December 9, 2024

French President Emmanuel Macron gestures at the end of his speech to a joint meeting of Congress on Capitol Hill in Washington, Wednesday, April 25, 2018. Standing behind him are Vice President Mike Pence and House Speaker Paul Ryan of Wis.

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনের ভাষণে বুধবার (২৫ এপ্রিল) যে বার্তা দিয়েছেন, তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থানের এতটাই বিপরীতে যে তাঁর ভাষণকে ট্রাম্পের প্রতি তীব্র তিরস্কার বলেই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বর্ণনা করছে। সফরের আগে এবং তিন দিনের এই সফরের সূচনা থেকে ট্রাম্প-মাখোঁর ঘনিষ্ঠতার বিভিন্ন রকমের প্রকাশ ঘটেছিল। সেগুলোর কিছু ছিল বিব্রতকর এবং ফরাসি গণমাধ্যমগুলোর ভাষায় ‘আপত্তিকর’।

এ কারণে অনেকেই ভেবেছিলেন, কংগ্রেসের বক্তৃতায় মাখোঁ সম্ভবত মতপার্থক্যগুলো এড়িয়ে গিয়ে আনুষ্ঠানিক কথাবার্তায় নিজেকে সীমিত রাখবেন। কিন্তু তার বদলে মাখোঁ সেই বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলেছেন, যেগুলো সরাসরি ট্রাম্পের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে এবং যা ট্রাম্পের অবস্থানের অসারতা ও ক্ষতির দিকগুলো সুস্পষ্ট করে তোলে। তিনি যে চারটি বিষয়ে জোর দিয়েছেন তা হচ্ছে সিরিয়া, ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত পারমাণবিক অস্ত্রসংক্রান্ত চুক্তি, উন্মুক্ত বিশ্ববাণিজ্য এবং জলবায়ু বিষয়ে প্যারিস চুক্তি।

এই সব বিষয়ে মাখোঁর বক্তব্যের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। তবে তাঁর যে কথাগুলো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আদর্শিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে তা হচ্ছে, একা একা চলার নীতি (বা আইসোলেনাজিম) এবং তাঁর (মাখোঁর) উগ্র জাতীয়তাবাদ-বিষয়ক বক্তব্য। তাঁর এই বক্তব্যের প্রধান লক্ষ্য অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের অনুসৃত নীতি। কিন্তু এর তাৎপর্য রয়েছে মার্কিন রাজনীতি ও সমাজের বাইরেও। ‘বৈশ্বিক হুমকির কারণে আমরা ক্ষোভ ভয়ের এক সময়ে বাস করছি। আপনারা ভয় ও ক্ষোভ নিয়ে খেলা করতে পারেন, কিন্তু এগুলো কিছুই তৈরি করে না।’

মাখোঁ মার্কিন নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের সামনে সম্ভাব্য দুটি পথ আছে, আমরা একা একা চলার নীতি (বৈশ্বিক দৃশ্যপট থেকে) প্রত্যাহার করতে পারি অথবা জাতীয়তাবাদকে বেছে নিতে পারি। এগুলো আমাদের ভয়ের সাময়িক প্রতিকার হিসেবে প্রলুব্ধকর হতে পারে; কিন্তু আমরা পৃথিবীর জন্য আমাদের দরজা বন্ধ করে দিলেও পৃথিবীর বিবর্তন বন্ধ হয়ে যাবে না। এটি আমাদের নাগরিকদের ভীতির আগুন নেভাবে না, বরং তা আরও বাড়িয়ে তুলবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিকে বড় করি, তবে আমরা আরও শক্তিশালী হব। আমরা এই বিপদগুলো মোকাবিলা করতে পারব।’ আরও সমৃদ্ধির আশায় উগ্র জাতীয়তাবাদের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডকে উসকে দিয়ে বিশ্বকে এলোমেলো না করতেও তিনি আহ্বান জানান।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০১৬ সালে ট্রাম্পের বিজয় এবং গত কয়েক বছরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী, অভিবাসীবিরোধী দক্ষিণপন্থীদের ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় থেকে এটা স্পষ্ট, কীভাবে জাতীয়তাবাদের আড়ালে একধরনের বিচ্ছিন্নতার এবং ঘৃণার রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু এ ধরনের জাতীয়তাবাদের উত্থান অবশ্যই কেবল এই দুই মহাদেশেই সীমিত থেকেছে তা নয়, বিশ্বের অন্যত্রও তা সহজেই লক্ষণীয়। ভারতে বিজেপির আদর্শিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক বার্তা এর চেয়ে ভিন্ন নয়। বাংলাদেশেও জাতীয়তাবাদ যে ক্রমাগতভাবে অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছে এবং সমাজের ভেতরে বিভিন্নভাবে বিভাজনের উপাদানে পরিণত হয়েছে, সেটা অস্বীকারের উপায় নেই।

এর বিপরীতে অংশগ্রহণমূলক সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শের অনুপস্থিতি না থাক, তার প্রচার ও প্রসার যে নেই, সেটা অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো দেশ যুক্তরাষ্ট্র নয়, কেননা উগ্র জাতীয়তাবাদের রথে চড়েই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর ক্ষমতায় টিকে থাকার উপায় হচ্ছে এই জাতীয়তাবাদের আগুনকে বহাল রাখা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তাতে ঘি ঢালা। ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ যখন বলেন, নতুন বলশালী ক্ষমতা, মানবমুক্তির আদর্শকে বর্জন এবং জাতীয়তাবাদের বিভ্রমের ব্যাপারে তাঁর কোনো মোহ নেই, তখন সবার উচিত হবে তাঁদের নিজেদের চারপাশে তাকানো।

বৈশ্বিক ক্ষমতাকাঠামোতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে, সেটা আমাদের সবারই জানা। এই পরিবর্তনের বিষয়ে মাখোঁর বক্তব্য লক্ষণীয়। তিনি মনে করেন, পশ্চিমা দেশগুলো যদি যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তবে ওই জায়গাটি অবশ্যই শূন্য থাকবে না এবং অন্যান্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী শক্তি, যাদের কৌশল রয়েছে, তারা সেই জায়গা দখল করবে। এই শক্তিগুলো তাদের মডেলেই বিশ্বব্যবস্থাকে গড়ে তুলবে। মাখোঁ একে আশঙ্কা হিসেবে দেখলেও বাস্তবতা হচ্ছে, ইতিমধ্যেই তা ঘটতে শুরু করেছে। একাদিক্রমে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে আকাঙ্ক্ষী দেশ এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাদের সেই প্রচেষ্টায় সফল হচ্ছে বললে অতিরঞ্জন হবে না। তার অন্যতম কারণ পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতি এবং বিরাজমান বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ত্রুটি।

জলবায়ু বিষয়ে প্যারিস চুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসার যে প্রত্যাশা ফরাসি প্রেসিডেন্ট করেন, সেটা কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত মনে করতে পারে না। এখন নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতির যে প্রেসক্রিপশন মাখোঁ দিচ্ছেন, তা যথেষ্ট মনে করার কারণ নেই। বিশ্বায়নের ফলে যে বৈষম্যমূলক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেই বিষয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করুন অথবা না করুন, তাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই।

মাখোঁর এই বক্তৃতা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খামখেয়ালিপূর্ণ একলা চলো নীতি কতটা বিচ্ছিন্ন এবং সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তা কতটা অগ্রহণযোগ্য।

প্রথম আলো’তে প্রকাশিত ২৭ এপ্রিল ২০১৮

Leave a Reply