This post has already been read 14 times!
আজ ২৯শে সেপ্টেম্বর। সেপ্টেম্বর মাস অনেক কিছুর কারণেই মনে রাখার মত মাস। অনেক প্রিয় মানুষ জন্মেছেন এই মাসে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা আছে যা আমাদের সমাজ রাষ্ট্রের পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু সবকিছু কে ছাপিয়ে রামুতে ২০১২ সালে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কথা মনে পড়ে। যা ঘটেছে তা ফেরানো সম্ভব নয় কিন্তু এসব ঘটনা থেকে আমরা ভবিষ্যতে পথ চলার জন্যে যে শিক্ষা নেয়া দরকার তা কেউ নেই না। নেয়ার কোন নজীর নেই।
কক্সবাজারের রামু, উখিয়া এবং চট্টগ্রামের পটিয়াতে ২০১২ সনের ২৯ এবং ৩০শে সেপ্টেম্বর সাধারণ মানুষের বাড়ী ও মন্দিরে হামলা হয়। রামু ও উখিয়ার ঘটনার মোট সাতটি মামলা মামলা হয়েছিল যেখানে চৌদ্দ হাজারেরও বেশী ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে পুলিশ তদন্ত করে তিনশত চুরাশি জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পুলিশি তদন্তে অনেক জড়িত ব্যক্তিকে বাদ দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলার কারণে বিচার বিভাগীয় একটি তদন্ত হয় এবং সেই তদন্তে যাদের নাম এসেছিল তাদের অনেকেই পুলিশি তদন্ত থেকে বাদ পড়েছেন। বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রাধান্য পাবে নাকি পুলিশের তদন্ত প্রাধান্য পাবে সেই বিষয়ের সুরাহা এখনো হয়নি। ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় থাকার কারণে এবং স্থানীয় হওয়ায়, যারা ঘটনার চাক্ষুস সাক্ষী তারাও আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে ভয় পাচ্ছেন কিংবা জান বাঁচাতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেন। এখানে বলে নেয়া ভাল- বিচার বিভাগীয় তদন্তের সময় তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাইকে ঘোষণা দিয়ে এবং লিফলেট বিতরণ করে স্থানীয় অধিবাসীদের অভয় দিয়ে জানিয়েছিলেন যে তারা যদি সাক্ষ্য দেন তবে তা গোপন রাখা হবে। কিন্তু বিচার বিভাগীয় তদন্তের সময় কে কে কি কি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তা গোপন থাকেনি। ফটোকপি করার সময় একজনকে গ্রেফতার করার ঘটনাও ঘটেছিল। বিচার বিভাগীয় তদন্তের রিপোর্ট উচ্চ আদালতে জমা হলেও সেই রিট মামলা এখনো শুনানী হয়নি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে- মামলার বিচার পাওয়ার চেয়ে সাক্ষ্য কে কে দিয়েছিলেন তাদের নাম গোপন রাখা বেশী জরুরী হয়ে পড়েছে। এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে অনেক নিরীহ স্থানীয় ব্যক্তির নতুন করে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। ফলে দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে ঘাঁটাঘাঁটি করার সাহসও হারিয়ে ফেলেছি প্রায়।
দিনের পর দিন ধর্মীয় ও জাতিগত কারণে সাধারণ নাগরিকদের উপর হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা চালানো হলেও আমাদের একশ্রেণীর সুশীলরা “বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ” ধরণের আপ্ত বাক্য আউড়ে যান। অশিকাংশ ক্ষেত্রে এদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেও ঘৃণা হয়। তাই নতুন করে কোন ঘটনা যেন নিজেরা জন্ম না দিই সেজন্যে সতর্ক থাকতে হয়।
অনেকেই বলেন ২০১২তে কেবল বৌদ্ধদের উপর এই হামলা হয়েছে, এর আগে তাদের উপর কোন হামলা হয়নি। এধরণের যুক্তি যারা দেন তারা মূলত আশির দশক থেকে পাহাড়ে চলমান রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে এড়িয়ে যেতে চান। চোখ বুজে থাকতে চান। এদেশে জাতিগত ও ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের ইতিহাস এখন বেশ দীর্ঘ। তাই চালুনি হয়ে সুঁইয়ের পেছনে ফুটো আবিস্কার করতে যাওয়া আহাম্মকি ছাড়া আর কিছুই নয়।
