March 29, 2024

২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর যখন আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালিত হচ্ছে সেই সময়ে সারা পৃথিবীর কত শতাংশ মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছেন সেই প্রশ্নই এখন বেশি আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেক দেশে গণতন্ত্রের নামে যা চর্চা হচ্ছে, দৃশ্যত গণতান্ত্রিক মনে হলেও মর্মবস্তর দিক থেকে তা আদৌ গনতান্ত্রিক কিনা, সেই প্রশ্নই এখন প্রধান হয়ে উঠছে। কেননা আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী নেতাদের শাসনের লক্ষণ সুস্পষ্ট, এমনকি স্বৈরাচারী শাসকরাও নিজেদের গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসেবেই দাবি করেন।

২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে যখন আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালনের প্রস্তাব পাশ হয় ততদিনে এই বিষয়ে গবেষক এবং বিশ্লেষকরা প্রায় একমত হয়েছেন যে গণতন্ত্রে ভাটার টান শুরু হয়েছে, কেবল তা কয়েকটি দেশে নয় – বৈশ্বিকভাবেই। সেই প্রেক্ষাপটেই গণতন্ত্র দিবসের বিষয়টি সামনে এসেছিলো। এই ধরণের একটি দিবসের ধারণার উৎস হিসেবে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট কোরাজন একুইনোর ১৯৮৮ সালে সূচিত প্রতিষ্ঠান ‘আইসিএনআরডি’ (দ্য ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সেস অন নিউ এ্যান্ড রেস্টোরড ডেমোক্রেসি, নতুন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র বিষয়ক সন্মেলন)-কে বিবেচনায় নেয়া যায়। কিন্ত ‘আইসিএনআরডি’র সূত্রপাতের সময় বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের যে ইতিবাচক অবস্থা ছিলো এবং ১৯৯১ সালের পরে যে ধরণের আশাবাদ তৈরি হয়েছিলো, ২০০৭ সালে এসে তার অনেকটাই অবসান ঘটে। ১৯৭৪ সাল থেকে গণতন্ত্রের যে ঢেউ উঠেছিলো, যাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন গণতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউ বলে বর্ণনা করেছিলেন, তাতে  ততদিনে উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছে। তা স্বত্বেও সারা দুনিয়া জুড়ে গণতন্ত্রের যে প্রবল ধ্বস নামতে শুরু করবে এবং দেশে দেশে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসকদের উদ্ধত আচরণ দেখতে হবে তা সম্ভবত সেই সময়ে কারও কল্পনায় ছিলোনা।

গণতন্ত্র বিষয়ে যে সব প্রতিষ্ঠান তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এবং বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাঁদের অন্যতম হচ্ছে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস, লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী ইকনোমিস্টের গবেষনা শাখা ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এবং সুইডেনের গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইন্সিটিটিউট (ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি ইন্সিটিটিউট)। ইআইইউ-এর ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে গত বছরের ওপরে আলোকপাত করা হলেও গত ১০ বছরের তুলনামূলক চিত্র দেয়া হয়েছে, ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে গত তেরো বছরে অবস্থার কতটা বদল ঘটেছে সেটা তুলে ধরা, ভিডেম-এর প্রতিবেদনের বিষয় হচ্ছে গত নয় বছরে তারা কি প্রবণতা দেখতে পাচ্ছে। ফলে এই সব প্রতিবেদন থেকে কেবল একটা স্থিরচিত্র পাওয়া যাচ্ছে তা নয়, গণতন্ত্রের সংকটের একটা পথরেখাও পাওয়া যাচ্ছে।

ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ সালে গণতন্ত্রের পশ্চাদযাত্রার ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছে। তাঁদের হিসেব অনুযায়ী ১৯৮৮ থেকে ২০০৫ সাল সময়ে ‘একেবারে উন্মুক্ত নয়’ (নট ফ্রি) বা মোদ্দা কথায় অগণতান্ত্রিক এমন দেশ কমেছিল ১৪ পয়েন্ট – ৩৭ থেকে ২৩ শতাংশ; একই সময়ে ‘উন্মুক্ত’ (ফ্রি) দেশ বা গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা ১৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছিলো ৪৬ শতাংশ। ২০০৫ থেকে ২০১৮ সময়ে এই ধারা গেছে উল্টো দিকে। ‘একেবারে উন্মুক্ত নয়’ এমন দেশের শতকরা ভাগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ শতাংশ, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪ শতাংশ। ফ্রিডম হাউস বলছে, সারা পৃথিবীর ৫৬ শতাংশ মানুষ এমন ধরণের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে বাস করেন যাকে ‘একেবারে উন্মুক্ত নয়’ বা ‘আংশিক উন্মুক্ত’ (পার্টলি ফ্রি) বলে বর্ণনা করা হয়; যার অর্থ তাঁরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বাস করেন না। ইআইইউ বলেছে যে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ বাস করেন এমন শাসন ব্যবস্থার অধীনে যা কর্তৃত্ববাদী বা অথোরিটারিন। ইআইইউ-এর প্রতিবেদনের একটি প্রধান বক্তব্য হচ্ছে যে, এমন দেশ যেগুলো না গণতান্ত্রিক না কর্তৃত্ববাদী – যাকে বলা হয় ‘হাইব্রিড রেজিম’ বা দোআঁশলা শাসন ব্যবস্থা – তার পরিমাণ বেড়েছে। দেখতে গণতান্ত্রিক, কিন্ত আচার-আচরণে স্বৈরাচারী এমন দেশের সংখ্যা গত বারো বছরে (২০০৬-২০১৮) ৩০ থেকে ৩৯টিতে গিয়ে ঠেকেছে; বিশ্বের ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এখন এই ধরণের শাসনের অধীনে। পূর্ন গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা যে এক দশকে (২০০৮-২০১৮) তিরিশ থেকে কুড়িতে এসে দাঁড়িয়েছে সেটাই পরিস্থিতির উদ্বেগজনক মাত্রা তুলে ধরে।

এক সময়ের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কিছু দেশ হয়ে উঠেছে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দেশ, ১৯৮৮ সালের পরে যে সব দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করেছিলো তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষেত্রে (৬১ শতাংশ) গত তেরো বছরে বড় ধরণের অবনতি লক্ষ্য করা গেছে, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়ছে এবং কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোতেও অবস্থার আরো অবণতি হচ্ছে – এই অবস্থাকে কেউ বলছেন গণতন্ত্রের পতন, কেউ বলছেন বিপরীত স্রোত। ভি-ডেম-এর গবেষকরা এই প্রক্রিয়াকে বলছেন স্বৈরাচারীকরণ – অটোক্রেটাইজেশন। তাঁদের বিশ্লেষন হচ্ছে আমরা স্বৈরাচারীকরণের তৃতীয় ঢেউ প্রত্যক্ষ করছি। এর আগের দুটি ঢেউ ছিলো ১৯২২ থেকে ১৯৪২ এবং ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৫।

এই ঢেউয়ের বিভিন্ন স্তর রয়েছে এবং কোন দেশ কোন অবস্থায় আছে তার ওপরে নির্ভর করে যদি এই ঢেউয়ের ঢাকা লাগলে সে কোথায় যাবে, এর পরের অবস্থাটি কী হবে। ভি-ডেম-এর প্রতিবেদনে চার ধরণের শাসনের কথা বলা হয়েছে – উদার গণতন্ত্র (লিবারেল ডেমোক্রেসি), নির্বাচনী গণতন্ত্র (ইলেক্টোরাল ডেমোক্রেসি), নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র (ইলেক্টোরাল অটোক্রেসি) এবং রুদ্ধদ্বার স্বৈরতন্ত্র (ক্লোজড অটোক্রেসি)। উদার গণতন্ত্রে স্বৈরাচারীকরণের প্রক্রিয়া হচ্ছে গণতন্ত্রের ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে, নির্বাচনী গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এটি ঘটে গণতন্ত্রের ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে। আর নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রে ঘটে স্বৈরতান্ত্রিক অধঃপতন যা শেষ হয় দেশটির রুদ্ধদ্বার স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হওয়া দিয়ে। ফলে যখন কোনও উদার গণতন্ত্রে আমরা ক্ষয়ের লক্ষণগুলো দেখতে পাবো তখনই বুঝতে হবে যে স্বৈরাচারীকরণ – অটোক্রেটাইজেশন প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছে। একবার এই যাত্রা শুরু হলেই যে তা অবধারিতভাবে রুদ্ধদ্বার স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হবে তা নয়।

