April 20, 2024

সারাদেশ জুড়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির দাবিতে চলমান আন্দোলনের একটা অন্যতম দাবি হচ্ছে যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণার। ইতিমধ্যে মন্ত্রীসভার আলোচনা এবং অতীতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এ বিষয়ে সরকারী অবস্থান সহজেই বোঝা যায়। সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ব্যাপারে আশু কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে আগ্রহী নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ট্রাইবুনাল বিষয়ক আইনের সর্ব সাম্প্রতিক সংশোধনীতে যুদ্ধাপরাধের জন্য সংগঠনকে অভিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়েছে, যা থেকে অনেকের ধারণা যে এতে করে জামায়াতে ইসলামীকে সংগঠন হিসাবে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হবে, এবং দোষী সাব্যস্ত হলে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করাও যেতে পারে।  এ ছাড়া ২০০৯ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বিষয়ক একটি রিট আবেদন আদালতের বিবেচনাধীন আছে। এই রিট আবেদনে অবশ্য জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করার কথা নেই। এই পটভূমিকায় গত ৪২ বছরে বাংলাদেশে জামাতের আইনী ও সাংবিধানিক উত্থান ও অবস্থান আলোচনা করা জরুরি।

বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী কখনোই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় নি। উপরন্ত দু’দফায় দল হিসেবে জামাতের জন্য আইনি বা সাংবিধানিক বৈধতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর অতিরিক্ত একদফায় কার্যত জামাতের আদর্শকে জুড়ে দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রের সঙ্গে, আরেকবার সেই ব্যবস্থাটির মৃতপ্রায় শরীরে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৪২ বছরে আইনী ও সাংবিধানিক বিবেচনায় এটাই হল জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস।

এর বাইরে যে ইতিহাস তাও যে মর্মবস্তর দিক থেকে এর চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন তা নয়। সরকারে দলগতভাবে জামাতকে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দেয়ার ঘটনা সকলেরই মনে আছে, সে ঘটনার পরোক্ষ সূত্রপাত ১৯৭৯ সালে, কিন্ত তা পূর্নাঙ্গ রূপ পায় ২০০১ সালে। জামায়াতকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়ার ক্ষেত্রে অনির্বাচিত সেনা শাসকরা যেমন অগ্রনী ছিলেন, তেমনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় সামরিক-শাসন বিরোধীরা মোটেই পিছপা হন নি। সংসদীয় রাজনীতির ‘কারনে’ বা ‘অজুহাতে’ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়াবার ঘটনাও সকলের অবগতির মধ্যে আছে। জামায়াতকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়া ও তার সঙ্গে সরকারের ক্ষমতা ভাগ করার প্রশ্ন এখন আর আলোচনার বিষয় নয়। এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়েছে।  এখন আলোচনার বিষয় হল জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করা অথবা না করার প্রশ্ন। জামায়াতের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া এবং না নেয়ার প্রশ্ন। সে দিক থেকে এখন সাংবিধানিক বিষয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার দিকটি আমাদের ক্ষতিয়ে দেখা দরকার।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এ কথা সবারই জানা ছিলো যে কমপক্ষে চারটি রাজনৈতিক দল দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। তাঁদের বক্তব্য থেকে শুরু করে সে সময় গড়ে ওঠা বেসামরিক প্রশাসন, বেসামরিক বাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী এবং ডেথ স্কোয়াডগুলোর নেতৃত্ব এবং সদস্য প্রধানতই এসেছে এই চারটি দল থেকে । জামায়াতে ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলামী, পাকিস্তান মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)। স্বাধীনতার প্রথম প্রহর থেকেই এই দলের কর্মি ও নেতারা হয় পলাতক হয়ে যান অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে আটক হন। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে দাবি ওঠে যে নয় মাসের যুদ্ধে যারা পাকিস্তানীদের সহযোগিতা করেছে, বিশেষত পরিকল্পিতভাবে  হত্যা, খুন, ধর্ষনের মতো অপরাধ ঘটিয়েছে তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি জারি করা দালাল আইন বা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদেশের আওতায় এই চার দলের নেতাদের অনেকেই গ্রেফতার হয়। সব মিলে আটক হয় ৩৭ হাজার ৪৯১ ব্যক্তি। ৭৩টি ট্রাইবুনালে মানবতার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়  প্রায় ১১ হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে। মোট ২ হাজার ৮৪৮ জনকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে মুসলিম লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতা খান আব্দুস সবুর, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান, জামায়েত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আব্বাস আলী খানও ছিলো। এসব মামলায় মোট ২২ জনের মৃত্যুদন্ড, ৬৮ জনের যাবজ্জীবন, এবং ৭৫২ জনের বিভিন্ন মেয়াদী সাজা দেয়া হয়।

