ভূমির অধিকার ও ন্যায্য হিস্যার অধিকারের জন্য এ দেশের মানুষ সংগ্রাম করে এসেছে সুদীর্ঘ কাল থেকে। সেসব সংগ্রামে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেছে। এই যুগপত্ নেতৃত্ব কালে কালে আমাদের অনুপ্রেরণা জুুগিয়েছে। আমরা যদি ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় থেকে বিবেচনা করি, তাহলে সিধু-কানু-চাদ-ভৈরবদের সঙ্গে তাদের দুই বোন ফুলো মুরমু ও ঝুনো মুরমুদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঝাড়খণ্ডের সেই বিদ্রোহ মূলত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘটিত স্বাধিকারের বিদ্রোহ। সাঁওতালদের ভূমির ওপর অনাবশ্যক করারোপ এবং স্থানীয় মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল সেই সংগ্রাম, যা তত্কালীন ব্রিটিশ সরকারকে ব্যাপক নাড়া দিতে পেরেছিল। বৃহত্তর পরিসরে আন্দোলনের যে রূপ, তার প্রভাব ভারত ভাগের পরে উভয় দেশের রাজনীতিতেও পড়েছে। ১৯৪৬-৫০ সালের কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ইলা মিত্র সে রকমই একটি নাম, যা এ দেশের মানুষকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাবে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামেও আমরা দেখেছি, শাসকদের অত্যাচারের কিংবা ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি অন্যতম হাতিয়ার নারীদের প্রতি শারীরিক নির্যাতন। একাত্তরে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসররা এ দেশে নারীদের ওপর যে নারকীয় অত্যাচার, ধর্ষণ, খুন চালিয়েছে, তা ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে আছে। নারীদের প্রতি সেই ভয়াল অত্যাচার অন্য নারীকে সংকুচিত করেনি, বরং তাকে চলমান মুক্তির যুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বলা বাহুল্য, নারীর প্রতি শাসকদের অত্যাচার বরাবরই বীভত্স কিন্তু ইলা মিত্রের প্রতি সংঘটিত অত্যাচার সে সময়ে বোধহয় সবচেয়ে নৃশংস ও অকল্পনীয় ছিল। তেভাগা আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে রাজশাহী আদালতে ইলা মিত্র যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তাতে তিনি অকপটে উল্লেখ করেছিলেন তার ওপর পাকিস্তানি পুলিশ কী ধরনের নির্যাতন চালিয়েছিল। তাঁর জবানবন্দির কিছু অংশ শেখ রফিক সম্পাদিত ‘ইলা মিত্রের জবানবন্দি’ বই থেকে উদ্ধৃত করছি—
“যে কামরাটিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো, সেখানে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তারা নানা রকম অমানুষিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালাল। দুটো লাঠির মধ্যে আমার পা দুটি ঢুকিয়ে চাপ দেয়া হচ্ছিল এবং সে সময় চারিধারে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা বলছিল যে, আমাকে ‘পাকিস্তানি ইনজেকশন’ দেয়া হচ্ছে। এ নির্যাতন চলার সময় তারা একটা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিয়েছিল। জোর করে আমাকে কিছু বলাতে না পেরে তারা আমার চুলও উপড়ে তুলে ফেলেছিল। সেপাইরা আমাকে ধরাধরি করে সেলে ফিরিয়ে নিয়ে গেল, কারণ সেই নির্যাতনের পর আমার পক্ষে হাঁটার ক্ষমতা ছিল না।”
“সেলের মধ্যে আবার এসআই সেপাইদেরকে চারটে গরম সিদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিল এবং বলল, ‘এবার সে কথা বলবে’। তার পর চার-পাঁচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিত্ করে শুইয়ে রাখল এবং একজন আমার যৌনাঙ্গের মধ্যে একটা গরম ডিম সিদ্ধ ঢুকিয়ে দিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলাম। এর পর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।”
ইলা মিত্রের প্রতি যে অত্যাচার করা হয়েছিল, তা প্রকাশ পাওয়ার পর বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন সে সময়ের আন্দোলনকারীরা। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করে কৃষকের সরাসরি সরকারের প্রজা করা হয় এবং তেভাগা আন্দোলনের দাবির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ভূমির ওপর কর নির্ধারণ করা হয়।
কৃষক আন্দোলন তথা ভূমির অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ইলা মিত্রের যে অবদান, তা কেবল যে এ দেশের কৃষকদের তাদের ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার জন্য ভূমিকা রেখেছে, তা কিন্তু নয়; দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার আমূল পরিবর্তন হয়েছে তেভাগা আন্দোলনের ফলে, যার সুফল আমরা এখনো ভোগ করছি। যখনই ভূমি অধিকার আদায়ের প্রশ্ন আসে, তখনই এ দেশের নিপীড়িত মানুষের কাছে ইলা মিত্র পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন। তেভাগা আন্দোলনেরই আঙ্গিকে দু’বছর ধরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ভূমির অধিকার আদায়ে আন্দোলন করছে স্থানীয় সাঁওতাল, ওঁরাও ও বাঙালি কৃষকরা, যাদের ১৮৪২.