২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ভেঙ্গে পড়ার এবং ১১৩৫টি তাজা প্রাণ হত্যার এক বছর পেরিয়ে গেল। বিগত একটি বছরজুড়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রমিক নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণ নিয়ে যত কথা হয়েছে, স্বাধীনতার পরে বোধকরি আর কোন সময়েই এতটা হয়নি। রানা প্লজার ঘটনা, তাজরিন গার্মেন্টস-এ অগ্নিকান্ডে আহত, নিহতদের ক্ষতিপূরণ প্রশ্নের সমাধান হওয়ার আগেই এসে গেছে। তারও আগের স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ঘটনারও কোন সুরাহা এখনো অবধি হয়নি। এই তিনটি সাম্প্রতিক বৃহৎ হত্যাযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্টে একাধিক মামলা বিদ্যমান রয়েছে- যার মধ্যে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ, ইমারত নির্মাণ আইনের বিধি-বিধান প্রতিপালন নিশ্চিত করাসহ আরও অনেক বিষয় রয়েছে। বিদ্যমান শ্রম আইনে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, বেতন ও অন্যান্য সুবিধা, মৃত্যু ও শারীরিক ক্ষতির জন্যে যে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছে তা যেকোন দেশের তুলনায় কম। সাম্প্রতিক সময়ের শ্রমিক হত্যাকান্ডের ব্যাপকতার কারণে বিদ্যমান ক্ষতিপূরণের যে পরিমাণ আইনে বলা আছে তাতে কেউ সন্তুষ্ট নন বলেই এখনও মহামান্য হাইকোর্টে ক্ষতিপূরণ নিয়ে মামলাগুলো চলছে। বিজেএমইএ কিংবা অন্যান্য সংস্থা তাই ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে বলে সাম্প্রতিক সময়ে যে দাবী করছে তা মোটেও সত্য নয়। যে আর্থিক সহায়তা এ পর্যন্ত দেয়া হয়েছে তা কেবল দান, ক্ষতিপূরণ নয়। ক্ষতিপূরণ শ্রমিকের অধিকার। দান হল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নিভরশীল বিষয়। বিদ্যমান আইনে যে ক্ষতিপূরণের কথা বলা আছে তা যদি অপ্রতুল হয়, তবে তা হয় আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে কিংবা মহামান্য আদালতের আদেশের মাধ্যমে পরিবর্তন হতে পারে। মহামান্য আদালত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারেন এবং সরকারসহ অন্যান্য পক্ষগণকে প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে পারেন। তাই আদালতে বিদ্যমান মামলাগুলোর নিস্পত্তি হওয়া সবার স্বার্থেই খুব জরুরী।
বিগত ২২ জুলাই, ২০১৩ইং সরকার ২০০৬ সালে প্রবর্তিত শ্রম আইন সংশোধিত আকারে পাস করে। এই নতুন সংশোধনীতে যেমনটি আশা করা হয়েছিল যে, রানা প্লাজার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশের চাপে হলেও শ্রমিকদের কল্যাণে ক্ষতিপূরণ, বেতন বৃদ্ধি, চাকরির নিশ্চয়তাসহ অনেক সুবিধা দেয়া হবে কিন্তু সেরকম কোন পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয়নি। শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার দেয়ার জন্যে শ্রমিকদের যে দীর্ঘদিনের দাবী সেটি এবারও উপেক্ষিত। তদুপরি এই আইনে নিয়মিত ও স্বীকৃত শ্রমিকদের বিষয় ব্যতীত অনিয়মিত, বা ইনফর্মাল শ্রমিকদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে তেমন কিছুই বলা হয়নি। ২০১৩ সালের সংশোধনীতে দেখা যায়, মূল আইনের ধারা ৪(ক)(১)(ঙ)(চ) এর পরিবর্তন করে (ঙ)(চ) ও (ছ) সন্নিবেশন করা হয়েছে। এতে শিক্ষানবীশ ও স্থায়ী শ্রমিকের পাশাপাশি মৌসুমি শ্রমিককেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একই ধারার দফা ১১-এ মৌসুমি শ্রমিকের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে- “কোন শ্রমিককে মৌসুমি শ্রমিক বলা হইবে যদি কোন প্রতিষ্ঠানে মৌসুমকালে কোন শ্রমিককে মৌসুমি কাজে নিয়োগ করা হয় এবং মৌসুম চলাকালীন পর্যন্ত কর্মরত থাকেন।” এই সংজ্ঞায়ণের সাথে সাথে তাদের অপরাপর সুযোগ সুবিধাগুলোও যদি বিবেচনায় আনা হত তাহলে এই অন্তর্ভুক্তির সুফল এই অনিয়মিত শ্রমিকরা পেতেন। যেহেতু এসব শ্রমিক নিয়মিত শ্রমিক নন তাই এদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় এই ইনফর্মাল শ্রমিকদের শ্রমের মূল্যায়ন হয় না। অথচ ২০১০ সালে পরিচালিত এডিবি’র একটি সমিক্ষায় দেখা গেছে মোট শ্রম বাজারের ৮৯ শতাংশ দখল করে ছিল এই অনিয়মিত শ্রমিকগণ। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সমীক্ষায় তারা দাবী করেন, মোট শ্রম বাজারের ৭৮ শতাংশ অনিয়মিত শ্রমিক। সংখ্যা বিচারে দুটি সমীক্ষার যেকোন একটিকেও যদি প্রামান্য হিসেবে ধরি তাহলেও এটি সম্পূর্ণ শ্রম বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কথা। কিন্তু, যেহেতু এই অনিয়মিত শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্রগত ভিন্নতা ও সংগঠিত না হওয়ার ফলে এই সামগ্রিক বিশাল সংখ্যা কাজের ক্ষেত্রে কোন সুযোগ সুবিধা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে না, অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করাতো দূর অস্ত। ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিকদের ক্ষেত্রে যেমন, তারা সংগঠিত হতে পারেন বিধায় এক সাথে দাবী দাওয়া আদায়ে অন্তত সংগঠিত আওয়াজ তুলতে পারেন। এই আন্দোলন সংগ্রাম ক্ষেত্রবিশেষে, দাবী আদায়ে সক্ষম, তা আমরা অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি।
