যুক্তরাষ্ট্রের গত কয়েক দিনের ঘটনা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে দেশের দীর্ঘদিনের কথিত ‘সাংস্কৃতিক লড়াই’ এখন আর বাগ্যুদ্ধে সীমিত নেই। ১৯২০-এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যবোধের ক্ষেত্রে রক্ষণশীলদের সঙ্গে উদারপন্থীদের যে পার্থক্য ও বিরোধ, তাকেই সাংস্কৃতিক লড়াই বলে বর্ণনা করা হতো। বিভিন্ন সময়ে এই পার্থক্যগুলোর প্রকাশ ঘটেছে অভিবাসনবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিতে, গর্ভপাতের অধিকার, নারী ও নাগরিকের সমতার অধিকারের প্রশ্নে, আইন প্রণয়নের প্রশ্নে। সাধারণভাবে নগরায়ণের মধ্য দিয়ে যে নতুন মূল্যবোধের সূচনা, তার সঙ্গে গ্রামীণ সমাজের প্রথাসিদ্ধ ও প্রচলিত মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে এর সূচনা হলেও ১৯৬০-এর দশকে এটি পরিণত হয়েছিল উদার, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের ধারণার বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের প্রতিরোধ হিসেবেই। এরপর থেকে এই পার্থক্যের ক্ষেত্রে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে।
কিন্তু এসব পার্থক্য সহিংসতায় রূপ নেওয়ার ঘটনা বিরল, যে ক্ষেত্রে তা সহিংসতায় রূপ নিয়েছে, সেখানে তা হয়েছে স্থানীয়ভাবে এবং তাতে জাতীয় নেতারা অংশগ্রহণকারীদের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছেন। দক্ষিণপন্থীদের পক্ষ থেকেই এ ধরনের পার্থক্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তাকে ইস্যুতে পরিণত করা হয়েছে এবং উদারপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রচারের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই পার্থক্যের মাত্রা ও প্রকৃতি এমন রূপ নেয়নি, যা আমরা এখন গত কয়েক দিনে প্রত্যক্ষ করেছি। মূল্যবোধের এই পার্থক্য এখন সংঘাতে রূপ নিয়েছে। এই সংঘাত একাদিক্রমে রাজনৈতিক, আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক।
ভার্জিনিয়ার শারলটসভিলে গত শনিবার শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী, নয়া নাৎসিবাদের সমর্থক এবং সন্ত্রাসী সংগঠন কু ক্লাক্স ক্ল্যানের (কেকেকে) সদস্যরা যে সন্ত্রাস চালিয়েছে, তাকে যেকোনো বিচারেই ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। সেভাবেই তার মোকাবিলা করা জরুরি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কেবল তা করতে অস্বীকার করেছেন, তা-ই নয়, তিনি গত শনিবার এবং মঙ্গলবারের বক্তব্যে এই সন্ত্রাসীদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। মাঝখানে গত সোমবার তাঁর দেওয়া তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য বক্তব্য, যাতে তিনি নয়া নাৎসিবাদীদের বিরুদ্ধে বলেছিলেন, তা যে তাঁর নিজের রাজনৈতিক এবং নৈতিক অবস্থান ছিল না এবং শনিবারের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর উপদেষ্টাদের চাপেই তা তিনি দিয়েছিলেন, সেটা এখন সহজে বোধগম্য। এসব বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থান কী, সে বিষয়ে যদিও কখনোই বিভ্রান্তির কিছু ছিল না, তথাপি এখন তা এতটাই সুস্পষ্ট যে তা নিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যার সুযোগ নেই।
শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং নয়া নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদের সন্ত্রাসী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীর সঙ্গে এক কাতারে ফেলার মধ্য দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সব মার্কিন নাগরিকের প্রেসিডেন্ট বলে নিজেকে দাবি করার ‘নৈতিক অধিকার’ হারিয়েছেন। কেননা, প্রেসিডেন্সি কেবল আইনি বা সাংবিধানিক পদ নয়, দেশের সংকটকালে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে দেশ ও দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে তাঁর অন্যতম দায়িত্ব। ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই পরীক্ষায় স্বেচ্ছায় ব্যর্থ হয়েছেন। কেননা, তিনি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারা দেশকে এভাবেই বিভক্ত করে এমন এক সামাজিক ব্যবস্থার কথা ভাবেন, যা বহুজাতিক, বহু সাংস্কৃতিক যুক্তরাষ্ট্রের এত দিনের অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দিতেই আগ্রহী। এ অর্জনগুলো সবার সমতার অধিকার নিশ্চিত করেনি, বৈষম্য ও অনাচারের অনেক উপায়-উপকরণ-পথ-পদ্ধতি এখনো বহাল আছে, কিন্তু যতটুকু অর্জিত হয়েছে, তা থেকে পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ ভার্জিনিয়ার শারলটসভিলের এ ঘটনায় সুস্পষ্টভাবেই ট্রাম্প এবং তাঁর উগ্রপন্থী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। ওই ঘটনায় নিহত হেদার হেয়ারের স্মরণসভায় গত বুধবার তাঁর মায়ের দেওয়া বক্তব্য আমাদের মনে রাখতে হবে, হেদারের ঐতিহ্যের মাত্র শুরু হয়েছে। একার্থে হেদার হেয়ার নিজেই এক দীর্ঘ ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠলেন। কেননা, এই দেশে গত প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস হচ্ছে এ ধরনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেকোনো ধরনের শ্রেষ্ঠত্ববাদের বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকদের সংগ্রাম।
নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের উত্থানের সময় থেকেই এটা স্পষ্ট ছিল যে মার্কিন সমাজের এক গভীর বিভক্তিকে পুঁজি করে ট্রাম্প ক্ষমতায় যেতে চান। তাঁর ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের পর এটা আরও স্পষ্ট হয় যে নাগরিকের অধিকার, সমতার ধারণার বিরুদ্ধেই তাঁর এবং তাঁর উপদেষ্টাদের অবস্থান। প্রশাসনে স্টিভ বেননের মতো বর্ণবাদী ব্যক্তির উপস্থিতি ও গুরুত্ব এই প্রশাসনের রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান বোঝা সহজ করে দেয়। (যাঁরা এ অবস্থা বুঝতে সক্ষম হননি, কিংবা বিভিন্ন ‘বিবেচনায়’ ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন/দিচ্ছেন—যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে—তাঁদের শুধু এটুকু অনুরোধ জানাই এ ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ করুন; এর তাৎপর্য কেবল মার্কিন সমাজের জন্যই নয়)।
ইতিমধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, জর্জ ডব্লিউ বুশসহ রিপাবলিকান পার্টির অনেক নেতা নাম ধরেই ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন। বিভিন্ন কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহীরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অর্থনীতি, শিল্প ও কর্মসংস্থানবিষয়ক দুটি উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে শুরু করলে ট্রাম্প নিজেই এই দুটি পরিষদ ভেঙে দিতে বাধ্য হন। মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু শারলটসভিলের ঘটনার পর, বিশেষত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্যের পর দেশের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা, অর্থাৎ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, মেরিন কোর, বিমানবাহিনী ও ন্যাশনাল গার্ডের জয়েন্ট চিফ স্টাফরা একত্রে এবং আলাদাভাবে বিবৃতি দিয়ে বর্ণবাদী ও উগ্রপন্থী সহিংসতার বিরুদ্ধে তাঁদের মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এটি প্রত্যক্ষভাবে ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া বলে মনে না হলেও তাতে করে তাঁদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়েছে।
এসব প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে দেয় যে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের বিরুদ্ধে দেশের এক বড় অংশই সরব এবং তাঁরা একে মার্কিন সমাজের মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্বশীল মনে করেন না। কিন্তু এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে মার্কিন সমাজে এ ধরনের উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের একেবারেই সমর্থন নেই। তাঁদের ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে গৃহযুদ্ধের পরপরই এই শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উত্থান ঘটে দেশের দক্ষিণে, ১৮৮০ ও ১৮৯০-এর দশকে তাঁদের শক্তির অবসান ঘটে। কিন্তু তাঁরা আবার ফিরে আসে ১৯১৫-এর পরে। এ প্রচেষ্টায় তাঁরা খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে না পারলেও ১৯৫৪ সালে ব্রাউন বনাম বোর্ড মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে স্কুলশিক্ষায় বর্ণবাদী পৃথক্করণের অবসান হলে আবার শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের জাগরণ লক্ষ করা যায়। আজকে যে ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্য এবং বিশেষ করে শারলটসভিল যে এই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, তারও কারণ আছে—এই শারলটসভিলে পৃথক্করণ বাতিলের রায় না মানার জন্য স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
মার্কিন সমাজে এই শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের প্রত্যক্ষ সমর্থনের পরিমাণ কম হলেও রিপাবলিকান রাজনীতিবিদেরা তাঁদের প্রতি অপ্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়েছেন, নির্বাচনে তাঁদের ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের অভিযোগ এমনকি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে রিচার্ড নিক্সনের আচরণেও ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর কখনোই প্রত্যক্ষভাবে এই উগ্রপন্থীদের সমর্থন বা উসকানি দেওয়ার উদাহরণ নেই, তাঁদের থেকে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনের প্রচারের সময় থেকেই তাঁদের ওপর নির্ভর করেছেন। এখন তাঁর পক্ষে এই সমর্থকদের থেকে দূরে সরে যাওয়া সম্ভব হবে না। ট্রাম্প বিভিন্ন কারণে, বিশেষত নির্বাচনের সময়ে রাশিয়ার সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগে যতই দুর্বল হয়ে পড়ছেন, যতই তাঁর দলের নির্বাচিত নেতাদের সমর্থন হারাচ্ছেন, ততই এ ধরনের গোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। ফলে সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি তাঁর অবস্থান থেকে আর সরে আসবেন না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে রিপাবলিকান পার্টির নেতারা কী করবেন? আমরা সেই প্রশ্নের আশু এবং সহজ উত্তর পাব, এমন আশা করার কারণ নেই।
যেভাবেই দেখি না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের বিবেচনায়, আমার ধারণা, আমরা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে উপস্থিত হয়েছি। এটি কেবল ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির প্রশ্ন নয়। মার্কিন সমাজে বর্ণবাদ, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ, সহিংস উগ্রপন্থার বিস্তারের মুখে দেশের উদার এবং সংখ্যাগুরু নাগরিকেরা দেশের ভবিষ্যতের পথরেখা কীভাবে নির্ধারণ করতে চান, তা-ই আগামী দিনগুলোতে নির্ধারিত হবে।
প্রথম আলো ,১৮ আগস্ট ২০১৭