৩০ একর জমি ভূমি অধিগ্রহণের নামে রংপুর চিনিকলের জন্য কেড়ে নিয়েছিল তত্কালীন পাকিস্তান সরকার। ১৯৬২ সালে জমি লিজ দেয়ার যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে উল্লেখ আছে যে, যদি অধিগ্রহণকৃত জমি চিনিকলের প্রয়োজনে ব্যবহার করা না হয়, তাহলে সেসব জমি তাদের প্রকৃত মালিকদের কাছে ফেরত দেয়া হবে। ২০০৪ সাল থেকে সেই চিনিকল বন্ধ আছে এবং মিলের ম্যানেজার সেসব জমি স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে বর্গা দিয়ে জমিদারি কায়দায় লুণ্ঠন চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসন প্রথম থেকে কৃষকদের দাবির প্রতি মৌখিক সমর্থন জানালেও তাদের জমি ফেরত দেয়ার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এ রকম পরিস্থিতিতে আন্দোলনরত কৃষকরা নিরুপায় হয়ে ১ জুলাই প্রাথমিকভাবে ২০০ ঘর নির্মাণ করে তাদের পূর্বপুরুষের জমিতে দখল নেয়। পরবর্তীতে ১১ জুলাই মিল কর্তৃপক্ষ পুলিশ ও লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে নারেঙ্গাবাদ মৌজায় অবস্থান নেয় এবং আন্দোলনকারীদের বাড়িঘর ভাংচুর করে। কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করে। ভূমিহীন জনগণও তীর-ধনুক নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পুলিশের গুলিতে বেলোয়া গ্রামের মাঝি হেমব্রম, বুলাকিপুর গ্রামের মাইকেল মার্ডি, গুচ্ছগ্রামের সোবান মুরমু ও বেলোয়া গ্রামের মুংলী টুডুসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হয় এবং অনেকেই আহত হয়। গাইবান্ধার ঘটনায়ও দেখা যাচ্ছে, নারী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে ভূমির অধিকার আদায়ের জন্য। সময়ের কারণে শাসক পরিবর্তন হলেও শাসন পদ্ধতির মৌলিক পরিবর্তন হয়নি, ফলে মুংলী টুডুদের সংগ্রাম আজো জারি আছে, যেমনটি ছিল তেভাগা আন্দোলনের সময়। সে সময় শাসকরা যে পদ্ধতি বেছে নিত আন্দোলন, সংগ্রামকে দমন করার জন্য, সেই একই রকম পদ্ধতি এখনো বিদ্যমান; শুধু শাসকের স্থলে ভাগের অংশীদার বেড়েছে।
একই রকম লড়াই চলছে উত্তরাঞ্চলের আরো অনেক জায়গায়— দিনাজপুরের পার্বতীপুর থানাধীন চিরাকুটা গ্রামে সাঁওতাল পল্লীতে ভূমির লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নীলিমা হেমব্রম, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমবাগানের ভূমি-সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে ওঁরাও নারী বিচিত্রা তিরকি ধর্ষণের শিকার হয়ে এখনো বিচারের আশায় দিন গুনছেন, হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজলোর চান্দপুর-বেগমখান চা বাগানের ১ হাজার ২৫০ জন চা শ্রমিক পরিবারের ৫১১.৮৩ একর কৃষিজমিতে ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ স্থাপন করার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন করছে আদিবাসীরা। গত ১২ ডিসেম্বর চুনারুঘাট উপজেলা প্রশাসন এ জমির দখল নিতে গেলে শ্রমিকরা তাতে বাধা দেন এবং ১৩ ডিসেম্বর থেকে লাগাতার আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলনেও নারী নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে ভূমির অনুপাত বিবেচনায় নিলে অনুমান করা যায়, আগামীতে অধিকাংশ বিরোধই হবে ভূমি-সংক্রান্ত এবং এসব বিরোধের লক্ষ্য থাকবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তাই আগামীতেও ইলা মিত্র প্রাসঙ্গিক থাকবেন সব লড়াই সংগ্রামে।
ইলা মিত্র ইতিহাসে প্রথম বাঙালি নারী, যিনি পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সফলভাবে নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে ‘মাতলা মাঝি’রা শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভূমির লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ইলা মিত্রের জীবন ও সংগ্রামের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হলে এর অন্য একটি দিক গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে— ইতিহাসে নারীর অবদান স্বীকার করার মধ্যেও পুরুষতান্ত্রিকতা দৃষ্টিকটুভাবে বিদ্যমান। নারীর অবদানকে মহিমান্বিত করার জন্য বীরত্বের যেসব ‘ধারণা’ বা ‘অভিধা’ সৃষ্টি করা হয়েছে, তার মধ্যে পুরুষতান্ত্রিকতা রয়েছে। কেবল পুরুষের সৃষ্ট মাপকাঠিতে নারীর বীরত্ব মাপার প্রবণতা রয়েছে। যে কারণে মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিলের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বর্ণনা হয়— ‘পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধ করেছিলেন শিরিন বানু।’ ফলে অন্য অনেকের মতো নারীর অবদান মানুষের নিত্যদিনের লড়াই সংগ্রামের অবলম্বন হয়ে উঠতে পারছে না। লালনের ‘সামান্যে’র ধারণা যেখানে ‘বিশেষ’-কে সামান্যে পরিণত করে, সেখানে বাস্তবে ‘বিশেষ’ চিরতরে ‘দিবস’ পালনের বাহুল্যে পর্যবসিত হয়। কিন্তু ইলা মিত্রের জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাস যদি সাধারণের জ্ঞানের, বোধের সীমানায় নিত্যদিনের চর্চায় রাখা যেত, তাহলে এ দেশে নারীর যে চলমান সংগ্রাম, তা অনেক বেশি বেগবান হতো। তাছাড়া প্রতিটি নিপীড়িত মানুষের লড়াই সংগ্রামে ইলা মিত্র মিশে থাকতেন তাদেরই একজন হয়ে।
প্রথম প্রকাশঃ বনিক বার্তা
বিশেষ সংখ্যা/কালপুরুষ- পর্ব ৩
২৪শে আগস্ট, ২০১৬।
থাম্বনেইলের ছবির সূত্র: লিঙ্ক