June 10, 2023
Home / কথকতা / যে নির্বাচনে সবাই পরাজিত, কেবল…

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে এমন এক নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে অনেকেই নির্বাচিত হন, কিন্তু কেউ বিজয়ী হন না। উপরন্তু, এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরাজিত হন সবাই—ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, ব্যবস্থা। বিজয়ীর তালিকাকে শূন্য রেখে, পরাজিতের তালিকা দীর্ঘ হয়ে উঠছে। প্রতিটি নির্বাচন যেভাবে ‘কলঙ্কিত’ বিশেষণে বিভূষিত হচ্ছে, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে গণমাধ্যমগুলো এই বিশেষণের সমার্থক শব্দের অভাবেই পড়বে বলে আশঙ্কা করি। গত সোমবার ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচনের নামে যা হয়েছে, তাতে এ তালিকায় আরেকটি অধ্যায় যুক্ত হয়েছে।
সোমবার রাতে বিভিন্ন ছাত্রাবাসের এবং গতকাল মঙ্গলবার ভোরে ডাকসুর যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তাতে নির্বাচন বর্জনের পরও ডাকসু সহসভাপতি পদে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা নুরুল হকের নির্বাচিত হওয়া এ নির্বাচনের কলঙ্কের কালিমাকে কোনোভাবেই হ্রাস করেনি। আক্ষরিক অর্থেও যদি বিবেচনা করি, তবে আমরা দেখব, প্রতিদ্বন্দ্বীদের কেউ অকুণ্ঠচিত্তে বলছেন না, ‘আমরা বিজয়ী হয়েছি’।
সোমবার নির্বাচন শেষ হওয়ার আগে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ছাত্রলীগ ছাড়া সবাই এই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করে তা বর্জন করেছিল এবং নতুন নির্বাচনের দাবি করেছিল; গতকাল ভোররাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান যখন নির্বাচনের ফল ঘোষণা করেন, সে সময় একে ‘ভুয়া’ বলে স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা বিক্ষোভ করেছেন। অর্থাৎ এই নির্বাচন তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে ফল ঘোষণার আগেই এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এই নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে অবিলম্বে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হোক।’
নির্বাচনের ঘটনাবলি, অনিয়মের চিত্র, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ এবং প্রতিবাদের বিস্তারিত সবার জানা, তাই তার পুনরুল্লেখ বাহুল্য। এত কিছুর মধ্যে যে একজন মানুষ ‘আনন্দিত অনুভব’ করেছেন, তিনি হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অথচ যে নির্বাচনে তিনি আনন্দিত, সেই একই নির্বাচন নিয়ে তাঁর সহকর্মী প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অন্ততপক্ষে ‘বিব্রত’, একটি ছাত্রীবাসে নির্বাচনের শুরুতেই ‘সিল মারা’ কয়েক শ ব্যালট পেপার পাওয়ার পরে সহ-উপাচার্য বলেছিলেন, ‘এই অনিয়মের দায়দায়িত্ব আমরা অস্বীকার করতে পারব না।’
Eprothom Aloডাকসু নির্বাচনের সংঘটিত অনিয়মগুলো হঠাৎ করে ঘটে গেছে বা ব্যক্তিবিশেষের দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে ঘটেছে, তা নয়। ‘সিল দেওয়া’ ব্যালট পেপার, হলে ব্যালটভর্তি বাক্স উধাও হয়ে যাওয়া, ব্যালটে কোনো রকম নম্বর না দেওয়া, আপত্তি সত্ত্বেও রাতেই ছাত্রাবাসে ব্যালট পাঠানো, অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বাধাগুলো অপসারণ না করা, ছাত্রলীগের কর্মীদের দিয়ে দীর্ঘ লাইন তৈরি হওয়ায় বাধা না দেওয়া—এগুলো পরিকল্পিত ঘটনা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া এগুলো সম্পাদন সম্ভব ছিল না। উপাচার্য এবং তাঁর সহযোগী শিক্ষকেরা যেভাবে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের বিজয় নিশ্চিত করতে তৎপর থেকেছেন, তাতে করে তাঁরা এখন কিছু ফলের দিকে অঙ্গুলিসংকেত করে একে ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন বলে দেখাতে চাইলেও তাঁদের ভূমিকার লজ্জাজনক দিক উধাও হয়ে যায় না।
