![](https://kathakata.com/wp-content/uploads/2018/06/Rohingya_Rafts_RF2135683.jpg)
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেশত্যাগে বাধ্য করার কারণে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অভিযুক্ত এবং বিচারের মুখোমুখি করা যায় কি না, সেই প্রশ্ন আন্তর্জাতিক পরিসরে এখন বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই আলোচিত হচ্ছে। এই লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর ওপর দেশের বিশেষজ্ঞ, আইনপ্রণেতা, বৈদেশিক নীতিনির্ধারণে প্রভাবশালীদের চাপ বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর করণীয় কী এবং তাদের হাতে কী ধরনের বিকল্প আছে, সেসব বিষয়েই আলোচনা হচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার জন্য মিয়ানমারের ওপর সুনির্দিষ্ট চাপ প্রয়োগের তাগিদ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে; বিভিন্ন ধরনের উপায় ও উপকরণ বিবেচনায় নেওয়ার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। এই চিন্তাভাবনায় বড় ধরনের ইতিবাচক অবদান রেখেছে আইসিসির প্রধান প্রসিকিউটর ফাতোহ বেনসুদার উদ্যোগ।
আইসিসিতে মিয়ানমারের প্রসঙ্গ কীভাবে এল
গত ৯ এপ্রিল ফাতোহ বেনসুদা আইসিসির প্রাক্বিচারিক আদালতের কাছে আবেদন করেন যে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের কারণে সে দেশকে বিচারের মুখোমুখি করার এখতিয়ার আইসিসির আছে এবং সেই মর্মে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তাঁর এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইসিসির প্রাক্বিচারিক আদালত ৭ মে এই বিষয়ে শুনানির ব্যবস্থা করেন এবং এই আবেদনের ব্যাপারে তিনটি সুস্পষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশের পর্যবেক্ষণ এবং বাংলাদেশ বেনসুদার এই অভিযোগের পক্ষে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হতে চায় কি না, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বা পর্যবেক্ষণ জানতে চাওয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে কী পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা বাংলাদেশে অবস্থান করছে; মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশের এসেছে-এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের স্থানিক বা টেরিটরিয়াল এখতিয়ার ব্যবহারের সম্ভাবনা বিষয়ে বাংলাদেশ কী মনে করে এবং প্রসিকিউটরের এই অনুরোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের মতামত, যা বানসুদার অনুরোধ বিষয়ে আদালতকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। ১১ জুনের মধ্যে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে অভিমত পাঠাতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানায় আইসিসি। বাংলাদেশ এই বিষয়ে তার অবস্থান নিয়ে দ্বিধায় আছে বলে সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে (প্রথম আলো, ২৫ মে ২০১৮)।
ফাতোহ বেনসুদার এই অনুরোধের একটি দিক হচ্ছে, মিয়ানমারকে এখন কোনো না কোনোভাবে সংকটের দায় বহনে বাধ্য করার বিষয়ে বাক্যবিস্তারের বাইরে গিয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন স্বীকৃতি লাভ করছে। এই অভিযোগে কার্যত বলা হচ্ছে যে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন একটি অপরাধ এবং তার জন্য মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আইনেই দায়ী করা যায়। রোহিঙ্গা শরণার্থীসংকটের শুরু থেকে, বিশেষ করে যখন শরণার্থীদের কাছ থেকে অত্যাচার, নিপীড়ন, হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণের সুস্পষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পর থেকেই এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো দাবি তুলেছে যে জাতিসংঘ যেন বিষয়টি আইসিসির কাছে পাঠিয়ে দেয়। তারা মনে করে, রাখাইন প্রদেশে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা ও ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে, যার মাত্রা নিঃসন্দেহে জাতিগত নিধনের প্রমাণ দেয় এবং গণহত্যা বলেও একে বিবেচনা করা যেতে পারে। ফলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করে যে এ ধরনের অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত। গত ৯ মে চারটি মানবাধিকার সংগঠন যৌথভাবে দেওয়া এক বিবৃতিতে আবারও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে এই আবেদন করেছে।
