December 21, 2024

তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের মধ্যে গত শনিবার ঢাকার অদূরে যে সংঘর্ষ হয়েছে, তার আশু কারণ বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠান এবং তাবলিগের নেতৃত্বের প্রশ্ন। কিন্তু একে কেবল একটি সংগঠন বা আন্দোলনের বিবদমান দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব বলে বিবেচনা করা সঠিক হবে না। তাবলিগ জামাত একটি বৈশ্বিক সংগঠন এবং তার কেন্দ্রীয় দপ্তর দিল্লিতে অবস্থিত হলেও প্রতিবছর বাংলাদেশে জামাতের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের একটা বড় রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এর তাৎপর্য এবং প্রভাব আরও অনেক বেশি; এই ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে। ফলে এই ঘটনা, যা আকারে বড় হলেও একেবারে অভূতপূর্ব নয়, তার সহজে দৃশ্যমান নয়-এমন কারণ এবং তার গতি-প্রকৃতি বোঝা দরকার।

তাবলিগ জামাতের এই সংঘাতের দুই পক্ষে আছেন দিল্লি মারকাজের আমির সাদ কান্ধলভী এবং তাবলিগ জামাতের নেতা মাওলানা জুবায়ের। তাবলিগের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের প্রশ্ন নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত হয় ২০১৪ সালে যখন সাদ কান্ধলভী নিজেকে আমির বলে ঘোষণা করেন। তাঁর এই ঘোষণা তাবলিগের এক পক্ষের মতে ১৯৯৬ সালে গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপন্থী। কেননা, ১৯৯৬ সালে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে তিন সদস্যের একটি শুরা সংগঠন পরিচালনা করবেন, প্রতি সপ্তাহে একজন ফয়সাল থাকবেন, যিনি ওই সপ্তাহের আমির বলে দায়িত্ব পালন করবেন। এই শুরার একজন মারা গেলে মাওলানা সাদ এবং আরেকজন তাবলিগ জামাত পরিচালনা করছিলেন।

কিন্তু ২০১৪ সালে শুরার দ্বিতীয় সদস্যের মৃত্যুর পরে মাওলানা সাদ নিজেকে আমির বলে ঘোষণা করেন। পরে তাঁর কিছু কিছু বক্তব্য নিয়ে জামাতে ভিন্নমত এবং বিতর্কের সূচনা হয়। ইতিমধ্যে ১৩ সদস্যের একটি শুরা গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে জামাতের একাংশ নেয় মাওলানা সাদের পক্ষ এবং অন্য পক্ষ থাকে নবগঠিত শুরার পক্ষে। এই সব বিতর্কের সূত্র ধরেই গত বছর বিশ্ব ইজতেমার সময় মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে নিয়ে দুই পক্ষ পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার মধ্য দিয়ে মাওলানা সাদ ঢাকায় এসেও বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে পারেননি। এবার এ নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত হয় ইজতেমার তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। শনিবার তারই ধারাবাহিকতায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

এখানে এসে আমাদের যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হওয়া দরকার, তাবলিগ একটি বৈশ্বিক ইসলামি আন্দোলন এবং তার মারকাজ দিল্লিতে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের রক্তক্ষয়ী প্রকাশ বাংলাদেশে ঘটছে কেন? এর একটি অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, এই ঘটনাবলির সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতি এবং ইসলামি সামাজিক আন্দোলনের মধ্যকার ঘটমান পরিবর্তন। যদিও তাবলিগ জামাত প্রচলিত অর্থে অরাজনৈতিক সংগঠন, কিন্তু সমাজের ইসলামীকরণকে যদি আমরা রাজনীতি বলে বিবেচনা করি, তবে তাবলিগের একটি রাজনৈতিক অবস্থান আছে, সেটা অনস্বীকার্য। কিন্তু এই দিকটিকে আপাতত প্রত্যক্ষভাবে বিবেচনায় না নিয়েই বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে তাবলিগের এই দ্বন্দ্ব যুক্ত দেখতে পাই।

কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতিতে এবং ইসলামি সামাজিক আন্দোলনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে; এটা কেবল হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য, ৬০ টির বেশি ইসলামপন্থী দলের মহাজোটের শরিক হওয়া দিয়েই বোঝা যাবে না; এটা বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ঘনিষ্ঠতা এবং অম্ল-মধুর সম্পর্ক বা ২০ দলের জোটে মাত্র ৫টি ইসলামপন্থী দলের উপস্থিতি দিয়েও বোঝা যাবে না; যদিও এগুলো সেই প্রক্রিয়ার অংশ এবং তাতে করে আমরা এই পরিবর্তনের একটি ধারণা পাই বটে। তাবলিগ জামাতের কথিত ‘অভ্যন্তরীণ’ কলহ এবং সহিংসতা হচ্ছে সেই পরিবর্তন প্রক্রিয়ার একটি দৃশ্যমান প্রমাণ।

বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দেওবন্দী ধারার সঙ্গে তাবলিগের যে ‘অলিখিত সমঝোতা’ বা পরস্পরকে সহ্য করার একটা বিষয় ছিল, সেটা ক্রমাগতভাবে ইদানীংকালে অন্তর্হিত হয়েছে। কেননা, দেওবন্দী ধারার প্রতিনিধিরা তাবলিগকে হয় তাদের অধীন করতে বা তাকে নিষ্ক্রিয় করতে বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যে ইসলামপন্থী রাজনীতির দেওবন্দী ধারার প্রতিনিধি হিসেবে হেফাজতে ইসলাম নিজেদের প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে, ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য তাদের শক্তিশালী করেছে। সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের অসামান্য প্রভাবের উপকরণ হচ্ছে কওমি মাদ্রাসা, যার সর্বোচ্চ ডিগ্রির স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে সমাজে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে। যে কারণে দেওবন্দী মাদ্রাসার অনুসারী কওমি মাদ্রাসার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। এখন তাবলিগ যদি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়, তবে সামাজিক ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই ইসলামের রক্ষণশীল ব্যাখ্যাই হবে প্রধান (বা ডমিন্যান্ট)। বাংলাদেশে ইসলামের যে বহু ধরনের ব্যাখ্যা ছিল (ও আছে), তাকে সমসত্ত্ব বা হোমোজেনাইজ করার পথে এটি বড় পদক্ষেপ। এর একটি সেক্টারিয়ান দিকও আছে। কেননা, এই ধারার বিপরীতে আছে বারেলভি বলে পরিচিত আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত।

এই ধারার প্রতিনিধিরা কী অবস্থান নেবেন? আমরা তার কিঞ্চিৎ লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলাম ২০১৩ সালে হেফাজতের উত্থানের দেখুন আমার এই বিষয়ে নিবন্ধ, রাজনীতির মাঠে দুই নতুন খেলোয়াড়, ৪ মে ২০১৩ পারস্পরিক এই বিরোধ সত্ত্বেও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত ও হেফাজত কিছু বিষয়ে একমত, যার অন্যতম হচ্ছে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন। এই অভিন্নতা তাদের এক কাতারে দাঁড় করাবে না-কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপরে ভবিষ্যতে যে চাপ তৈরি করবে, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বিশেষ করে ক্ষমতায় যদি এমন দল থাকে, যাদের নৈতিক বৈধতার সংকট রয়েছে, তাদের পক্ষে এই চাপের সামনে নতি স্বীকারের বিকল্প থাকবে না। গত চার বছর তার বড় বড় উদাহরণ তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যেই আমরা এ-ও দেখেছি যে গত এক দশকে বাংলাদেশের সমাজের ইসলামীকরণ আগের যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে গেছে এবং রাজনীতি ও গণ-আলোচনার সূচি (পাবলিক ডিসকোর্সের অ্যাজেন্ডা) ইসলামপন্থীরা নির্ধারণ না করলেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

ইসলামপন্থী রাজনীতির এই পরিবর্তনগুলোকে যাঁরা কেবল আশু স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের লাভ হিসেবে দেখছেন, তাঁদের এটা উপলব্ধি করা দরকার যে এই সব পরিবর্তনের মেয়াদ নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়, কেবল নির্বাচনের মধ্যেই তার প্রভাব থাকবে না; বাস্তব বিচারে এগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকেন্দ্রিক। রাজনীতি ও সমাজে রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের ক্রমাগতভাবে অধিক জায়গা ছেড়ে দেওয়ার পরিণতি ইতিবাচক হওয়ার কারণ নেই। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে একে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ বলাই সঠিক হবে; যাঁরা এই আগুন নিয়ে খেলছেন, তাঁরা বুঝতে পারছেন কি?

প্রথম আলো, ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮।

Leave a Reply