ঘটনা যেকারণেই ঘটুক, যারাই ঘটাক- সেটি যদি অপরাধ হয় তবে রাষ্ট্র তার নিজ নিয়মে ব্যবস্থা নেবে এটাই প্রত্যাশিত কিন্তু সেটি অর্জন আমাদের এখনো সুদূর পরাহত। রামুর পরে পাবনার সাঁথিয়ায়, কুমিল্লায়, যশোরে, দিনাজপুরে কিংবা নাসিরনগরে একই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পেরেছে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার ফলে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার ইতিহাস নেই বলে। সেটি যে কেবল ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাতের বেলায় ঘটছে তা নয়, বরং সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী যদি প্রান্তিক হয় তবে তারাও একই ধরণের আইনি সুরক্ষা রহিত অবস্থায় আছেন। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ঘটনা আমাদের সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সেখানে কেবল সাঁওতালরা ছিলেন না, ক্ষতিগ্রস্তদের একটি বড় অংশ ছিলেন মুসলিম। তাদের কথা মিডিয়াও তেমন করে পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি, অথচ আমরা যারা এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে তাদের সাথে যুক্ত আছি, তাদের যুক্ত হওয়ার পেছনে মূল যুক্তিই ছিল গোবিন্দগঞ্জবাসীর মিলিত সংগ্রাম। সেই হামলার কোন কুল কিনারা হবে বলে যারা ভাবছেন তাদের মত আশান্বিত হতে পারলে খুব ভাল লাগতো।
সাম্প্রতিক সময়ে বার্মায় সামরিক জান্তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর যে বর্বরতা চালিয়েছে তা কাছাকাছি সময়ের যেকোন বর্বরতাকে হার মানায়। এই হামলার পেছনে জাতিগত এবং রাজনৈতিক সংঘাত যেমন ছিল তেমনি ধর্মীয় কারণেও নিপীড়ন এবং হত্যার কথা আমরা শুনছি। কেউ কেউ এটাকে কেবলই ধর্মীয় কারণে সংঘাত বলে চালাতে চাইছেন এবং এর ফলে কোন কোন জায়গায় সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের খবর পাওয়া যাচ্ছে। যদিও একে অনেকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চান এবং সেই বিখ্যাত বাণী- “বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ” শুনতে হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতাকে অনেকেই কিতাবি ভাষায় বোঝার চেষ্টা করছেন, ফলে যুক্তির খেই হারাচ্ছেন। একটা কাগজে লিখে দিলাম “আমি আজ থেকে অসাম্প্রদায়িক” আর আজ থেকে আমি অসাম্প্রদিক হয়ে গেলাম বিষয়টা মোটেও সেরকম নয়। শিক্ষক স্বাধীন সেন যথার্থই বলেন- “অসাম্প্রদায়িকতা নিয়মিত চর্চার বিষয়। প্রতিদিনের চর্চায় অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে হয়।” প্রতিদিনের চর্চায় আমারা অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছি নাকি দিনে দিনে আরও সাম্প্রদিক সংকীর্ণতায় বাঁধা পড়ছি সেই বিচারের ভার আমাদেরই।
বার্মার সহিংসতার সাথে এখানকার ঘটে যাওয়া ঘটনার তুলনা করছেন অনেকেই। করাটাই স্বাভাবিক কিন্তু কোন ঘটনার সাথে অপর কোন ঘটনার আসলে তুলনা চলে না। ভুক্তভুগীরাই কেবল বোঝেন ঘটনার তীব্রতা। যেকারণে আমরা ঘটনার পাঁচ বছর পরেও, যারা রামুতে সহিংসতা করেছিল সেইসব অপরাধীদের বিচার চাই, প্রতিনিয়ত হিন্দুদের প্রতিমা আর মন্দির ভাঙার বিচার চাই, ঠিক একই কারণে বার্মায় যারা সহিংসতা করেছে, সেই অপরাধী সামরিক জান্তা এবং সাধারণ নাগরিক যারা অপরাধে জড়িত ছিলেন- তাদের বিচার চাই। অন্যসব পরিচয় ছাপিয়ে দিনশেষে, নির্যাতিত মানুষের পরিচয় কেবলমাত্র নির্যাতিত। এই নির্যাতনে আমরা যদি আজ রোহিঙ্গাদের পাশে না দাঁড়াতে পারি, তাহলে আগামীতে নিজের উপর যদি আবার নির্যাতন হয়, তবে তার প্রতিবাদ করারও নৈতিক বল থাকবে না। আর যারা বার্মায় সংঘটিত সহিংসতাকে নিজের ঘরে টেনে আনছেন তাদের ক্ষেত্রেও একটা কথা খুব পরিস্কার করে বলা প্রয়োজন-বার্মায় সংঘটিত সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রয়োজনেই নিজের ঘর ঠিক রাখা সবার নৈতিক দায়িত্ব। নিজে নিপীড়নকারী হয়ে অন্যের নিপীড়নের প্রতিবাদ করা যায় না।
This post has already been read 14 times!