আমরা এটা জানি যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই মুহূর্তে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে না। কেননা, চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে; শুধু তা-ই নয়, নিরাপত্তা পরিষদের অন্য অনেক দেশ এখনো এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে নয়। ফলে মনে হতে পারে যে যত কিছুই বলা হোক না কেন, আসলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই ধারণার ভিত্তি হচ্ছে, অতীতে যেসব আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গঠিত হয়েছে, তা হয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের সম্মতিক্রমেই। এটি সাধারণভাবে সঠিক হলেও এটাই যে একমাত্র পথ, তা নয়।
আইসিসি কীভাবে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করে
কোথাও গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আগ্রাসনের অপরাধ সংঘটিত হলে আইসিসি ওই অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি স্থাপন করতে পারে। ১৯৯৮ সালে গৃহীত রোম স্ট্যাটিউট, যা ২০০২ সালে কার্যকর হয়েছে, তাতে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই বিচার করা হবে যে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র ওই অপরাধের বিচার করতে ‘অনিচ্ছুক’ বা ‘অপারগ’। স্ট্যাটিউটের ১৩ অনুচ্ছেদে আইসিসির এখতিয়ার নির্ধারণ করা হয়েছে। আইসিসির বিচার কোনো দেশের প্রচলিত আদালতের বিকল্প নয়, পরিপূরক। এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে তিন ভাবে।
প্রথমত, যদি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আইসিসির কাছে সেই অভিযোগ প্রেরণ করে। দ্বিতীয়ত, কোনো দেশ যদি এই অভিযোগ আইসিসির কাছে পাঠায়। এই দুই ক্ষেত্রে এগুলোকে রেফারেল বলে বর্ণনা করা হয়। উভয় ক্ষেত্রেই আইসিটি গঠনের প্রাথমিক দুটি শর্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশ কর্তৃক রোম স্ট্যাটিউট এবং ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন স্বাক্ষর করা। এই দুই ক্ষেত্রেই বিরাজমান ‘পরিস্থিতি’ হচ্ছে প্রক্রিয়া শুরু করার ভিত্তি। এসব ক্ষেত্রে রেফারেলের পরপরই আইসিসি তদন্ত শুরু করে। তৃতীয়ত, নিজস্ব উদ্যোগে, যাকে আইনের ভাষার বলে ‘প্রপ্রিয়ো মতু’। শেষোক্ত ক্ষেত্রে ‘প্রাপ্ত তথ্য’ হচ্ছে ভিত্তি। এই ক্ষেত্রে প্রসিকিউটরকে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণ করতে হয়। এই ক্ষেত্রে তদন্তের সূচনা করতে হলে প্রাক্বিচারিক আদালতের অনুমোদন দরকার হয়, যা অন্য দুই ক্ষেত্রে দরকার হয় না।
উভয় ক্ষেত্রেই তদন্তের শুরুতে এই অভিযোগ বিচারযোগ্য কি না, অর্থাৎ রোম স্ট্যাটিউটে যে গ্রাহ্যতা বা অ্যাডমিসেবিলিটি টেস্ট আছে, তার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তথ্যের ভিত্তিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রসিকিউটরের তদন্ত যদি প্রাক্বিচারিক আদালতে অনুমোদিত হয়, তবে তা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোকে জানানো হয়। এরপর তা আবারও প্রাক্বিচারিক আদালতের অনুমোদনক্রমে তদন্তের সূচনা করা হয়। কোনো কারণে যদি আদালত এই বিচার আপাতত স্থগিত রাখেন, তবে আইসিসি ইতিমধ্যে সংগৃহীত প্রমাণাদি সংরক্ষণ করে, যাতে প্রয়োজনে এই বিচারের কাজ পরে শুরু করা যায়।
অতীতের অভিজ্ঞতা কী বলে