অনিয়মিত শ্রমিকদের সংখ্যা শহরের তুলনায় গ্রামেই বেশী। তৈরিপোশাক শিল্পের মত অনিয়মিত শ্রমিকদের মধ্যেও নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশী দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলে কৃষি ও অকৃষি উভয় ক্ষেত্রেই এই অনিয়মিত শ্রমিকদের অংশগ্রহণ থাকে। সাধারণত দেখা যায় যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা নাই তারাই মূলত অনিয়মিত শ্রমিক হন। যে রিক্সা শ্রমিকটি সারা বছর রিক্সা চালান, সেই তিনিই হয়ত ধান চাষের মৌসুমে রিক্সা চালানো বাদ দিয়ে ধান চাষ করেন। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে যিনি শ্রম দেন, যিনি বর্ষা মৌসুমে ছাতা সারাই করতে বের হন, যিনি শহরে বন্দরে ঘুরে ঘুরে নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় সামগ্রি ফেরি করে ফেরেন, যিনি রাস্তার ধারে সারাদিন হাতুরির ঠোকাঠুকি করে ইট ভাঙেন বা যিনি বিনা বেতনে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন, তারা সবাই অনিয়মিত হলেও দেশের অর্থনীতিতে নিজস্ব উদ্যেগে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে তারা বিপুল অবদান রেখে চলেছেন। দেশের অর্থনীতিতে অবদান কেবল নয় এই অনিয়মিত শ্রমের ফলে দেশের বিপুল বেকারত্ব নিরসনেও তাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। অথচ আইএলও এর একটি সমীক্ষায় দেখা যায় বিগত ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল এই সময়ের মধ্যে ফর্মাল সেক্টরে কেবলমাত্র ০.৬ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের ইনফর্মাল সেক্টরে চাকুরীর স্থায়িত্ব যেমন নেই, তেমনি নেই তাদের বেতন, পেনশন, স্বাস্থ্য, বীমা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। এই বিশাল অদক্ষ শ্রমিকশ্রেণীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কর্মশক্তিতে রুপান্তরের জন্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন উদ্যেগও নেই। আইনে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও অনিয়মিত শ্রমের ক্ষেত্রে শিশুশ্রম একটি নিয়মিত ঘটনা। বিনা বেতনের গৃহকর্মী কিংবা বিড়ি তৈরির কারখানায়, জাহাজভাঙ্গা শিল্পে শিশুশ্রম এখনও নিয়মিত ঘটনা। বাংলাদেশের সংবিধান শিশুদের জন্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বললেও কার্যত এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়নি। তাছাড়া, একজন পরিপূর্ণ বয়স্ক নাগরিকের মত শিশুদের যেসব অধিকার ভোগ করার কথা তার সিকিভাগও বাস্তবে দেখা যায় না। এ কেবল আর্থিক দৈন্য নয় চিন্তারও দৈন্যতা বটে।
অনিয়মিত শ্রমিকদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ার ফলে শ্রমিকদের কাজের সময় নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হয় না। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী নিয়মিত শ্রমিকদের কাজের সময় ৮ ঘণ্টা এবং এর বাইরে দ্বিগুণ মজুরির বিনিময়ে অতিরিক্ত ২ ঘণ্টা শ্রমের কথা বলা হলেও নিয়মিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেবারের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম মানা হয় না। আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিতে নাগরিকদের স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার পায় না বলে প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে এমন অনেক নিয়ম আছে যা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য হয় না। যেমন ধরা যাক, তৈরিপোশাক শিল্পের কথা, সেখানে একজন শ্রমিক কাজে ঢোকার পর চারঘণ্টার মধ্যে জলপান করা কিংবা টয়লেটে যাওয়ার সুযোগ নেই। অথচ, বিশ্বের অন্যান্য দেশে স্বাস্থ্য নীতির কারণেই একটানা চারঘণ্টার বেশী কাউকে পরিশ্রম করানো যাবে না। চারঘন্টা পর কাজে বিরতি দেয়া স্বাস্থ্যের কারণে বাধ্যতামূলক। বেশীরভাগ কারখানা যেখানে জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সেখানে সবাই তালাবদ্ধ থেকে কাজ করতে বাধ্য হন। তাজরিন গার্মেন্টস-এ বিপুল পরিমাণ প্রাণহানির পেছনে অন্যতম কারণ ছিল, ফতকে তাল্লা ঝুলিয়ে রাখা। মালিকের চিন্তা যেখানে তার মালামাল চুরি হয়ে যাওয়া ঠেকানো, সেখানে শ্রমিকের প্রাণসংহার হতেই থাকবে। নিয়মিত শ্রমিকের ক্ষেত্রেই যখন এই অবস্থা তখন অনিয়মিত শ্রমিকের কপালে কি জুটছে তা সহজেই অনুমেয়। অনিয়মিত শ্রমিকদের যদি প্রশিক্ষিত করে তোলা যায় তাহলে এই বিশাল শ্রমিকশ্রেণী পুরো দেশের অর্থনীতির চিত্র বদলে দিতে পারে। চাই শুধু যথাযথ পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়ন।
৩ মে, অষ্ট প্রহর, বণিক বার্তা।