শিক্ষা ব্যবসায়িক পণ্য হতে পারে কিনা, তা নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা রয়েছে। অনেকেই শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ভাবতে চান। এই দলে যারা আছেন তারা মূলত শিক্ষার প্রসার এবং মান বাড়ানোর জন্যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বদলে বাজারের প্রতিযোগিতা, বেসরকারি ব্যবস্থাপনা এবং বেসরকারিকরণের পক্ষেই সাফাই গেয়ে থাকেন।
আরেকদল আছেন, যারা প্রথম দলটির বাজারকেন্দ্রিক দর্শনের বিপরীত ধারণার বিশ্বাসী। তারা শিক্ষাকে সামষ্টিক কল্যাণের অন্যতম উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেন। তাই তারা শিক্ষার প্রসার এবং বিস্তারের জন্য, শিক্ষাকে সবার জন্য সহজলভ্য ও সর্বজনীন করার কথা বলেন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সরাসরি আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার উপর তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
আমি নিজেকে দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভূক্ত বলে মনে করে থাকি। নিজেকে এভাবে দলভূক্ত করার পেছনে যত না তাত্ত্বিক যুক্তি, তার চেয়ে ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক বেশি উৎসাহিত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা-ঋণ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক বিতর্ক সম্পর্কে জানার পর এ উৎসাহ আরও শক্তিশালী হয়েছে।
আমার এ লেখায় ব্যক্তিগত শিক্ষা অভিজ্ঞতাসহ শিক্ষা-ঋণ সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সময়ের সংকটের উপর দুভাগে আলোকপাত করছি।
আমার শিক্ষা অভিজ্ঞতা
আমার শিক্ষাজীবনের সূচনা ঘটেছিল ঢাকা শহরের কোনো এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেককেই আজও আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। সত্যিকার অর্থে আমার হাতেখড়ি হয়েছিল সে সব মহান মানুষের হাত ধরে। সে সময় মুনাফার বাজারি কাঠামো মানুষকে ততটা গ্রাস করেনি। সবকিছুতেই ‘আমার কী লাভ’, এ চিন্তা তখনও অতটা আধিপত্য তৈরি করতে পারেনি।
পরবর্তী সময়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি কলেজ, তারপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ভালো ফলাফলের সুবাদে শিক্ষা-বৃত্তি নিয়ে বিদেশে যাই, আরেকটি মাস্টার্স করার জন্য। ফিরে আসার কয়েক বছর পর আবার বৃত্তি নিয়ে দেশত্যাগ, পিএইচ-ডি করার জন্যে এবং তা শেষ করে আবার দেশে ফিরে আসা।
তাই আমার শিক্ষাজীবনের যতটুকু অর্জন, তার সবটুকুই রাষ্ট্রীয় আর সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতার ফসল। পারিবারিক সামর্থ্যের দিক চিন্তা করে কখনও বেসরকারি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম না। উপরন্তু, অন্তত সে সময় পর্যন্ত সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের সু্যোগ পাওয়া অনেক গর্বের বিষয় ছিল। শিক্ষার মান বিবেচনায় সে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো সন্তানের অধ্যয়ন পারিবারিক সাফল্যের মাপকাঠিও ছিল। মেধার যোগ্যতার চেয়ে অর্থের শক্তি তখনও নিজ সন্তানকে ‘ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার’ বানানোর ক্ষেত্রে অতটা বড় নিয়ামক হয়ে উঠতে পারেনি। এখনকার নব্য-ব্যবসাবাদের যে সময় আমরা পার করছি, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের বিষয়টা সে রকম ছিল না।
অথচ রাষ্ট্র ও সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় আজকে যাদের অনেকেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, আমলা হয়েছেন, রাজনীতিবিদ হয়েছেন, শিক্ষক হয়ে নিজের শ্রেণির উত্তরণ ঘটিয়েছেন, তারাই শিক্ষাকে বাজারকেন্দ্রিক দর্শন দ্বারা পরিচালনার ব্যাপারে মহাআগ্রহী। আর এ শ্রেণিভূক্ত আমরা আগ্রহী হব না কেন? এ নব্য-ব্যবসাবাদের যুগে আমরা তো আর্থিকভাবে সক্ষমতা অর্জন করেছি! এখন শুধু প্রয়োজন নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপরে উঠার পথটি আরও সহজ করে দেওয়া। আর তার সঙ্গে আমাদের নিজেদের শ্রেণি-আধিপত্য নিশ্চিত করা।
সেজন্যই সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধঃগামিতা, মানহীনতা আমাদের এখন আর বিচলিত করে না। বরং এ ভেবে আমরা খুশি হই যে, আমাদের ছেলেমেয়ে তো ওখানে পড়ে না! পড়ে রাজধানীর অথবা বিদেশের কোনো ‘নামি-দামি’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে! এতে ভবিষ্যত নেতৃত্ব তো ‘আমাদের’ হাতেই থাকবে! ‘মানহীন’ সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ে আসা শিক্ষার্থীরা হবে আমাদের সন্তানদের অধস্তন মাত্র। যেন উপনিবেশবাদের আরেক দেশীয় সংস্করণ!