আইসিসি এ পর্যন্ত চারটি ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে বা তার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে এবং এর বাইরেও বিভিন্ন দেশের একাধিক ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করেছে। ট্রাইব্যুনালগুলো হচ্ছে সাবেক যুগোস্লাভিয়া (১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত), রুয়ান্ডা (১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত), সিয়েরা লিওন (২০০২) এবং কম্বোডিয়াবিষয়ক (২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত)। সেসব দেশের সংঘাতময় সময়ে সংঘটিত অপরাধের বিচার সম্পন্ন করা হচ্ছে এদের লক্ষ্য। এর মধ্যে প্রথম দুটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উদ্যোগে-প্রথমটি সর্বসম্মতভাবে; দ্বিতীয়টির ব্যাপারে রুয়ান্ডা বিরোধিতা করেছিল এবং চীন ভোটদানে বিরত ছিল। এগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের বাইরে স্থাপিত হয়েছে।
সিয়েরা লিওনের ট্রাইব্যুনালকে বলা হয় ‘বিশেষ আদালত’ এবং তা প্রতিষ্ঠিত হয় ওই দেশের সরকারের আগ্রহে জাতিসংঘের কাছে দেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে। এটি হচ্ছে প্রথম আদালত, যা সংশ্লিষ্ট দেশেই স্থাপিত এবং ওই দেশের আদালতের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে স্থাপন করা হয়েছে। এর বিচারকদের একাংশ ছিলেন সিয়েরা লিওনের বিচারক। একে প্রথম হাইব্রিড ধরনের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বলা হয়। কম্বোডিয়া ট্রাইব্যুনালকে এখন বলা হয় ‘দ্য এক্সট্রা অর্ডিনারি চেম্বারস ইন দ্য কোর্টস অব কম্বোডিয়া’, এর উদ্যোগ এসেছে ওই দেশের পক্ষ থেকে। এটি কম্বোডিয়াতে স্থাপিত এবং এর অধিকাংশ বিচারক কম্বোডিয়ার।
এই চার ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের বাইরেও আইসিসি অন্যান্য যে দেশে সংঘটিত অপরাধের তদন্ত করেছে-তার মধ্যে আছে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, উগান্ডা, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও মালি। রোম স্ট্যাটিউট এবং এই চার ট্রাইব্যুনালের অভিজ্ঞতা হচ্ছে বিচার কোনো দেশের হয় না, বিচার হয় ব্যক্তির; বিচারের জন্য সব সময়ই সংশ্লিষ্ট দেশের সম্মতির প্রয়োজন হয় না। চারটি ট্রাইব্যুনালে মোট ২৮২ জন অভিযুক্ত হয়েছেন, ২৫২ জনের ক্ষেত্রে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জনের বিচার চলছে, ৩৩ জন খালাস পেয়েছেন, ১৮ জনকে সংশ্লিষ্ট দেশের কাছে বিচারের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে, ৯ জন পলাতক এবং ৫১ জনের ক্ষেত্রে হয় তাঁরা মারা গেছেন বা তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
প্রসিকিউটরের অফিস এখন প্রাথমিক তদন্ত করছে ১০টি ক্ষেত্রে এবং ১১টি ক্ষেত্রে তদন্ত চলছে। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে প্রসিকিউটরের অফিস বুরুন্ডিতে সংঘটিত অপরাধের তদন্ত শুরু করেছে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে। এর অর্থ হচ্ছে প্রসিকিউটরের অফিস যথেষ্ট তথ্য পেলে এবং প্রাথমিক অনুসন্ধানে এর পক্ষে যদি সমর্থন পায়, তবে তার তদন্তে পিছপা হয় না।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ
মানবাধিকার সংগঠনগুলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং জাতিগত সহিংসতার অভিযোগ আনার দাবি করলেও এখন ফাতোহ বেনসুদা সেই অভিযোগের তদন্ত করার অনুমোদন চাননি। তিনি যে অভিযোগের তদন্ত করতে চাইছেন তা হচ্ছে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয়-‘জনগোষ্ঠীকে বিতাড়ন বা জোর করে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া’ (অনুচ্ছেদ ৭ [১] [ডি])। আপাতদৃষ্টে অভিযোগটি হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ বা লুটপাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে না হলেও এর তাৎপর্য এবং গুরুত্ব কম নয়, কেননা এই অভিযোগের শাস্তি ওই সব অভিযোগের চেয়ে কম নয়।
এই প্রক্রিয়ার আইনি ভিত্তি কোথায়