কিন্ত এই সময়ে এ সব অভিযোগে বা অন্য কোনো বিবেচনায় কোনো সংগঠনকেই নিষিদ্ধ করা হয় নি। তার একটা অন্যতম কারণ সম্ভবত এই যে, ইতিমধ্যে দেশের যে সংবিধান প্রণীত এবং ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরে কার্যকর করা হয় তার অনুচ্ছেদ ১২ এবং অনুচ্ছেদ ৩৮-এ ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করার ফলে এটা মনে করা হয় যে, ধর্মের বিবেচনায় সংগঠন করা যাবে না। ফলে দল হিসেবে এই সব দলেরই অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায়। কিন্ত আইনীভাবে এই সব দলকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই জারি করা গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ সংক্রান্ত আইনেও কোনো সংগঠনকে অভিযুক্ত করার বিধান না থাকায় সাংগঠনিকভাবে এই দলগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার কোনো বিধান রাখা হয়নি, বিবেচিতও হয়নি। ফলে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগসহ কোনো দলকেই ১৯৭১ সালে তাঁদের ভূমিকার জন্য জবাবদিহি করতে হয়নি।

আইনীভাবে জামায়াত নিষিদ্ধ না হলেও রাষ্ট্রীয় আদর্শের সঙ্গে দলের আদর্শ সাংঘর্ষিক হওয়ায় দলগতভাবে জামায়াত কখনোই নিজের অস্তিত্বের জানান দেয় নি। তাঁদের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ, যেমন গোলাম আযম, দেশের বাইরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারনা, ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকে আর মাঠ পর্যায়ের কর্মিরা দেশের বিভিন্ন দলের ভেতরে প্রবেশ করে তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে, অনেকে নিস্ক্রীয় হয়ে পড়ে । একটা অংশ তাবলীগ জামাতে যোগ দিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে সফরে ব্যস্ত থাকে। তার অর্থ অবশ্য এটা নয় যে গোপনে জামাতের কোনো সাংগঠনিক অস্তিত্বই ছিলনা। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ও ‘প্রাদেশিক’ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে ১৯৭২ সালেই সাবেক ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতৃবৃন্দ গোপনে সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল খালেক-কে আমীর মনোনীত করে জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলে। কিন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ঘটনা ঘটে ১৯৭৪ সালে যখন পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবাসিত লাখ লাখ বাঙ্গালীর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের নায়েব-ই-আমীর মওলানা আবদুর রহিম বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং জামায়েতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক ভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটাই ছিল প্রথম বড় ধরণের পদক্ষেপ। এক অর্থে জামায়াতের পুনর্জীবন লাভ।