এ দলের কেউ কেউ অবশ্য অন্যদের কথাও ভাবেন। তারা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির কথা বলেন, শিক্ষাঋণের কথা বলেন। অথচ তারা ভাবেন না, এ নব্য-ব্যবসাবাদের যুগে শিক্ষা যখন মুনাফা জোগানোর সহজলভ্য অনার্থিক পুঁজি হয়ে উঠে, তখন এ বৃত্তি, এ ঋণ দেশের অস্বচ্ছল পরিবারের সংখ্যা বিবেচনায় কতটুকু ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারবে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে নব্য-ব্যবসাবাদের অন্যতম জনক এবং মডেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাঋণের স্বরূপ বোঝা জরুরি এবং তা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিকও বটে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাঋণ এবং তার স্বরূপ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাঋণ প্রচলনের একটি রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক মহাকাশে ‘স্পুটনিক’ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে একটি রাজনৈতিক বিতর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। আর সেটি হল– দেশটি তার প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় বিজ্ঞান ও কারিগরিসহ সামাজিক উন্নয়ন এবং শিক্ষাবৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে।
এ বিতর্কের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৮ সালে National Defense Education Act নামে সেখানে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের আওতায় কিছু নির্দিষ্ট বিষয়, যেমন, বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং শিক্ষাসংক্রান্ত বিদ্যা বিস্তারের জন্য শিক্ষাঋণ প্রথমবারের মতো চালু করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
পরে এ আইনের অনুসরণে Higher Education Act নামে একটি স্বকীয় আইন ১৯৬৫ সালে চালু হয়। এরপর থেকে আইনটি অনেক ধরনের পরিমার্জন আর পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে গেলেও শিক্ষাঋণের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুব স্পষ্ট ছিল। ঋণটি প্রদান করা হত সরকারি এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। বেসরকারি খাতে বিভিন্ন ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি শিক্ষাঋণ প্রদানের জন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে ভর্তুকি পেত। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতি বছর প্রবেশ করা প্রায় দুই কোটি নতুন শিক্ষার্থীর মধ্যে, এক কোটি বিশ লাখের মতো শিক্ষার্থী এ ঋণ পেয়ে থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে বেসরকারি খাতের ব্যাংক এবং ইনস্যুরেন্স কোম্পানির একজন শিক্ষার্থীর ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট বেসরকারি কোম্পানির প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষপাতিত্ব, দুর্নীতি, উচ্চসুদের হারসহ অনেক ধরনের অব্যবস্থাপনা সরকারের প্রকল্পটিকে বিতর্কিত করে তুলেছে। এ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ‘সালী মে’ নামের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানটি। এটি শুরুতে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরে একে বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে ২০০৮ সালে শুরু হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংকটের পর থেকে শিক্ষাঋণ প্রকল্পে অনেক বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আগ্রহ হারাতে শুরু করে। এর সঙ্গে শিক্ষাঋণ নিয়ে শুরু হওয়া রাজনৈতিক বিতর্কের কারণে রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা নতুন কিছু আইনগত পদক্ষেপ নেন। তারই প্রকাশ ঘটে ২০১০ সালে Heath Care and Education Reconciliation Act নামের বিল পাশের মাধ্যমে। অ্যাক্টটির আওতায় শিক্ষা ঋণ নিয়ে যে পরিবর্তনগুলো আনা হয়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল– মধ্যস্বত্বভোগী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণপ্রদান ভূমিকার বিলোপ। অন্য কথায়, নতুন আইনটির ফলে শিক্ষাঋণ প্রদানের দায়িত্ব বর্তমানে এককভাবে সরকারের উপর ন্যস্ত হয়েছে।
