March 29, 2024

মার্চ মাসের মাঝামাঝি ইউরোপে করোনাভাইরাস মহামারি রূপ নিলে আইসিস তার অনুসারীদের ইউরোপে না যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল। সংবাদমাধ্যমে এই খবর প্রকাশের পর এ নিয়ে একদিকে যেমন কৌতুকের সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি অনেকে এই নিয়ে স্বস্তিও বোধ করেছিলেন। কেননা ইরাক-সিরিয়া অঞ্চলে আইসিসের পতনের পর ইউরোপ থেকে যেসব ব্যক্তি এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, তারা কেবল যে স্বদেশেই ফিরছিল তা নয়, কেউ কেউ স্বদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছিল। এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছিল যে তারা এখন নিজেরাই ‘রিক্রুটার’ হয়ে উঠছে, ফলে ইউরোপের ভেতরেই এখন সাংগঠনিকভাবে এই ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়বে। করোনাভাইরাসের কারণে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া, এমনকি একই এলাকায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ না থাকায় নিরাপত্তা বিবেচনায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী তৎপরতা কমার কথাই বলা হয়েছিল। 

লক্ষণীয় যে আইসিসের সংবাদপত্র আল নাবাতে বলা হয়েছিল, পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও তাদের আক্রমণ এবং যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। আইসিসের এই হুমকি একেবারেই কথার কথা নয়। কেননা তাদের ঘাঁটির পতন হলেও সিরিয়া ও ইরাকে তাদের প্রায় ২০ হাজার যোদ্ধা এখনো বিভিন্নভাবে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে এবং তারা ওই অঞ্চলে তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। আল নাবার ৯ এপ্রিল সংখ্যায় আইসিস দাবি করে যে আগের সপ্তাহে তাদের যোদ্ধারা ইরাকে ২৯টি হামলা চালিয়েছে, সিরিয়ায় ১১টি। পূর্ব সিরিয়ার হোম প্রদেশের আল-সুকনাহ বলে একটি শহরে এপ্রিলের গোড়াতে আইসিস বড় ধরনের হামলা চালিয়ে ৩২ জন সিরীয় সৈন্যকে হত্যা করেছে বলেও দাবি করে। 

আরেক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল–কায়েদা এই সময়ে কোনো ধরনের হামলা চালানোর কথা বলেনি। আল–কায়েদার প্রচারণায় মুখ্য হয়ে উঠেছে তাদের প্রতি সহানুভূতি অর্জন এবং এই অবস্থায় তাদের সদস্যদের ভরণপোষণের বিষয়। যে কারণে তাদের প্রচারণায় সব ধরনের মানুষের দুর্ভোগের কথা বলা হচ্ছে এবং আল-কায়েদা ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন সংগঠন এবং অনুসারীদের আর্থিকভাবে সাহায্য করে। তাদের এই কৌশলের কারণ তিনটি বলে ধারণা করা হয়। প্রথমত, আইসিসের হাতে যে পরিমাণ সম্পদ আছে, আল-কায়েদার হাতে তা নেই। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইসিসের হাতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সাংগঠনিকভাবে আল-কায়েদা এখন বড় হামলা চালানোর মতো সক্ষম নয়। তৃতীয়ত, আল–কায়েদা সাংগঠনিকভাবে ছোট ছোট আক্রমণের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদিভাবে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি অর্জনের প্রতিই এখন মনোযোগ দিয়েছে।

আল-কায়েদা সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে অবস্থান পরিষ্কার না করলেও তার সঙ্গে আদর্শিক এবং সাংগঠনিকভাবে যুক্ত বিভিন্ন আঞ্চলিক গোষ্ঠী তাদের হামলা অব্যাহত রেখেছে। যেমন নাইজেরিয়া এবং এই অঞ্চলে সক্রিয় বোকো হারাম করোনাভাইরাসের সময়ে তাদের তৎপরতা থেকে পিছিয়ে আসেনি। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে বোকো হারামের হামলায় মারা গেছে নাইজেরিয়ার ৪৭ জন সৈন্য। প্রতিবেশী দেশ চাদের সেনাবাহিনী তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হামলার মুখোমুখি হয়ে হারিয়েছে ৯২ জন সৈন্যকে। মোজাম্বিকে একটি জঙ্গিগোষ্ঠী একটি বন্দর দখল করে নেয়, মালিতে জঙ্গিদের এক হামলায় নিহত হয়েছে কমপক্ষে ২৯ জন সৈন্য। 

করোনাভাইরাসের কারণে বিভিন্ন দেশে বেকারত্ব, খাদ্যসংকট, অনিশ্চয়তা, সরকারের বিভিন্নমুখী ব্যর্থতার কারণে বিভিন্ন দেশে এ ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠী হতাশ এবং বেকার তরুণদের কাছে আবেদন রাখতে সক্ষম হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচারী সরকারগুলোর আচরণ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর যতই নিয়ন্ত্রণ চাপানো হচ্ছে, যতই তারা নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে, ততই উগ্র ও সহিংস গোষ্ঠীর বক্তব্যের আবেদন বাড়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। 