১৯৭৩ সালের ১৬ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের দেয়া অনুকম্পা কিংবা ৩০ নভেম্বরে ঘোষিত সাধারণ ক্ষমা জামায়াত সহ অনেক দলের নেতার মুক্তির ব্যবস্থা করলেও গণহত্যায় যুক্তদের যেমন সম্ভাব্য বিচারের হাত থেকে রক্ষা করেনি ঠিক একই ভাবে দলগতভাবে কোনো দলকে দায়মুক্তির ব্যবস্থা করেনি। আটক ও বিচারাধীনদের জন্য দায়মুক্তির ব্যবস্থা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সামরিক শাসন জারির পর – ৩১ ডিসেম্বরে। সামরিক ক্ষমতা বলে জারি করা ফরমান দালাল আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত দেয়। লক্ষনীয় এই যে সেই ফরমানে, যারা ইতিমধ্যে দন্ডিত তাঁদের ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে বলা হয় যে,  ‘যারা দালাল আইনে ইতিমধ্যে দণ্ডিত হয়েছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে আপিল করেছে, তাদের ক্ষেত্রে এই বাতিল অধ্যাদেশ প্রযোজ্য হবে না।’ এসবই কেবলমাত্র ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য বলেই প্রতীয়মান হয়েছে, সংগঠনের প্রশ্ন থেকেছে অনুক্ত। তা সত্বেও বাংলাদেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনুযায়ী জামায়াতের দল গঠনের চেষ্টা তখনো অসম্ভব ব্যাপার।

১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে, রাজনৈতিক দল বিধির (পিপিআর) আওতায় যখন সব দলের জন্য সরকারী রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হল তখন যে ২১টি দল ঘরোয়া রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন পেয়েছিল তার মধ্যে যেমন ছিল আওয়ামী লীগ তেমনি ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী মুসলিম লীগও। সে সময় জামাতে ইসলামী আবেদন করেও অনুমতি পায়নি। কিন্ত জামায়াতে ইসলামী এবং নেজাম-ই-ইসলামি’র নেতারা একত্রে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) গঠন করে তাঁদের অপ্রকাশ্য রাজনীতির অবসান ঘটিয়েছিলো। জামায়াত এবং নেজাম-ই-ইসলামীর মধ্যেকার ঐক্য কোনো বিস্ময়ের বিষয় নয় – আদর্শিক কারণে এবং অতীতে পাকিস্তানকালে তাঁদের মধ্যে সাংগঠনিক ঐক্যের ইতিহাসের কারণে। বাংলাদেশে সেনা শাসনের মধ্যে ‘ঘরোয়া রাজনীতি’র দরজা খোলার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের রাজনৈতিক সংগঠন তৈরির আইনানুগ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল এই পিপিআর’এর মধ্য দিয়েই। অথচ তখনো দেশের স্থগিত সংবিধান অনুযায়ী ধর্ম-ভিত্তিক দল গঠন আইন সঙ্গত নয়।

এই ‘অসঙ্গতির’ অবসান ঘটে কিংবা অন্য ভাবে বললে, জামায়াতের দল গঠনের জন্য আদর্শিকভাবে দরজা খুলে দেয়া হয় ১৯৭৭ সালের ২৩ এপ্রিল সামরিক ফরমান জারি করে যখন রাষ্ট্রীয় আদর্শ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার অবসান ঘটলো। এতে করে রাজনীতি ও সমাজে ইসলামপন্থী আদর্শের যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের সূচনা হয় তা আমরা সবাই জানি (এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছি আমার একাধিক বইয়ে; ২০০৪ সালে প্রকাশিত আমার ‘গড উইলিং : দি পলিটিক্স অব ইসলামিজম’ গ্রন্থে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে)। কিন্ত একথা বিস্মৃত হওয়ার অবকাশ নেই যে ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধি দলগতভাবে জামায়াতে ইসলামীকে আইনী বৈধতা না দিলেও মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের রাজনৈতিক সংগঠন করার আইনী অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল – এক আইনের আওতায় তিনটি প্রধান স্বাধীনতা বিরোধী দল বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার লাভ করে। বাংলাদেশে প্রায়-মৃত জামায়াতে ইসলামীর শরীরে নতুন রক্ত সঞ্চালনের ঘটনা সেই প্রথম।