কিন্ত এখন পর্যন্ত যে সব গণতান্ত্রিক বা গণতন্ত্র অভিমুখী দেশে গণতন্ত্রের ক্ষয় এবং ভাঙ্গন দেখা গেছে সেখানে গণতন্ত্রের কোন উপাদানগুলো সবচেয়ে আগে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সেদিকে তাকালেই আমাদের পক্ষে স্বৈরাচারীকরণের পথরেখা এবং করণীয় নির্ধারন করা সম্ভব হবে। যে তিনটি প্রতিবেদনের কথা আমি উল্লেখ করেছি তাঁদের গত এক দশক বা তার বেশি সময়ের উপাত্ত আমাদের এই উপাদান চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।

এই উপাদানগুলোর দিকে নজর দেবার আগে আমরা দেখতে পারি যখন গণতন্ত্র ক্ষয়ের মুখোমুখি হয় কিংবা যখন গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে তখন কী অবস্থা হয় – নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো সংকুচিত হয়ে যায়, ভিন্নমতের জায়গা সীমিত হয়ে পড়ে, সরকারের বিরোধীদের প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষা কবচ অদৃশ্য হয়ে যায়, মতপ্রকাশ এবং সমাবেশের স্বাধীনতা টিকে থাকলেও তা হয় খুবই সীমিত। গণমাধ্যমকে হয় কার্যত কিনে নেয়া হয় কিংবা হুমকির মাধ্যমে স্বেচ্ছা-সেন্সরশীপে ঠেলে দেয়া হয়। আইন সভা হয়ে পড়ে দুর্বল, অকার্যকর; বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। সরকার বিরোধীদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। আর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এমন ব্যক্তির যারা সাধারন মানুষের যুক্তিবাদিতার কাছে আবেদন করেননা, করেন তাঁদের আবেগের কাছে, তাঁদের বিদ্বেষের কাছে। এই ধরণের নেতাদেরকে বলা হয় ডেমাগগ। এরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে সব সমস্যার সমাধান তিনি দিতে পারেন, সব জটিল সমস্যার সহজ সমাধানের কথা বলেন তাঁরা। ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে অবসিত হয়। এরাই হচ্ছেন লোকরঞ্জনবাদী বা পপুলিস্ট নেতা।

এদের মধ্যে যারা দক্ষিনপন্থী, যাদের উত্থান যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকায় সহজেই দৃষ্ট,  তাঁদের এজেন্ডা জাতীয়তাবাদের আড়ালে বিদেশী ভীতি বা জেনোফোবিয়া এবং ইসলামভীতি বা ইসলামোফোবিয়া; দৃশ্যত তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের প্রতিনিধিত্বের দাবীদার, যদিও তারা নিজেরা ঐ শ্রেনীর প্রতিনিধি নন এবং তাঁদের অর্থনৈতিক কর্মসূচী দরিদ্রদের নয় ধনীদের পক্ষেই তৈরি হয় এবং সমাজে বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়। এ যাবত গণতন্ত্রের বিরুদ্ধের লড়াইয়ের অগ্রণী এরা, তাঁরা যে অংশত সফল সেটা বিরাজমান অবস্থাই প্রমাণ করে।

 কিন্ত গনতন্ত্রের এই পশ্চাদযাত্রা, ভি-ডেমের গবেষকদের ভাষায় ‘স্বৈরাচারীকরণ’-এর রয়েছে সামাজিক দিক এবং গনতন্ত্রের কিছু সূচকের অবনয়ন, যার দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি একটি দেশের যাত্রা কোন পথে।