আশাহত মানুষদের কাছে পৌঁছানোর উপায় এখন আগের চেয়ে বেশি সহজ হয়েছে, কেননা সারা পৃথিবীর এক বিশালসংখ্যক মানুষ এখন অনলাইনে উপস্থিত থাকছেন এবং এই ধরনের সংগঠনের উপস্থিতি আগেও ছিল, এখন তা আরও বেড়েছে। সহানুভূতি অর্জনের সহজ উপায় হয়ে উঠেছে বর্তমান পরিস্থিতির অনিশ্চয়তা, মহামারির ধর্মীয় ব্যাখ্যা এবং খাদ্যসংকট। এই ধরনের সংকটে কিছু কিছু জঙ্গি সংগঠন এমন সব কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, যেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে তাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতে সাহায্য করছে। পাকিস্তানের লস্কর-ই-তাইয়েবা এবং জইশ-ই-মুহাম্মদ স্থানীয়ভাবে এই ধরনের সাহায্য কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং এতে করে তাদের পক্ষে নতুন সদস্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। তুরস্কে তুর্কমেনিস্তান থেকে আসা অভিবাসী যারা বেকার হয়ে পড়েছে, তাদের মধ্যে আইসিসের সদস্য সংগ্রহ করার চেষ্টা দেখা গেছে। 

আন্তর্জাতিক এসব সহিংস উগ্রবাদী, সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বৈশ্বিকভাবে সবার জন্য উদ্বেগ আর আশঙ্কার বিষয় হলেও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের জন্য এখন সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের তৎপরতা। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শক্তি যতই বাড়ছে এবং ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সমাজের ভেতরে নাড়া দিচ্ছে, ততই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা আরও বেশি সহিংস হয়ে উঠছে। এই ধরনের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আছে মিলিশিয়ারা, যারা সশস্ত্র এবং এসব আগ্নেয়াস্ত্র প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে প্রদর্শন করছে। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা যে কেবল অন্যদের ভয় দেখাচ্ছে তা–ই নয়, বর্ণবাদী এবং জেনোফোবিক মানুষদের সমর্থন এবং সহানুভূতি লাভ করছে। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘মুনশট সিভিই’ এক গবেষণায় দেখিয়েছে যে অনলাইনে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদ সংশ্লিষ্ট সাইটগুলোতে ভিজিট ১৭ শতাংশ বেড়েছে। যেসব জায়গায় লকডাউন দীর্ঘ হয়েছে, এই হার ২১ শতাংশ। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ও সমাবেশের ভেতরে উপস্থিত হয়ে সেগুলোকে সহিংস করে তোলার জন্যও এই ধরনের সংগঠনগুলো তাদের সমর্থক ও সদস্যদের প্ররোচিত করছে।

কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর তৎপরতা ও হামলা বেড়েছে। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যত সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার মাত্র ২০ শতাংশ ঘটিয়েছিল শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সন্ত্রাসীরা। ২০১৮ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৯৮ শতাংশে। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে এফবিআইয়ের পরিচালক ক্রিস্টোফার রে কংগ্রেসে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বলেছেন, দেশে সংঘটিত সহিংসতা এবং জীবননাশের ঘটনার প্রধান উৎস বর্ণবাদী এবং জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক উগ্রবাদী আদর্শের বিশ্বাসীরা। ১৯৯৫ সালে ওকলাহোমায় ফেডারেল বিল্ডিংয়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী টিমোথি ম্যাক ভেই, মারা যান ১৬৮ জন। করোনাভাইরাসের সুযোগে, বিভিন্ন ধরনের কল্পিত ষড়যন্ত্রতত্ত্বের কথা বলে এই শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা এখন আরও জোরদার হয়ে উঠছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর আচরণ ও কথাবার্তার মাধ্যমে এই ধরনের উগ্রতাকে কেবল বৈধতা দিচ্ছেন তা–ই নয়, উসকেও দিচ্ছেন। 

করোনাভাইরাস মহামারি সারা পৃথিবীকে স্থবির করে দিয়েছে, অনিশ্চয়তা হয়ে উঠেছে সর্বব্যাপ্ত, অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়েছে কোটি কোটি মানুষ, জনস্বাস্থ্যসংকটে সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখোমুখি হয়েছে দরিদ্র ও অধিকারবঞ্চিত মানুষ, বিভিন্ন দেশের সরকার এই মহামারি মোকাবিলায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ও দিচ্ছে। এগুলোকে ব্যবহার করেই এই করোনাকালে সহিংস উগ্রবাদীরা দেশে দেশে তাদের আদর্শ এবং কাজ অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়।

Leave a Reply