উনিশ শো পচাত্তর সালে বাংলাদেশে সেনা শাসন জারির পরে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক কার্যকলাপ সীমিতভাবে চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় সেনা শাসকরা, সেটা ১৯৭৬ সাল। তার আওতায় ‘ঘরোয়া রাজনীতি’র জন্য সরকারের কাছে অনুমতি নেবার ব্যবস্থা চালু করা হয়। প্রায় নব্বইটি দলের আবেদনের মধ্য থেকে ২১টি দলকে রাজনীতি করার অনুমোদন দেয়া হয়। জামায়াতে ইসলামী আবেদন করেও অনুমতি পায়নি, ইতিমধ্যে আমি তা উল্লেখ করেছি।  কিন্ত কেন জামায়াতে ইসলামীকে দলগতভাবে রাজনীতি করার অনুমতি দেয়া হয়নি তার কোন ব্যাখ্যা আমরা এখনও জানিনা। এই সিদ্ধান্তের পেছনে ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এম জি তোয়াবের নেতৃত্বে ইসলামী জলসার নামে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ইসলামপন্থীদের সমাবেশের এবং শক্তি প্রদর্শনের কোনো ভূমিকা ছিল কিনা সেটা তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা বলতে পারবেন, সম্ভবত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দলিল দস্তাবেজে তার কিছু ব্যাখ্যা থাকতেও পারে। জামায়াতে ইসলামীর এই ভূমিকাই ১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বরে জারি করা রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ (দি পলিটিক্যাল পার্টিজ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮)-এর ৩ ও ৪ অনুচ্ছেদের আবশ্যকতা তৈরি করেছিলো কিনা সেটাও আমাদের খুজে দেখা দরকার। সে সময়কার সরকারি কর্মকর্তারা চাইলে এ বিষয়ে আমাদের অবহিত করতে পারেন।  ১৯৭৯ সালের ২৫-২৭ মে প্রকাশ্য সম্মেলনের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে দল হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হয়। ততদিনে অবশ্য আইডিএল-এর ছত্রছায়ায় মুসলিম লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬ জন জামাত নেতা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্যে গোলাম আযম বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং দলের ভেতরে জামায়াত পুনপ্রতিষ্ঠা নিয়ে বিবাদবিসংবাদও ঘটেছে।

১৯৭৬ সালের পিপিআর হল জামাতের প্রথম আইনী স্বীকৃতির ভিত্তি। দ্বিতীয় বার আইনী স্বীকৃতি ঘটেছে আমাদের চোখের সামনে। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের সুপ্রিম কোর্ট যখন সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে তখন আপনা-আপনি যে সংবিধান বহাল হয়ে যায় তাতে অনুচ্ছেদ ১২ এবং অনুচ্ছেদ ৩৮ – দুই-ই ছিল। দুই-ই দলগতভাবে জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি করে তোলে। বিশেষ করে ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে দলের দেয়া গঠনতন্ত্র যেভাবে জামায়াতে ইসলামীর বর্ণনা দিয়েছিল তা ছিল ১৯৭২ সালের সংবিধানের পরিপন্থি। কিন্ত ২০১১ সালের জুন মাসে পঞ্চদশ সংশোধনী ৩৮ অনুচ্ছেদকে সংবিধানে পুনস্থাপিত করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও ধর্মভিত্তিক দল গঠনে কোনো রকম বাধা নিষেধ আরোপ না করার মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামী সহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলো আরেক দফা আইনী বৈধতা লাভ করে। অনেকেরই মনে থাকবে যে এই সময় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে অনেকেই বক্তব্য রেখে ছিলেন; তার মধ্যে সরকারি দলের নেতৃবৃন্দও ছিলেন। কিন্ত প্রধানমন্ত্রী গোড়া থেকেই সুস্পষ্টভাবে সে ধরণের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেন। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি ছিলো যে এই পদক্ষেপ নিলে কেবল জামায়াতে ইসলামী নয় আরো অনেক ইসলামপন্থী দলই নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। সে ধরণের পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে সরকারি দলই শুধু নয় সমাজের অন্যান্য অনেক মহলেই আপত্তি ছিল। কিন্ত এ কথা ভুলে যাবার অবকাশ নেই যে এটা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর দ্বিতীয় আইনীকরণ।