এ বছর (২০১৩ সাল) শিক্ষা ঋণ সংক্রান্ত আরেকটি বিল পাশ হয়েছে মার্কিন কংগ্রেসে। বিলটির নাম Bipartisan Student Loan Certainty Act, বিলটির কারণে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘স্ট্যাফোর্ড’ নামের শিক্ষাঋণে সুদের হার ২০১৫ সাল নাগাদ ৩.৮% নির্ধারণ করা হয়েছে, যা একসময় দ্বিগুণ হওয়ার আশংকা ছিল। তবে পরে সুদের এ হার পুনঃনির্ধারিত হবে এবং তা প্রচলিত আর্থিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা হবে।
এ রকমটা হলে, ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দশ বছরে সরকারের মুনাফা দাঁড়াবে ১৮,৫০০ কোটি (১৮৫ বিলিয়ন) ডলার, গত দশ বছরের যা ছিল ৯০০০ (৯০ বিলিয়ন) কোটি ডলার। এ খাতে খেলাপী ঋণ আদায়ের সাফল্যের হারও অনেক বেশি। অর্থনৈতিক মন্দার আগে এ হার ছিল ১২২%। আর এখন ১০০% এর কিছু উপরে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষাঋণের এ বাজারমুখিতা আসলে অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য কতটুকু সুফল বয়ে এনেছে?
উপরের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে, ‘রোলিং স্টোন’ নামের এক জনপ্রিয় পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্টে। ম্যাট টাইবি তার ঝড়তোলা ‘Ripping Off Young America: The College Loan Scandal’ শিরোনামের রিপোর্টটিতে শিক্ষাঋণের সংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘আমেরিকার উচ্চশিক্ষার গোপন নোংরা দিক হচ্ছে যে, শিক্ষাঋণের সংকট আলোচনায় সুদের হারের বিষয়টি বহুলাংশে অপ্রাসঙ্গিক। ঋণ নেওয়ার পর এ হার আর সমস্যার মূলে থাকে না। আসল সমস্যা হল, প্রতিবছর হু হু করে বেড়ে যাওয়া ভর্তিব্যয়। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ ব্যয় বেড়ে চলেছে দুই-তিন গুণ হারে, ঠিক যেভাবে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের আগের বছরগুলোতে বাসাবাড়ির ব্যয় বেড়েছিলো।’’
আবার একবার শিক্ষাঋণ নিলে এর ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসার কোনো উপায় নেই। ম্যাটের মতে, ‘‘একজন জুয়াড়ি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারে। কিন্তু একজন অল্পবয়সী শিক্ষার্থী এ ঋণ নিলে আর কখনও এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।’’
কেননা শিক্ষাঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে সরকার রক্ষাকবচ হিসেবে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির চাকরির বেতন, আয়কর রিটার্ন, এমনকি শারীরিক প্রতিবন্ধীর রাষ্ট্রীয় ভাতা ব্যবহার করে থাকে। ঋণগ্রস্ত শিক্ষার্থীকে রাষ্ট্র সামরিক বাহিনীতে যোগদানের সুযোগসহ পেশাগত লাইসেন্স পাওয়া থেকেও বঞ্চিত করতে পারে। এসব কারণে শিক্ষাঋণ শোধের হার ক্রেডিট কার্ডের ঋণশোধের হারের চেয়ে পাঁচ-ছয় গুণ বেশি। এ রকম পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাঋণের মোট পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে এক লাখ কোটি (এক ট্রিলিয়ন) মার্কিন ডলারে। আর মাথাপিছু এই ঋণের পরিমাণ ২৭,০০০ ডলার।
তবে এ রকম কঠিন শর্তযুক্ত ঋণ শিক্ষার্থীদের জন্য কী রকম বিপদ তৈরি করতে পারে, তার বিশদ বর্ণনা আছে ম্যাটের রিপোর্টটিতে। তার মতে, অনেক ঋণগ্রস্ত পরিবার বাচ্চা নেওয়ার সাহস করছে না এবং অনেকে আবার ঋণ শোধ করতে গিয়ে অনেক ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
লেখাটিতে একজন ৩৮ বছর বয়সী আইনবিদের কথাও উল্লেখ করেছেন ম্যাট। এ আইনবিদ শারীরিক অসুস্থতার এক পর্যায়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিবন্ধী ভাতা পেতে শুরু করেন। কিন্তু শিক্ষাঋণের দায় থাকার কারণে তার প্রতিবন্ধী ভাতা থেকে প্রতিমাসে ১৭০ ডলার কেটে নেওয়া হচ্ছে। এ নব্য-ব্যবসাবাদী মুনাফার যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শারীরিক প্রতিবন্ধীরও রক্ষা নেই! নেই কোনো শিক্ষাঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কংগ্রেসের মাধ্যমে ‘বেইল আউটের’ সু্যোগ!
