April 20, 2024

 

অমর একুশের গ্রন্থমেলা এখন আর বাংলাদেশের একমাত্র বই মেলা নয়, কিন্ত এই বই মেলা যে সবচেয়ে বড়, এবং দেশের প্রধান বই মেলা সেকথা অনস্বীকার্য। এর কারণ একাধিক। প্রথমত এই মেলার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। একার্থে এই বই মেলার সূচনা হিসেবে আমরা ১৯৭২ সালে মুক্ত্রাধারার স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহার একক উদযোগকে চিহ্নিত করতে পারি। এই প্রচেষ্টা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ১৯৭৯ সালে দেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলোর প্রতিষ্ঠান ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র মাধ্যমে। সমসাময়িককালে বাংলা একাডেমী এর সঙ্গে যুক্ত হয়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে তার সংযুক্তি। যদিও ১৯৮৩ সালে একে ‘অমর একুশের গ্রন্থ মেলা’ বলে নামকরণ করা হয়, কিন্ত দীর্ঘ দিন ধরেই এই বইমেলা ভাষা আন্দোলন এবং একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বলেই জনমানসে প্রতিভাত হয়েছে। এই সংযুক্তির ধারনা একাদিক্রমে সময় এবং স্থানের কারণে । কিন্ত তার চেয়ে বেশি বোধকরি লেখকদের কারণে। তাঁরা বইমেলাকে একুশের মর্মবস্তর সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন, সেই মর্মবস্ত হচ্ছে বাধাবিঘ্নকে অস্বীকার করে নিজের কথা বলা, নতুন কথা বলা; যা সহজে উচ্চারিত নয় তাকে বাঙময় করে তোলা। একুশের গ্রন্থ মেলার এই দিকটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এটি চিন্তার ক্ষেত্রে বৈচিত্রের, বিভিন্নতার উপস্থিতির স্বীকৃতি।

যে কোন বইমেলার অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে যে তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় চিন্তার ক্ষেত্রে কত বৈচিত্র থাকতে পারে। পাঠাগারে, এমনকি বইয়ের দোকানেও সাধারণত বই সাজানো হয় বিষয় ধরে। কিন্ত বইমেলায় প্রকাশকদের স্টলে কত বিচিত্র রকমের বই পাশাপাশি জায়গা করে নেয়। লেখকদের মনের কথা, গবেষণার ফলাফল কত ভিন্নভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হতে পারে সেটা আমাদের চোখের সামনে হাজির হয় বইমেলায়। কত সহজেই কবিতার পাশে জায়গা করে নেয় গবেষণালবদ্ধ বিষয়, কথাসাহিত্যিকের চোখে সমাজের চিত্রের গা ঘেঁষে ব্যঙ্গ রচনার উপস্থিতি কিংবা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পাশে স্মৃতিকথারা সহজেই জায়গা করে নেয়। আমরা বলতে পারি যে, এ হচ্ছে আমাদের জীবনেরই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। সবই কী আসলে একটি জীবনের কাহিনী? সবই কি আসলে সময় ও জীবনকে বুঝতে পারার চেষ্টার ফসল? ফলে সৃষ্টিশীলতার বিবেচনায়, তার বৈচিত্রের বিবেচনায় বই মেলা হচ্ছে একটি সমাজের ছবি। এটা বিশেষ করে বলা যায় জাতীয় গ্রন্থমেলার ব্যাপারে। পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে আন্তর্জাতিক বই মেলা আয়োজিত হয়, কিন্ত অমর একুশের গ্রন্থমেলা তার সমগোত্রীয় নয়। আমার জানা বইমেলাগুলোর মধ্যে ওয়াশিংটনে লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস আয়োজিত ন্যাশনাল বুক ফেয়ারের সঙ্গে এর তুলনা হতে পারে।

বই মেলায় গেলে পাশাপাশি সাজানো বইয়ের দিকে তাকালে বইমেলার আরেকটি বৈশিষ্ট সহজেই চোখে পড়ার কথা, তা হল সহিষ্ণুতা। একই বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, প্রতিদ্বন্দ্বী বক্তব্যের বইয়েরা নির্বিবাদে সহাবস্থান করে, যেমন সমাজে থাকার কথা, রাষ্ট্রে থাকার কথা।  বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে ১৯৭২ সালে যে মেলার সূচনা হয়েছিলো, গত কয়েক দশক ধরে যা অব্যাহত থেকেছে তার মর্মবস্ত যদি কিছু থাকে তা হচ্ছে এই পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের সহাবস্থান। কিন্ত গত কয়েক বছরে আমরা ক্রমাগতভাবেই তার অবসান প্রত্যক্ষ করছি। ২০১৫ সালে বইমেলা থেকে ফেরার পথে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন অভিজিৎ রায়। উগ্র ইসলামপন্থীরা অভিজিৎ রায়ের রচনাকে ইসলামবিরোধী এবং নাস্তিকতার প্রচার বলে অভিযোগ করে তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিলো। একই বছরে একাডেমী কর্তৃপক্ষ রোদেলা প্রকাশনীর প্রকাশিত একটি বইকে ‘আপত্তিকর’ বলে বিবেচনা করে প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয়। ২০১৬ সালের বইমেলার আগেই একাডেমীর মহাপরিচালক উস্কানীমূলক বই না প্রকাশের জন্যে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমরা চাই প্রকাশকরা এমন কিছু বই প্রকাশ না করুন, যেটা উস্কানিমূলক। আর এ ধরনের কিছু করা হলে অঘটন ঘটতে পারে। অঘটন অবশ্য ঘটেছিলো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টলটি বন্ধ করে দেয় পুলিশ, ঐ প্রকাশনীর বেশ কয়েকটি বই জব্দ করে এবং আটক করা হয় প্রকাশনের সত্ত্বাধিকারী শামসুজ্জোহা মানিক, মুদ্রাকর ফকির তসলিম উদ্দিন কাজল ও বিপণন কর্মকর্তা শামসুল আলমকে। বইটির অনলাইন সংস্করণ থাকায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। এর পাশাপাশি বই মেলায় অংশগ্রহণের জন্য বাংলা একাডেমির যে নীতিমালা তাতেও একই ধরণের শর্ত যুক্ত হয়ে আছে। নীতিমালার ১৩ অনুচ্ছেদের ১৩ ধারায় বলা হয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো কথা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, সামাজিক নিরাপত্তা ধ্বংস বিঘ্নিত করতে পারে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড উপলক্ষে কোনো বই প্রকাশিত হলে, সেই বই মেলায় আনতে পারবে না। এই ধারানুযায়ী একই বই নীতিমালাবিরুদ্ধ বিবেচিত হলে প্রকাশনী সংস্থাটি বইটি মেলা থেকে তুলে নিতে অনুরোধ করবে এবং তুলে না নিলে একাডেমি ঐ প্রকাশনী সংস্থাটির বরাদ্ধ স্টলটি বাতিল করতে পারবে। ২০১৭ সালের বই মেলার আগে স্টল বরাদ্দ নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয় যখন শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রধান রবিন আহসানের বক্তব্যের সূত্র ধরে শ্রাবণ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ করা হয় নি। এই নিয়ে সমালোচনার মুখে একাডেমী তার সিদ্ধান্ত বদল করে। এই সব ঘটনার মধ্যে আমরা সহজেই সহিষ্ণুতার বিপরীতে অবস্থানের দিকটি দেখতে পাই।