সাধারণভাবে কোনো রাষ্ট্র যদি রোম স্ট্যাটিউট অনুস্বাক্ষর না করে, তবে আইসিসির এখতিয়ার থাকে না; ব্যতিক্রম হচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আইসিসিতে অভিযোগ প্রেরণ বা সংশ্লিষ্ট দেশ কর্তৃক সাময়িকভাবে আইসিসির এখতিয়ার মেনে নেওয়া। কিন্তু যেহেতু মিয়ানমার রোম স্ট্যাটিউট স্বাক্ষর করেনি, সেহেতু মিয়ানমার বারবার বলার চেষ্টা করছে যে আইসিসির তদন্তের কোনো এখতিয়ার নেই (ডেইলি স্টার, ১৪ এপ্রিল ২০১৮)। বিপরীতক্রমে ফাতোহ বেনসুদা তাঁর আবেদনে দেখানোর চেষ্টা করছেন যে যেহেতু বাংলাদেশ এর স্বাক্ষরকারী এবং বিতাড়িত লোকজন আন্তর্জাতিক সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেহেতু আইসিসির এখতিয়ার তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি আইসিসির একজন সাবেক প্রসিকিউটর স্যার জেওফ্রি নিস এক সাক্ষাৎকারে এই মত প্রকাশ করেছেন যে বেনসুদার আবেদন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তিনি মনে করেন যে আইনি ব্যাখ্যা এবং নৈতিক অবস্থানের দিক থেকে এই তদন্তের অনুমোদন দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে (ডেইলি স্টার, ৩১ মে ২০১৮)। এই ধরনের অনুমোদনের কোনো পূর্ব উদাহরণ বা প্রিসিডেন্স নেই; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে বিচারের আগে আদালত এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারবেন না। বরং আইসিসি প্রতিষ্ঠার যে উদ্দেশ্য, তার সঙ্গে এ আবেদনের সংগতি সুস্পষ্টভাবেই এ আবেদনের অনুকূলে আছে।
বাংলাদেশ কেন দ্বিধান্বিত, কী করণীয়
আইসিসি বাংলাদেশের কাছে যেসব বিষয় জানতে চেয়েছে, তার মূল বিষয় হচ্ছে আইসিসির স্থানিক এখতিয়ারের প্রশ্ন, অর্থাৎ বাংলাদেশ মনে করে কি না যে এই ধরনের তদন্তের এখতিয়ার আইসিসির আছে। মানবিক ও নৈতিক বিবেচনায় এবং রোম স্ট্যাটিউটের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের দ্বিধান্বিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের কথিত দ্বিধার কারণ স্পষ্টত রাজনৈতিক। প্রথমত, বাংলাদেশ বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের পক্ষে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার আন্তর্জাতিকীকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে পাঁচ দফা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, এতে বাংলাদেশ যে অবস্থান নিয়েছিল, তাতে সমস্যার আন্তর্জাতিকীকরণের ইঙ্গিত ছিল সুস্পষ্ট। পরে বাংলাদেশ সেই অবস্থান থেকে সরে আসার কারণেই আইসিসির এই অনুরোধের উত্তর দেওয়া বিষয়ে বাংলাদেশের দ্বিধা তৈরি হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সরকার এই প্রশ্নে ভারত, চীন বা রাশিয়াকে ক্ষুব্ধ করতে নারাজ। তারা ধরে নিয়েছে যে আইসিসির অনুরোধে ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার অর্থ হবে এই দেশগুলোর প্রতি অনাস্থা। নীতিনির্ধারকেরা যেহেতু অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনীতির বিন্যাসকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন, সেহেতু তাঁরা এখন এই দেশগুলোর প্রতিক্রিয়াকেই বিবেচনায় নিচ্ছেন। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা সম্ভবত মনে করছেন যে আইসিসির সঙ্গে সহযোগিতার অর্থ হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার পথ বন্ধ করে দেওয়া।
কিন্তু বাংলাদেশের এসব বিবেচনা ‘বাংলাদেশে’র স্বার্থের অনুকূলে নয় এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও তা ইতিবাচক বলে বিবেচিত হতে পারে না। বাংলাদেশের করণীয় হচ্ছে আইসিসির এই অনুরোধের উত্তরে কেবল আইসিসির এখতিয়ারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করাই নয়, একই সঙ্গে বাংলাদেশের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা এবং এখন পর্যন্ত যত ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলো হস্তান্তর করা। মনে রাখতে হবে যে অভিযোগ তদন্তের জন্য তদন্তকারী দলকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে যেতে হবে। মিয়ানমার এই তদন্তে সাহায্য করবে না, এটা বলা বাহুল্য। তদুপরি যেভাবে এই অভিযোগ প্রসিকিউটর অফিস প্রাক্বিচারিক আদালতে উপস্থাপন করেছে, তাতে বাংলাদেশে যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে, তাদের কাছ থেকেই এর সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ সম্ভব। বাংলাদেশ যদি এই অভিযোগের পক্ষে থাকে এবং আইসিসির সঙ্গে সহযোগিতা করে, তবে তা মিয়ানমারের ওপর চাপ হিসেবে কাজ করবে এবং দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে মিয়ানমার যে দীর্ঘসূত্রতার পথ বেছে নিয়েছে, তা থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে।