ইসলামপন্থী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান লক্ষ হল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এটা জামায়াতের সব ধরণের দলীয় প্রকাশনায় আছে, নেতৃবৃন্দ বলে এসেছেন, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হল এটা দলের আদর্শিক গুরু মওলানা আবু আল মওদুদির রাজনৈতিক বক্তব্যের একটা অন্যতম দিক। এমনকি সে রাষ্ট্রের চরিত্র কি হবে সে বিষয়ে তাঁর লেখায় এবং তাঁর উত্তরসূরি গোলাম আযমের লেখায় স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। এই আদর্শিক দিকটির ভিত্তি হল রাষ্ট্রের আদর্শের সঙ্গে ধর্মকে একীভূত করে ফেলা। ধর্ম ও রাষ্ট্রের এই সম্পর্কের আইনি ও সাংবিধানিক দিকটি প্রতিষ্ঠা হয় সেনা শাসক জেনারেল এরশাদের করা ১৯৮৮ সালের ৮ম সংশোধনীতে। জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতার কাছে ধারে না থাকলেও তাদের অন্যতম একটি আদর্শ এইভাবেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শে পরিণত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে জলাঞ্জলি দেবার পরও আদর্শিকভাবে, আইনিভাবে, সংবিধানসম্মত উপায়ে একটি ধর্মভিত্তিক দলের আদর্শকে রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিণত করা হবে তা ছিল অকল্পনীয়, এর কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। কিন্ত অষ্টম সংশোধনী বাতিলের কারনে এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে এই সম্পর্কে বিচ্ছেদ টানা যেত। কিন্ত তার পরিবর্তে ব্যবস্থাটির মৃতপ্রায় শরীরে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্ট করেই রাষ্ট্রধর্ম বহাল রয়েছে এবং সম্ভবত তাকে ভবিষ্যতে সংশোধনের পথও রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে । কিন্ত কেন এই ব্যবস্থা নিতে হল তার যুক্তিযুক্ত কারণটি এখনও অস্পষ্ট; রাজনৈতিক বিপদের আশঙ্কাই এর একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্ত তার মধ্য দিয়ে এ দেশে কেবল যে ইসলামপন্থীদের শক্তিকেই খুশি করা হয়েছে তা নয়, জামায়াতে ইসলামীর আদর্শিক অবস্থান যে অগ্রহণযোগ্য নয় তাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

ফলে আজকে যখন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি উত্থাপিত হয় তখনও আমরা রাষ্ট্রের সঙ্গে এই দলীয় আদর্শের বিযুক্তির প্রশ্নটা দেখতে পাইনা। এখন যখন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হচ্ছে তখন এটা সুস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে যে ইসলামপন্থী দল হিসাবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে না। দাবির ভিত্তি হচ্ছে যে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দলটির মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ, গণহত্যার সঙ্গে  সংশ্লিষ্টতা। এ প্রসঙ্গে ন্যুরেমবার্গ  ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বেশ কয়েকটি দল নিষিদ্ধ করার উদাহরণটি দেয়ার কারণ এখানেই। সেটা করা হলে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে জামায়াতে ইসলামী বলে কোন দল গঠনের সুযোগ থাকবেনা। কিন্ত ন্যুরেমবার্গ  ট্রাইব্যুনাল যেমন কেবল একটি দলকে  নিষিদ্ধ করে নি, করেছিল বেশ কয়েকটি সংগঠনকে তেমনি এই ধরণের পদক্ষেপ নিলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একই ধরণের ভূমিকা পালনকারী অন্য দলগুলোকেও নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন হবে – তাঁদের শক্তিশালী সংগঠন থাকুক অথবা না থাকুক। সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সরকারের আগ্রহ ও রাজনৈতিক ইচ্ছা-শক্তির বিষয়টি স্পষ্ট করা খুবই দরকার। প্রাসঙ্গিকভাবে এটা মনে করা দরকার আজকে বিএনপি যদিও নিশ্চিতভাবেই জামাত নিষিদ্ধকরণের দাবির পেছনে দাঁড়াবে না, এক সময় বিএনপি’র সংসদ সদস্যরা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এই দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মুলতবী প্রস্তাব আলোচনায় বিএনপি সংসদ সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ জামাত-শিবির প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আজকে যারা ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করতে চায়, আজকে যারা এই দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে, এই জামায়াত শিবিরের রাজনীতিকে চিরতরে নিষিদ্ধ করার জন্য আমি আপনার কাছে দাবি জানাব’। তার দাবির পক্ষে অনেক বিএনপি সদস্য বক্তব্য রাখলেও কোনো আইনি বা সাংবিধানিক ব্যবস্থার জন্য ক্ষমতাসীন বিএনপি বা বিরোধী দল আওয়ামী লীগের কোনো প্রস্তাব ছিলনা। আমাদের এও বোঝা দরকার যে, এমন কি ট্রাইবুনালে বিচারের মাধ্যমেও যদি জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয় তবে জামায়াতের  কর্মীদের, বিশেষত যারা কোনোভাবেই ১৯৭১ সালের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নয়, নতুন দল করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি মেনে নিলে জামাতের ইতিহাসে একটা নতুন অধ্যায় যুক্ত হবে। এ বিষয়ে জামায়াতের প্রস্ততি রয়েছে বলেও বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়।

