামীণ ক্ষমতার ভারসাম্য, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়েছে। এই ক্রান্তিকালে জনগণের বৃহত্তর অংশ অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি অস্থির, ভোগবাদী, এবং নৈতিকতার প্রশ্নে আপোষকামী। তাদের মধ্যে প্রচলিত কাঠামো, মূল্যবোধ ভেঙে দেওয়ার উল্লাস যেমন রয়েছে, তেমনি নতুন পরিস্থিতির অস্থিতিশীলতা ও পরিণতি সম্পর্কে অজ্ঞতাও সমভাবে বিরাজমান। কেবল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্যই নয়, আর্থ-সামাজিক ও ক্ষমতার কাঠামো রূপান্তরেও এই ক্রান্তিকালের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে ও থাকবে। এই অস্থির ও ভাঙা-গড়ার সময়ে তাই প্রচলিত অনেক কিছুই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে, নতুন ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি হবে। এবং এই আপাত বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই পরবর্তী স্থিতাবস্থার বীজ সুপ্ত রয়েছে।

এই নব কাঠামো ও নতুন পক্ষগুলো একটা পর্যায়ে তাদের নিজ নিজ স্বার্থ সংরক্ষণ ও সদ্য প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে নিজেরাই এই অস্থিরতার অবসান চাইবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কেবল তখনই তৃণমূলে কার্যকর নাগরিক উদ্যোগ গড়ে উঠবে অথবা এরূপ কোন উদ্যোগ স্থায়ীত্বশীলতার পথে যাবে। এই অস্থির সময়ে নয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্রও কেবল তখনই ভেতর থেকে সুশাসনের চাহিদা, উদারনৈতিকতা এবং নিচ থেকে ঊর্ধ্বমূখী চাপ তৈরি করবে। এই চাপের ফলেই তৃণমূলে নাগরিক উদ্যোগ বিস্তৃতি লাভ করবে, ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটবে এবং যার ফলশ্রুতিতে জাতীয় পর্যায়েও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হবে।

বাংলাদেশে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এ সময়টুকু স্বাভাবিকভাবেই দিতে হবে। নাগরিক সমাজের বিকাশ ও গণতন্ত্রের পথে তাদের ভূমিকাও এই পথপরিক্রমায়ই ধীরে ধীরে নির্ধারিত হবে পরিণতি লাভ করবে। যদি আমরা এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে পরিণতি দিতে যাই (ম্যাকিয়াভেলিয়ান তত্ত্বে বিশ্বাসীদের মতো “হস্তক্ষেপের” মাধ্যমে), তাহলে অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে অপরিণত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ শিশুর মতোই তাতে নানা পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ও অনাহূত জটিলতা সৃষ্টি হবে যা প্রকারান্তরে আসল উদ্দেশ্যকেই ব্যহত করতে পারে।

নাগরিক সমাজের বিকাশ, উদার গণতন্ত্র আমাদের সকলের প্রত্যাশা। কিন্তু এটি হঠাৎ করেই আসবে না। আমাদের সবাইকেই এই স্বাভাবিক বিকাশের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে এবং স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে যাতে প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হয় (তাড়াহুড়ো নয়)।

থাম্বনেইলের ছবি: দ্যা গুড পিপল, লরি পেইস http://goo.gl/78PEd9

Leave a Reply