১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে অনেকেই এই হুশিয়ারি দিয়েছিলেন যে লাল-পতাকা উড়িয়ে কমিউনিস্টরা এসে রাজধানী দখল করে নিয়ে গণতন্ত্রের পতন ঘটাবে; সেইসব ভবিষ্যতবাণী সত্য হয়নি। সত্য হয়নি ১৯৯০-এর দশকের এই ভবিষ্যৎবানীও যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ধারকরা – যাদের অনেকেই ‘মৌলবাদী’ বলে বর্ণনা করতে পছন্দ করেন – তলোয়ারের কোপে গণতন্ত্রকে হত্যা করবে। ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে সেনাবাহিনী যেভাবে তাঁদের বুটের তলায় গণতন্ত্রকে মাড়িয়ে দিয়েছিলো তার পুনরাবৃত্তিও হয়নি। তবে এটা ঠিক যে কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, যেখানে এই ধরণের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে – ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্রের অবসান ঘটেছে একটি বামপন্থী সরকারের আমলে, তুরস্ক এবং ভারতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং মূল্যবোধকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়েছে এমন সব দলের অধীনে যাদের আদর্শ ধর্মাশ্রয়ী; মিসর এবং থাইল্যান্ডে গণতন্ত্রের ওপরে হামলা চালিয়েছে সেনাবাহিনী। কিন্ত ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে রীতিমত ধর্মযুদ্ধের সূচনা করেছে তাঁরা হচ্ছেন দক্ষিনপন্থী লোকরঞ্জনবাদী (পপুলিস্ট) রাজনীতিবিদ। এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, যে ২২টি দেশে গণতন্ত্রের সূচকে অবণতি ঘটেছে তাঁর ১৭টিতেই এই ধরণের লোকরঞ্জনবাদীরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।

এই লোকরঞ্জনবাদী নেতাদের গাত্রবর্ণ ভিন্ন, তাঁদের জেন্ডার ভিন্ন, তাঁদের ধর্ম ভিন্ন। কিন্ত শত্রু ‘তৈরি’ করতে তাঁরা সিদ্ধহস্ত, সেই শত্রু দেশীই হোক কি বিদেশী। কারও কারও জন্যে কথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ তৈরি করেছে যৌক্তিকতা, আর কারো কারো জন্যে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে মন্ত্র। তাঁরা এক দল অনুসারী তৈরি করেছে যারা একই সঙ্গে গর্বিত (তাঁদের জাতির জন্যে, দেশের জন্যে বা ধর্মের জন্যে), অসন্তষ্ট (তাঁদের অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে), এবং ক্ষুব্ধ (তাঁদের কল্পিত শত্রু বিরুদ্ধে)। তাঁরা তাঁদের নেতাদের আচরণ, কথা, কাজের প্রশংসায় বিগ্লিত। এ হচ্ছে এমন এক অবস্থা যে, একদল মোসাহেব রাজার পোশাক নিয়ে প্রশংসায় ব্যস্ত যখন সেই গল্পের শিশু সবার সামনেই বলে গেছে – ‘রাজা, তোমার আগে কাপড় কোথায়?’

কোনও দেশে গণতন্ত্রের অবসানের কোনও সুনির্দিষ্ট মুহুর্ত নেই। এমন কোনও সময়কে আমরা চিহ্নিত করতে পারবোনা যখন গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। সারা পৃথিবীর কোথাওই আপনি এমন কোনও দর্শনীয় মুহুর্তকে বের করতে পারবেন না যখন গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিকভাবে অবসান হয়েছে। এমন কোনও সময় আসেনি যখন রেডিও, টেলিভিশন বা গণমাধ্যমে এমন ঘোষনা পাঠ করে শোনানো হয়েছে যে, ‘আমরা এখন থেকে গণতান্ত্রিক রীতিনিতি পরিত্যাগ করলাম এবং অবিলম্বে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে’। এর বদলে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটেছে গণতন্ত্রের এক অনিবার্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে – সেই অনিবার্য প্রক্রিয়ার নাম হল নির্বাচন।

স্টিভেন লেভিটস্কি ও ড্যানিয়েল জিবলেট এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তাঁদের বহুল আলোচিত গ্রন্থ – ‘হাউ ডেমোক্রেসি ডাইজ?’-এ। এই বিষয়ে গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে তাঁরা লিখেছেন, ‘আজকের দিনে গণতন্ত্রের উল্টোযাত্রা শুরু হয় ব্যালট বাক্সে। গণতন্ত্র ভেঙ্গে পড়ার এই নির্বাচনী যাত্রাপথ খুবই প্রতারণাপূর্ণ (ডিসেপ্টিভ)। প্রচলিত ধারার যে কোনও সামারিক অভ্যুথানে, যেমন পিনোশের চিলিতে, গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে একেবারে অকস্মাৎ, আর তা সকলের কাছে সহজেই দৃশ্যমান হয়। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ভস্মীভূত হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট হয় নিহত হন অথবা তাঁকে বন্দি করা হয় অথবা তাঁকে পাঠানো হয় নির্বাসনে। সংবিধান হয় স্থগিত করা হয়, অথবা একেবারে বাতিল। কিন্ত নির্বাচনের পথে [গণতন্ত্রের উল্টোযাত্রায়] এ সবের কিছুই ঘটে না। রাজপথে কোনও ট্যাংক নামেনা। সংবিধান এবং অন্যান্য নামমাত্র গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো জায়গা মতোই থাকে। জনগণ ভোটও দেয়। নির্বাচিত স্বৈরাচারীরা গণতন্ত্রের একটা আবরণ বজায় রাখে যখন তাঁরা গণতন্ত্রের সারবস্তকে ছিড়েখুড়ে ফেলে’ (‘দিস ইজ হাউ ডেমোক্রেসিজ ডাই’, দ্য গার্ডিয়ান, জানুয়ারি ২১, ২০১৮)।

ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, গত তেরো বছর ধরে অব্যাহতভাবে গণতন্ত্রের সংকট চললেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার। গত চার বছরে অব্যাহতভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার এই সূচকে পতন ঘটেছে। ২০১৮ সালে যে সব দেশে নির্বাচনের এই প্রক্রিয়া হয়েছে তাঁর কিছু আমাদের জানা আছে – বাংলাদেশ, রাশিয়া, কম্বোডিয়া এবং তুরস্ক – যেখানে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতা এবং জালিয়াতি সকলের জ্ঞাত। ভি-ডেমের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এমন দেশে থাকেন যেখানে স্বৈরাচারীকরণের এই প্রক্রিয়া চলছে। সংখ্যাটি ২০১৬ সালের পরে বড় আকার নেবার অন্যতম কারণ হচ্ছে পৃথিবীর তিনটি জনাকীর্ণ দেশ – ভারত, ব্রাজিল এবং যুক্তরাষ্ট্র – এখন এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, এই প্রক্রিয়ার ২২টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ। মোট সাতাশটি দেশে ২০০৮ সালের তুলনায় নির্বাচনের মান খারাপ হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমেই হাইব্রিড্র রেজিমগুলো – যারা দেখতে গণতান্ত্রিক কিন্ত কার্যত স্বৈরতান্ত্রিক – তাঁদের বৈধতা অর্জন করে বা করতে চায়।

গণতন্ত্রের অন্যান্য যে উপাদানগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় তার অন্যতম – মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ফ্রিডম হাউসের ভাষ্য অনুযায়ী ২০১২ সাল থেকে অব্যাহতভাবে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ভি-ডেমের বিবেচনায় নির্বাচনী গণতন্ত্রের দেশগুলোতে গণমাধ্যমের ওপরে নিয়ন্ত্রন অন্য যে কোনও সূচককে ছাড়িয়ে গেছে। তাঁদের হিসেবে কমপক্ষে ৩৫টি দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মিডিয়া সেন্সরশিপ ঘটেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, গত এক দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে যে বিষয়গুলো বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ বলে চিহ্নিত হয়েছে তাঁর একটি হচ্ছে – মিডিয়ার ওপরে নিয়ন্ত্রণ এবং ডিজিটাল অথরিটারিয়ানিজম। এই ক্ষেত্রে ফ্রীডম হাউসের আরেক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে, গণতন্ত্রের পথ থেকে যে সব দেশ সরে যাচ্ছে তাঁরা সাইবার স্পেস নিয়ন্ত্রনের জন্যে চীনের পথ নিচ্ছে। ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদের বিষয়ে আলোচনায় এটা বারবার উঠে এসেছে যে, যে সব দেশকে রুদ্ধদ্বার স্বৈরতন্ত্র এবং নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র আছে সেখানে সরকার মিথ্যা তথ্য প্রচার করে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে, এই কাজ কেবল সরকার করে তা নয়, তাঁর সমর্থক গোষ্ঠীও সরকারের জ্ঞাতসারে বা সমর্থনে এই ধরণের মিথ্য প্রচারনা চালায়। ভি-ডেম প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, অনেক সময়েই উদার গণতান্ত্রিক এবং অন্যান্য দেশ বিদেশীদের দ্বারা পরিচালিত মিথ্যা প্রচারের শিকার হয়।