বাংলাদেশ যদি উত্তর না দেয়, তবে কী হবে
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেলে প্রসিকিউটর অফিসের পক্ষে কাজ করা আপাতত কঠিন হবে, কিন্তু এই অভিযোগ যে তাতে নাকচ হয়ে যাবে বা আইসিসি এই বিচারে অগ্রসর হবে না, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এর একাধিক কারণ আছে। প্রথমত, এই অভিযোগ তদন্ত না করলে তা আইসিসির ম্যান্ডেটের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ হবে। দ্বিতীয়ত, ইতিমধ্যেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই ধরনের বিচারের জন্য আইনি উপায় বের করেছে এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এই বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরের এক হাজারের বেশি শরণার্থীর কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছে। এই সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের কৌশল দক্ষিণ সুদানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের তদন্তের মতো। দক্ষিণ সুদানের বিষয়টি এখন আইসিসিতে তদন্তাধীন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ক্লিনিক ২০১৫ সালের অক্টোবরেই এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেছে।
তৃতীয়ত, বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের চাপ আছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটেনের ১০০ জন সাংসদ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন, যেন ব্রিটিশ সরকার মিয়ানমারের বিষয় আইসিসিতে পাঠায়। ২ মে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিটিশ দূত ক্যারেন পিয়ার্স বলেছেন যে রাখাইনে সংঘটিত ঘটনাবলির যথাযথ তদন্ত না হলে এই বিষয়টি আইসিসিতে পাঠানোর বিকল্প থাকবে না। এমনকি যেসব দেশ এই মুহূর্তেই আইসিসির কাছে পাঠানোর বিষয়ে খানিকটা দ্বিধান্বিত, সেসব দেশও জাতিসংঘের কঠোর অবস্থানের পক্ষে। যেমন কানাডা। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বব রে এপ্রিল মাসে সরকারের কাছে দেওয়া রিপোর্টে বলেছেন যে এই বিষয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের উদ্যোগে এমন ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যেন ভবিষ্যতে তা আইসিসিতে পাঠানো যায়। এসব বিভিন্ন দেশের উদ্যোগের দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশ তাতে যুক্ত হবে কি না, কার্যত ১১ জুনের মধ্যে সেই সিদ্ধান্তই বাংলাদেশকে নিতে হবে।
শেষ কথা
আইসিসিতে বিচারের বিবেচনায়ই নয়, আরও অনেকভাবেই মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও প্রতিনিধি সভার সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য একাধিক বিল ইতিমধ্যেই পেশ করেছেন। সেগুলো প্রক্রিয়াধীন; কিন্তু হাউসে পাস হওয়া প্রতিরক্ষা ব্যয়সংক্রান্ত বিলে মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা কেবল বৃদ্ধিই করেনি, এপ্রিলে তা আরও কঠোর করা হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ে যাঁরা নজর রাখছেন এবং বাংলাদেশ সরকারের আগামী দিনের করণীয় কী, তা বুঝতে চাইছেন, তাঁদের জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের এসব সম্ভাব্য পদক্ষেপের আলোচনার দিকে নজর রাখা দরকার। এসব উদ্যোগ ও আলোচনায় বাংলাদেশ যুক্ত হচ্ছে কি না, কীভাবে যুক্ত হচ্ছে এবং কী ভূমিকা নিচ্ছে, তার ওপর রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ভর করছে।
প্রথম আলো’তে প্রকাশিত ৫ জুন