স্বাধীনতার পরে এই প্রথমবারের মতো একটি ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, যা প্রশাসনের কারণে কেবল বিতর্কিত নয়, কলঙ্কিতও হয়েছে। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকদের দ্বারা অস্ত্রের মুখে ডাকসুর ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ন্যক্কারজনক ঘটনার চেয়েও এই ঘটনা বেশি দুর্ভাগ্যজনক ও ক্ষতিকারক। কেননা, এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে প্রশাসন এবং শিক্ষকেরা। এটি হচ্ছে একাদিক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার শিক্ষকদের পরাজয়।
দলীয় বিবেচনাপ্রসূত হয়ে শিক্ষক ও প্রশাসনের এই আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত, কিন্তু বিস্ময়কর নয়। কেননা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পর্যায়ে দলীয়করণের যে ধারা—কয়েক দশক ধরে, বিশেষ করে এক দশক ধরে—তৈরি হয়েছে, সেখানে শিক্ষকেরা কেবল দল নয়, দলের ছাত্রকর্মীদের হাতেই বাঁধা পড়ে আছেন। আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে আমার বলা কথাগুলো আবারও বলতে হচ্ছে, ‘দলীয় আনুগত্যের কারণে শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রকর্মীদের সম্পর্ক শিক্ষক-ছাত্রের চেয়ে একই দলের সহযোদ্ধার মতো। তদুপরি ক্ষমতাসীনদের কাছে ছাত্রনেতারা যত সহজে পৌঁছাতে পারেন, একই দলের অনুগত শিক্ষকেরাও প্রায়ই সেই সুযোগ পান না। ফলে ছাত্রনেতারা হয়ে ওঠেন তাঁদের যোগাযোগের বাহন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধরনের সম্পর্ক ও যোগাযোগ ব্যবহারও নতুন ঘটনা নয়। দলীয় বিবেচনায় প্রশাসনিক পদে নিযুক্তির কারণে নিয়োগকৃতদের রক্ষা করার অলিখিত দায়িত্ব বর্তায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা ও কর্মীদের ওপরে’ (‘আকাশ ভেঙে পড়েনি’, প্রথম আলো, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। এই নির্বাচনে দেখা গেল, এখন শিক্ষকেরা তার প্রতিদান দিচ্ছেন।
কিন্তু শুধু তা–ই নয়, ডাকসু নির্বাচনের এই কলঙ্কজনক অধ্যায় হচ্ছে দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করার যে প্রক্রিয়া চলছে—যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন—তারই অংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক শিক্ষকেরা বুঝেশুনেই এটা করেছেন। কেননা, এখন এটা প্রমাণ করা দরকার যে নির্বাচনী প্রক্রিয়াটিই আসলে আর কাজ করছে না; ফলে এটিকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া দরকার। দুর্ভাগ্য, এ কাজের জন্য তাঁদের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সবার সামনেই সক্রিয় হতে হলো। জোর করে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে হারিয়ে দেওয়ার যে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, তার পরিণতি কী হবে, তা আমরা অনুমান করতে পারি মাত্র।
সারা দেশে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের মর্মবস্তুর অবসান ঘটানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। দলীয়করণের এ ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে সাধারণের প্রত্যাশা এখনো টিকে আছে, কেননা সেখানে এখনো কিছু শিক্ষক আশা জাগিয়ে রাখেন, আর আছেন শিক্ষার্থীরা। সেই আশার কতটা বাস্তব আর কতটা স্বপ্নতাড়িত, তা নিয়ে বিতর্ক করা যায়, কিন্তু এটা অস্বীকার করা যায় না যে বাংলাদেশের নাগরিকদের এক বড় অংশ এখনো সেই ধারণা দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়। ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই আশার জায়গাটিকেই ভেঙে ফেলার চেষ্টা হলো।
এভাবে ব্যক্তি উপাচার্য, গোষ্ঠীগতভাবে শিক্ষকেরা, ব্যবস্থা হিসেবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরাজয় ঘটেছে এই বিতর্কিত নির্বাচনে।
পরাজয়ের এই দীর্ঘ তালিকা সত্ত্বেও বিজয়েরও ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীবাসের শিক্ষার্থীরা সকাল থেকেই যেভাবে সাহসিকতার সঙ্গে সব ধরনের সাজানো কলাকৌশলকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, সেটাই হচ্ছে বিজয়ের ইঙ্গিত, আশার জায়গা—অনেক পরাজিতের মাঝখানে কেবল তাঁরাই এই নির্বাচনে বিজয়ী।

প্রথম আলো’তে প্রকাশিত ১৩ মার্চ ২০১৯

Leave a Reply