আমরা কী চাইব
পরিশেষে, আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অন্তত এটা উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, আমার শিক্ষাজীবনে রাষ্ট্র আর সমাজের মুনাফাবিহীন বিনিয়োগ ছাড়া আমার পক্ষে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন একেবারে অসম্ভব ছিল। সে উপলব্ধি এবং দায়বদ্ধতা থেকেই আমিও অন্য অনেকের মতো শিক্ষাকে সার্বিক ও সামষ্টিক কল্যাণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাঋণ-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা আমার এ উপলব্ধিকে আরও জোরদার করেছে মাত্র। কেননা শিক্ষাকে বাজারমুখী, ব্যবসামুখী করার প্রক্রিয়া– তা সে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হোক কিংবা বেসরকারি খাতে-– কখনওই সামষ্টিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে না। অধিক মুনাফার বাজারে লোভ সামলানো অত সহজ নয়।
তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও শিক্ষাঋণ ব্যবস্থা পারিবারিক এবং সামাজিক স্বস্তি-– এই দুই-ই নস্যাত করে চলেছে। অথচ সে দেশে ১৯৫৮ সালে প্রবর্তিত এ ঋণব্যবস্থার মূলে চেতনাটি ছিল, শিক্ষার বিস্তারই পারে রাষ্ট্রের সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে আর বৈষম্য দূর করতে।
আমরাও অবশ্যই স্বস্তিই চাইব।
প্রথম প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ১, ২০১৩ (www.bdnews24.com)
জনাব তানজীম উদ্দিন খানকে ধন্যবাদ। তার সুন্দর লেখার জন্য। শিক্ষা পণ্য হবে কী হবে না এই প্রতিপাদ্য বিষয়ে তিনি আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থার কথা চিত্রায়িত করেছেন। ভাল ছাত্র হওয়ার সুবাদে তিনি স্কলারশীপ নিয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। বর্তমানে University of New England, ২০১০-১৩) এ পিএইচডি করছেন।আমি দৃঢ়ভাবে আশা করি পিএইচডি সমাপ্ত করে তিনি নিজ দেশে ফিরে এসে তার জ্ঞানের আলো ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে দেবেন। শিক্ষা পণ্য কীনা অতি সম্প্রতি এই বিষয় দেশে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। রাবি’র সাণ্ধ্যকালীন কোর্স নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ নামধারীদের অস্ত্র নিয়ে মারামারিতে লিপ্ত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অস্ত্রধারী যে দলের হোক তাদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থার নেয়ার কথা মহান জাতীয় সংসদের (দশম) দ্বিতীয় অধিবেশনে বলেছেন। রাবি’র সাধারণ শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যেই হল ত্যাগ করেছেন। কত দিন রাবি বন্ধ থাকবে জানি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। নানা কারণে সেশন জোট লেগে আছে বিষয় বিদ্যালয়ে। এই শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা জীবন শেষ করার পর সরকারি চাকুরী পাওয়ার বয়স হারাবেন।ফিরে আসি শিক্ষা পণ্য বিষয়ে । শিক্ষা হলো জ্ঞান। জ্ঞান পণ্য নয়। কিন্তু শিক্ষা গ্রহণের পর যখন একজন কর্মজীবন শুরু করেন, তখন তার শিক্ষা পণ্যে পরিণত হয় বটে এই অর্থে যে, তিনি শ্রমের বিনিময়ে বেতন-ভাতাদি লাভ করেন। বাংলাদেশের অনেক পাবলিক(সায়ত্ব শাসিত এবং সরকারি) বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু আছে। এই কোর্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের কোন ক্ষতি করছে না এবং শিক্ষকগণ তাদের নিয়মিত ক্লাশ বাদ দিয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্সে পড়াচ্ছেন তাও নয়। শিক্ষা অজর্ণের দ্বার উন্মেুক্ত থাকাই ভাল। আর যাই হোক রাজধানী ঢাকাসহ দেশের মফস্বল শহরে ব্যঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ এন্ড ডেন্টাল , টেকনোলজি এন্ড সায়েন্স এই ধরণের নানা নামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এই সব প্রতিষ্ঠানে (সব প্রতিষ্ঠান এ রকম তা বলছি না ) টাকা দিলে সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।