এতদিন বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থীরা ক্ষূব্ধ হতে পারে এবং এমনকি আক্রমণ করতে পারে এই আশঙ্কায় একাডেমী কর্তৃপক্ষ এবং সরকার এই সব ব্যবস্থা নিচ্ছে। এগুলোকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলেই দেখান হয়েছে। কিন্ত ২০১৭ সালে যখন পুলিশের পক্ষ থেকেই নজরদারির কথা বলা হয় তখন বুঝতে হবে যে এতদিন যে রাষ্ট্র বহির্ভূত উগ্রপন্থীদের হুমকির কথা বলা হচ্ছিলো এখন তা রাষ্ট্রের নীতিতেই পরিণত হয়েছে। মেলা শুরুর আগেই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার যখন সাংবাদিক সম্মেলন করেই ‘মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে উসকানি দেয়, এমন বই প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান’ জানান তখন এর ভিন্ন কোনো অর্থ করার সুযোগ থাকেনা। তিনি বলেন, এমন বই প্রকাশ করা যাবে না। প্রকাশ করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, ‘এ বিষয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুলিশ নজরদারি করবে।‘ তিনি এই আশা প্রকাশ করেন যে লেখক-প্রকাশক ও বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বই পর্যবেক্ষণ করে মেলায় ওঠাবে (প্রথম আলো, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)। অতীতে বাংলাদেশের লেখকরা তাঁদের মত প্রকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র-বহির্ভূত উগ্র ইসলামপন্থীদের চাপাতি এবং আইনী বলে বলীয়ান ম্যাজিস্ট্রেটদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এখন বইমেলার এই সব ব্যবস্থা এই ধারনাই দিচ্ছে যে এই দুইয়ের মধ্যে দূরত্বের অবসান হয়েছে। পুলিশের প্রত্যাশা যে পূরন হয়েছে সেটাও আমরা জানতে পারি ১৪ ফেব্রুয়ারি — ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার বলেছেন, ‘আমরা  উস্কানিমূলক কোনও বই  এখনও পাইনি’ (ঢাকা ট্রিবিঊন, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)।

ফলে বইমেলার যে মৌলিক বৈশিষ্ট একে অন্য যে কোনো মেলা থেকে আলাদা করে আমরা এখন একুশের গ্রন্থমেলায় তার অবসানই প্রত্যক্ষ করছি কিনা সেই প্রশ্ন তোলা দরকার। যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বই মেলার খবর রাখেন – আন্তর্জাতিক বা জাতীয় — তারা এটা জানেন যে, যে সমাজে চিন্তার দ্বার রুদ্ধ করে দেয়া হয়নি, সেখানে বই মেলায় ভিন্ন মতের, পথের বই নিয়ে হাজির হন প্রকাশকরা। বইমেলা সেই অর্থে সমাজের জানালা; যে সমাজে চিন্তার স্বাধীনতা যত বিস্তৃত প্রকাশিত বইয়ের ক্ষেত্রে আমরা তত বেশি ভিন্ন মতের বই দেখতে পাই। এটা সংখ্যার বিষয় নয়, চিন্তার ব্যাপ্তি ও পার্থক্যের বিষয়। স্বাধীন চিন্তার সমাজে দেখবো একই ইতিহাস, একই প্রপঞ্চ, একই সমাজ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিশ্লেষিত হচ্ছে – কেননা চূড়ান্ত বলে কোন কিছু নেই, সময় বেধে দেয়া নেই কোন বিষয়ে কত দিন কী বলা যাবে। কিন্ত যে সমাজে চিন্তার পথ রুদ্ধ, নতুন ভাবনার পথ কন্টকিত সেখানে মেলার আকার বড় হতে পারে, প্রদর্শিত বইয়ের সংখ্যা বেশি হতে পারে কিন্ত তা আসলে অগ্রসরমানতার লক্ষণ নয়। মনে রাখা দরকার বই মেলা যতটা বইয়ের মেলা তার চেয়ে বেশি একটি সমাজের জানালা।

চারুপাতা’য় প্রকাশিত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

Leave a Reply