অন্যদিকে জামায়াতকে যদি প্রচলিত আইন ব্যবহার করে নিষিদ্ধ করার কথা সরকার বিবেচনা করে, তবে তার জন্য ১৯৭৮ সালের রাজনৈতিক দলবিধির ৩ ও ৪ ধারার প্রয়োগ একটি পথ, কিংবা সন্ত্রাস দমন আইন ব্যবহার করা যেতে পারে। এর সপক্ষে দেশে গত প্রায় তিন মাস ধরে বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে ২৭ ফেব্রুয়ারিতে, জামায়াতের সহিংস কার্যকলাপ জননিরাপত্তার প্রতি হুমকি তৈরি হয়েছে বলে সরকার দাবি করতে পারেন। এ সব আইনের যেটাই ব্যবহার করা হোক না কেন তাতে করে সম্ভবত দলটির আদালতে শরণাপন্ন হবার সুযোগ তৈরি হবে। আদালতের প্রসঙ্গটি তোলার একটা অন্যতম কারণ হল গোটা মহাদেশে যে দুই বার জামায়তে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার একবার সরকার স্বল্প সময়েই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে, আরেকবার আদালতের রায়ে জামায়াত রাজনীতিতে ফিরেছে। প্রথম ঘটনা পাকিস্তানী আমলে; আইয়ুব খানের জারি করা মুসলিম পারিবারিক আইন সংক্রান্ত অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার কারণে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। বছর শেষ হবার আগেই সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে ভারতে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বেআইনি কার্যকলাপ (নিবারন) আইন ১৯৬৭-এর আওতায়। জামায়াতে ইসলামী এই আদেশের বিরুদ্ধে আদালতের শরনাপন্ন হলে এলাহাবাদের হাইকোর্ট সরকারের পক্ষে রায় দেয়, কিন্ত দেশের সুপ্রিম কোর্ট ৭ ডিসেম্বর ১৯৯৪ সরকারের এই নিষেধাজ্ঞাকে বাতিল করে দেয় (আদালতের রায় দেখুনঃ http://www.indiankanoon.org/doc/356651/)। এই অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলা আবশ্যক যে এই ধরনের অভিযোগে দলটিকে নিষিদ্ধ করতে চাইলে সরকারকে যথেষ্ট পরিমানে সতর্কতা অবলম্বন করে এবং প্রস্ততি নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ সব পদক্ষেপের জন্য সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা-শক্তির এবং ঝুঁকি নেবার প্রস্ততি আছে কিনা তা সরকারই ভালো বলতে পারবেন।

Leave a Reply