যা দেশের মেধা বিকাশ চেয়ে অধপতিত করছে। বিশ্ব বিদ্যালয় মন্জুরী কমিশন কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। সারা দেশে নিতে পেরেছেন তা নয়। এর চেয়ে স্বীকৃত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স সম্পন্ন করে সার্টিফিকেট পেলে তা গৌরবের বটে। এটাকে বাণিজ্যিক বা শিক্ষা পণ্য হিসেবে দেখে যারা আন্দোলন করছেন, তাদের প্রতি আমার অনুরোধ দয়া করে এটি ভাবেন না। এ কথা ঠিক আপনারা অনেক মেধার পরিচয় দিয়েই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। এই অহং থেকে যদি এই বোধ জেগে থাকে তাহলে তা পরিহার করা ভাল। অহংকার মানুষকে বড় করে না। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগুলার ছাত্রদের টিউশন ফি খুব বেশী বৃদ্ধি করাকে সমর্থন করি না। হারাহারি ভাবে নির্ধারণ করলে ভাল হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে অনেক মেধাবী ছাত্র ভর্তি হতে পারেন না। তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য দেশের নামিদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেন উচ্চবিত্তশালী ব্যক্তিরা । সেখানে যে অর্থ সেমিষ্টার অনুসারে ব্যয় করেন তার একশত ভাগের সিকি ভাগও ব্যয় করতে হয় না পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটা গেল সামর্থ্যবানদের সন্তানদের কথা। যাদের সামর্থ্য নেই। তাদের সন্তানরা কী লেখা পড়া শিখবেন না। নিশ্চয়ই শিখবেন এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে সে সুযোগ করে দেয়ার। আপনি ব্যাংক ঋণের কথা বলেছেন, এটা করা যেতে পারে। আমার এখন সাল মনে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেদের জন্যে ট্যাক্সিক্যাব দেয়া হয়েছিল। তারা খুব বেশী দিন সেটা চালাননি। কারণ ঢাবি বা অন্য কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ড্রাইভারী করবে এটা এগোতে লাগে বটে। এই ছাত্ররাই যখন বিদেশে যান পড়াশোনা করতে; তখন শিক্ষার পাশাপাশি নানা কর্ম-কাজে নিয়োজিত হন। যার মধ্যে বারে মদ বিক্রি করা , কিংবা কোন দোকানের সেলসম্যান হওয়া কিংবা কোন হোটেলে স্যান্ডউইচ বানানো ইত্যকার কাজ। তখন এগো কাজ করে না।নিজ দেশে তো নয় তাই। দয়া করে আমার এই লেখায় কে উ দুখিত হন এটা আমি চাই না। আমাকে ক্ষমা করবেন।বিশ্বের যে সব দেশ উন্নতি করেছে সেই দেশের জাতির দিকে তাকালে দেখা যাবে তারা কোন কাজকে ছোট করে দেখেন না। প্রসঙ্গত: জাপান, চীন , আমেরিকার কথা বলা যেতে পারে। হিরোসিমায় এটম বোম পড়ার পরে এই জাতির তো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। হয়নি তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং সারা বিশ্বে তাদের পণ্য বিক্রি করছে। কিছু দিন আগে সুনামিতে জাপানের একাংশ ধ্বংসে পরিণত হয়। টিভির পর্দায় দেখলাম এই ধ্বংসের মধ্যে একজন মহিলার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে কিন্তু তার হাত ২টি ফুলে তোড়া বানচ্ছে। চীনারা পরিশ্রমী। আজ চীন আছে জন্যেই আমাদের দেশ সহ অনেক দেশে কমমূল্যে ইল্ট্রোনিক্স পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। তাই শিক্ষা এবং কাজের কোন বিকল্প হতে পারে না।আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সুশিক্ষার দ্বার উন্মেুক্ত করতে হবে। আর শিক্ষার নামে যারা নানা বাণিজ্যের সাইন বোর্ড টানিয়ে সার্টিফিকেট বিতরণ করছেন তাদের ব্যাপারে সদাশয় সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন এই প্রত্যাশা করছি।
লেখক: সাংবাদিক, কবি, প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক এবং আইনজীবী।