নির্বাচনকে প্রভাবিত করা, গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটির ওপরে আক্রমণ, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং আইনের শাসনের ভিত্তিকে দুর্বল করাই হচ্ছে গণতন্ত্রকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার পথ, এগুলো হচ্ছে স্বৈরাচারীকরণের পথে অগ্রযাত্রা মাইলস্টোন। এগুলোর দিকে তাকালে কেবল যে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অতীতে কী ঘটেছে তাই বোঝা যাচ্ছে তা নয়, আগামীতে কী হতে যাচ্ছে তাও বোঝা যাবে। কিন্ত গণতন্ত্র কেবল যে এইভাবেই ভাঙ্গনের মুখে পড়ে তা নয়, তাঁর একটি সামাজিক পটভূমি থাকে। ভি-ডেম-এর প্রতিবেদন একে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘টক্সিক পোলারাইজেশন’ বা বিষাক্ত মেরুকরণ বলে; এই প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। বিভিন্ন গবেষনা, বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষনে দেখা যায় যে, এই স্রর্বনাশা মেরুকরণের লক্ষণগুলো কী। সমাজে ক্রমাগতভাবে সহমর্মীতা ও সহনশীলতা কমে আসে, ব্যক্তিরা হয়ে পড়েন বিচ্ছিন্ন, যাকে বলা হয়ে থাকে এটোমাইজেশন; ইতিবাচক সামাজিক পুঁজি – যার অর্থ হচ্ছে একের সঙ্গে অন্যের ইতিবাচক সংহতির বন্ধন – তা হ্রাস পায়; রাজনীতির ব্যাপারে তৈরি হয় অনাগ্রহ, এবং ক্রমাগতভাবে সমাজের মানুষের মধ্যেকার পার্থক্যগুলোকে বড় করে তোলা হয়।

অগণতান্ত্রিক শাসকেরা যারা গণতন্ত্রের লেবাস ঝুলিয়ে রেখে অথবা খোলমেলা স্বৈরাচারী শাসন চালায় তাঁরা গত এক দশকের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে হত্যার বৈধতা দেবার চেষ্টা করবেন, বলবেন যে এটাই বৈশ্বিক চিত্র। এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সজাগ থাকা জরুরি; একে মোকাবেলা করা দরকার। কোনও রোগ মহামারী হয়ে ওঠার মানে এই নয় যে, সেটাই স্বাভাবিক।

সাম্প্রতিক প্রকাশিত এই প্রতিবেদনগুলো যেমন অটোক্রেটাইজেশনের ইঙ্গিত দিচ্ছে তেমনি এমন তথ্য দিচ্ছে যা আমাদের আশবাদী হতে সাহায্য করতে পারে। ইআইইউ’র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে বার্ষিক বিবেচনায় গত তিন বছরের মধ্যে এই  প্রথমবারের মতো বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের অবস্থা স্থির থেকেছে, ধ্বস বন্ধ হয়েছে; ক্রমাগতভাবে যে অবণতি হচ্ছিলো সাময়িকভাবে হলেও তা বন্ধ হয়েছে। ভি-ডেম-এর প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে যে বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্র এখন আর অবারিত পতনের পথে নেই। ইআউইউ রিপোর্টে বলছে যে ২০১৮ সালের যে একটি মাত্র সূচকে অগ্রগতি দেখা গেছে তা হচ্ছে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ; বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। স্বৈরাচারী ও অন্যান্য অগনতান্ত্রিক সরকারগুলো যখন রাজনৈতিক নিপীড়ন বৃদ্ধি, বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করা, নাগরিকের অংশগ্রহণের পথগুলো সীমিত করার কাজে করছে, ভয়ভীতি ছড়াচ্ছে, সিভিল সোসাইটির সংগঠনগুলোর কাজে বাধা দিচ্ছে সেই সময়ে দেশে দেশে নাগরিকরা ন্যায়বিচারের দাবিতে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে বিভিন্নভাবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, যুক্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। এটা কেবল আশার বিষয় নয়; এটা এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এখনও মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা বহাল আছে; আদর্শ হিসেবে গণতন্ত্রের বিকল্প নেই এবং গণতন্ত্রকে বিকশিত করার উপায় হচ্ছে সেটাই। কাজটি কঠিন, কিন্ত অসম্ভব নয়। কেননা ১৯৩০-এর দশকেও বৈশ্বিকভাবে গনতন্ত্র সংকটের মুখে পড়েছিলো; কিন্ত সেই সংকট মোকাবেলা করে গণতন্ত্রবিরোধী আদর্শগুলোকে কেবল পরাস্তই করা হয়নি -গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছিলো।

Leave a Reply